চশমাপরা হনুমান গত প্রায় ৩ দশকে বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ কমে গেছে। মাত্র তিন প্রজন্ম পার করতেই (প্রতি প্রজন্ম ১০-১২ বছর) এত সংখ্যক কমে যাওয়ায় গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, এভাবে চলতে থাকলে আরো ২-৩ প্রজন্ম পরে এরা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাই এখনি ব্যবস্থা নিয়ে বিপন্ন প্রজাতির এ প্রাণিকে রক্ষা করতে হবে। এ হনুমান বিপন্ন হলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বনায়নের জন্য মারাত্মক হুমকি হবে। কারণ এদের খাদ্যের ১৪ শতাংশ ফল ও বীজ। খাদ্য গ্রহণ শেষে ফলের বীজ বনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এরা। যা মূলত বনকে নতুন জীবন দান করে।
এদের চোখের চারপাশে গোলাকার বৃত্তের মতো সাদা রং থাকে বলে এদের ‘চশমাপরা’ হনুমান বলে। তবে শরীরের বেশিরভাগ অংশই কালো রঙের। এরা মহা বিপন্ন তালিকাভুক্ত প্রাণি।
ঘন চির সবুজ বনের বাসিন্দা নিরামিষভোজী চশমাপরা হনুমান পাতা, ফুল ও ফল পোকামাকড় খায়। এরা দল নিয়ে চলাফেরা করে, সে দলে অনেকগুলো মেয়ে থাকে এবং দলের নেতৃত্বে থাকে এক শক্তিশালী পুরুষ। পুরুষটিই প্রজনন বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করে। এ প্রাণি সাধারণত শব্দ করে কম। বিপদের সম্মুখীন হলে ভয়ংকর শব্দ করে থাকে, যেটাকে অ্যালার্ম কল বলা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে ৩ প্রজাতির হনুমানের মধ্যে অন্যতম সুন্দর হনুমান হচ্ছে চশমাপরা হনুমান। এদের সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের বেশকিছু বনে পাওয়া যায়। তাছাড়া ভারত, মায়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, লাউস ও ভিয়েতনামে পাওয়া যায়। ২০১৫ সালের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইইউসিএন এ প্রাণিকে পৃথিবীব্যাপী বিপন্ন এবং বাংলাদেশে মহা বিপন্ন হিসেবে উল্লেখ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল অ্যানথ্রোপলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. ক্রেইগ স্ট্যানফোর্ড বাংলাদেশের হনুমান নিয়ে ১৯৯০ সালে পিএইচ.ডি করেন। তিনিই ১৯৮৮ সালে প্রথম বাংলাদেশের চশমাপরা হনুমানের ইকোলজি নিয়ে প্রাইমেট কনজারভেশন জার্নালে গবেষণাপত্র লিখেছিলেন। তখন চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার ৩শ’। তবে গত প্রায় ৪ দশকে এ প্রাণির সংখ্যা ৮০ শতাংশ কমে এসেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া একটি গবেষণায় এখন পর্যন্ত মৌলভীবাজারের লাওয়াছড়া ও হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ১৩টি গ্রুপে মোট ১৪৫টির মত হনুমান পাওয়া গেছে। তবে এ গবেষণা চলবে এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. হাবিবুন নাহারের তত্ত্বাবধানে শুরু হওয়া গবেষণায় কাজ করছেন The Rufford Foundation নিয়ে সদ্য মাস্টার্স শেষ করা তানভীর আহমেদ। একই বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. সাবিত হাসান ও তৃতীয় বর্ষের শিমুল নাথ। এছাড়াও ২য় বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন সময় সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. হাবিবুন নাহার জানান, চশমাপরা হনুমানের মাথা ও শরীরের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৫৩ সেমি এবং লেজের দৈর্ঘ্য ৭৬ সেমি। চশমাপরা হনুমান কমে যাওয়ার প্রধান কারণ বনভূমি উজার হওয়া। যার ফলে প্রাণিদের বাসস্থান এবং খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।
বনের ভেতর রাস্তা তৈরি করে এবং গাছ কেটে বনকে বিভিন্ন ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে- বনের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ লাইন নেওয়া। এর ফলে সব ধরনের প্রাণির ক্ষতি হচ্ছে। ২০১৬ সালে লাওয়াছড়া ও সাতছড়িতে ৪টি চশমাপরা হনুমান মারা গেছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। এখনই এদের রক্ষায় গুরুত্ব না দিলে একসময় এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ