কালো গাইয়ের দুধ দেব, দুধ খাবার বাটি দেব, কবিতার ছন্দে ছন্দে তাল মিলিয়ে মায়েরা তাদের সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিত। গরু গৃহপালিত পশু হিসেবে পরিচিত। যুগ যুগ ধরে দুধ পুষ্টির চাহিদা মিটিয়ে আসছে। প্রাচীন যুগে মানুষ নিজেদের পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য গরু পালন করত। গরু পালন যে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এমন ধারণা ছিল না অনেকেরই। কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে গরু পালনে সফলতা লাভ করেছে।
গরুর খামারও যে অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হতে পারে তার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ উপজেলার যাত্রামুড়া এলাকায় নাবিল এগ্রো ফার্ম। এ ফার্মটি দীর্ঘ সময় ধরে দেশের দুধের চাহিদা ও কোরবানির ঈদের স্বাস্থ্যবান গরু সরবরাহ করে অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে আসছে এ ফার্মটি। জানা গেছে, যাত্রামুড়া এলাকার শিল্পপতি আলহাজ নাঈম ভূঁইয়া ২০০৮ সালে ছোট পরিসরে মাত্র ৬টি গরু নিয়ে ফার্মের যাত্রা শুরু করেন।
বর্তমানে ৪ বিঘা জমিতে গড়ে ওঠা ফার্মটিতে এখন গরুর সংখ্যা ৩৫০টি। এর মধ্যে ২৫০টি ষাড় ও ১শ’টি গাভী রয়েছে। খামারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সুষম খাদ্য, ভালো জাতের গরু, উন্নতমানের সার ব্যবহার করে এরই মধ্যে সারাদেশে সুনাম কুড়িয়েছেন। শুধু তাই নয়, গরুর গোবর তারা না ফেলে দিয়ে তাদের নিজস্ব মাছের খামার ও সবজি চাষে ব্যবহার করে থাকেন। অতিরিক্ত গোবরগুলো প্রক্রিয়াধীন করে জৈব সার তৈরি করে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন।
নাবিল এগ্রো ফার্মে সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে গরুগুলো পরিচর্যায় ব্যস্ত খামারে কর্মরত শ্রমিকরা। কেউ গরুকে ঘাস খাওয়াতে ব্যস্ত কেউ বা আবার গরুর দুধ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কয়েকজন গরুগুলোর পরম যতেœ পরিচর্যায় ব্যস্ত। নাবিল এগ্রো ডেইরি ফার্মে বর্তমানে ৩০ জন শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। শ্রমিকদের পরিবারদের জন্য সেখানেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা।
খামারটিতে দুগ্ধবতী ১শ’ গাভী রয়েছে যা ঢাকাসহ সারাদেশের দুধের চাহিদা মেটাতে অন্যতম অবদান রাখছে। ২৫০টি ষাড় গরু রয়েছে যা আসছে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে লালন-পালন করা হচ্ছে। এ ছাড়া খামারটিতে বিভিন্ন জাতের গরু রয়েছে, দেশি, ওল বাড়ির বলদ, শিবভী, রাজস্থানি, কংকরাজ, ঘির, ফ্রিজিয়ান, নেপালি, হরিয়ানা, দেশাল, পারনা ষাড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির গরু। বর্তমানে নিম্ন ১ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৭ লাখ টাকা মূল্যের ষাড় ও বলদ গরু রয়েছে।
প্রতি বছর পবিত্র ঈদুল আযহার সময় স্বাস্থ্যসম্মত গরুর চাহিদা মেটানোর জন্য গরুগুলোকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। ঈদুল আযহায় দেশীয় গরু দিয়ে গরুর চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে আনতে হয়। পাইকাররা বেশি লাভের আশায় ভারত থেকে গরু এনে বিশেষ ধরনের ইনজেকশন দিয়ে গরুকে মোটাতাজাকরণ করে বিক্রি করে থাকে। এতে করে ক্রেতারা প্রতারিত হয়। কোরবানির ঈদে যাতে করে ক্রেতাদের প্রতারিত না হতে হয় এ কারণেই তারা সুষম খাদ্য দিয়ে গরু পালন করছে।
এসব দুগ্ধ খামারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি সচল করছে। এ খামারে গরুর সুষম খাদ্যের চাহিদা মেটাতে ১০ বিঘা জমির ওপর সবুজ ঘাসের চাষ হচ্ছে। যাতে করে গরুর সুষম খাদ্য চাহিদা মেটানো যায়। অনেক সময় দেখা যায়, সুষম খাদ্যের অভাবে গরুর নানা রকম রোগ বালাই দেখা দেয়। তাই গরুকে সুষম খাদ্য দেয়ার ব্যাপারে তারা আপোস করে না। এ খামারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ৩০টি পরিবারের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। এ খামারে কাজ করে ৩০টি পরিবার সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করছে। এ খামারের প্রতিটি শ্রমিকের বেতন ১০-১৫ হাজার টাকা।
ফার্মের মালিক শিল্পপতি আলহাজ নাঈম ভূঁইয়া জানান, এ ফার্ম থেকে উৎপাদিত দুধ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। এতে করে স্থানীয় এলাকাসহ দেশে দুধের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রাচীনকাল থেকে দুধ পুষ্টির অন্যতম খাদ্য হিসেবে পরিচিত। নাবিল গরু পালনে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখার কারণে এ ফার্মের সুনাম অল্প সময়েই দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার জাহাঙ্গীর রতন বলেন, এ ফার্মটি আমি নিজে তদারকি করি। নিয়মিত ভ্যাকসিন থেকে শুরু করে সব ধরনরে স্বাস্থ্যসম্মত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গেজেটভুক্ত সমাজসেবক আলহাজ লায়ন মোজাম্মেল হক ভূঁইয়া বলেন, নাঈম ভূঁইয়ার এ ধরনের সফল উদ্যোগ দেখে অনেকেই ফার্ম করার পরিকল্পনা নিচ্ছেন।
খামারের এক শ্রমিক জানান, খামারের কাজ করে তিনি এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারছেন। ফিরেছে তাদের পরিবারে সচ্ছলতা। তাদের সন্তানদের স্কুলে লেখাপড়া করাতে পারছেন। স্থানীয় এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীক) বলেন, ফার্মের এ ধরনের কর্মকাণ্ড সরকারেরই একটি অংশ। সরকারের পক্ষ থেকে ফার্মের জন্য যত সহযোগিতা করা দরকার সব কিছুই করা হবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ