কৃষক উদ্যোক্তাদের মত বিনিময়

292

download (1)

শুধু উদ্ভাবনী চেষ্টার গুণে কৃষকদের নিয়ে গঠিত একটি ব্যতিক্রমী সমিতি যে বহু দূর এগিয়ে যেতে পারে, তার প্রমাণ হোমনা কমিউনিটি কৃষক ক্লাব। মাত্র চার বছর বয়স হয়েছে সংগঠনটির। এরই মধ্যে পুরো উপজেলায় প্রভাব পড়েছে এটির কর্মকাণ্ডের।

হোমনা কৃষক ক্লাব বোরো ধানসহ নানান সবজির মানসম্মত বীজ উৎপাদন করে এবং সেগুলো বাজারজাত করে। দেশের কৃষকদের ছোট ছোট আকারে সংগঠন তৈরি করে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের মডেল হয়ে উঠেছে হোমনার এই ক্লাব। ১৮টি কৃষক পরিবার এখন এ সমিতির সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এরই মধ্যে এটির বীজ উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় তিন গুণ হয়ে গেছে। এটির উৎপাদিত ‘হোমনা মডেল বীজ’ এখন একনামে এলাকায় পরিচিত। এই বীজ হোমনা উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। এ বছর পুরো উপজেলার চাহিদার ২৫ ভাগ মেটাচ্ছে হোমনা মডেল বীজ। আগামী বছর উপজেলার ৫০ ভাগ চাহিদা মেটাতে প্রস্তুত হচ্ছেন কৃষকেরা।

হোমনার এই ব্যতিক্রমী ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন হোমনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জুলফিকার আলী। ২০১৩ সালে তিনি প্রকৃত কৃষকদের নিয়ে এটি গঠন করেন। কৃষকেরা এখানে নানান বিষয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। সমস্যা সমাধানের উপায় খোঁজেন। প্রথমে মাত্র ছয়জন কৃষক নিয়ে গঠিত হয় এই ক্লাব। এখন বীজ উৎপাদনকারী কৃষকের সংখ্যা ১৮।

কৃষকদের স্বার্থে কৃষকেরা
হোমনা উপজেলার কয়েকজন কৃষক আগে বোরো ধানের বীজ উৎপাদন করে খোলাবাজারে বিক্রি করে সামান্য মুনাফা লাভ করতেন। বিভিন্ন কোম্পানির লোকজন কৃষকদের কাছ থেকে কম মূল্যে কিনে সেগুলোই প্যাকেটজাত করে চড়া মূল্যে আবার কৃষকদের কাছে বিক্রি করতেন। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে কৃষকদের সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা করেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জুলফিকার আলী। সংগঠিত কৃষকেরা এখন খোলা বীজ না বিক্রি করে মানসম্মত বীজ প্যাকেটজাত করে বিক্রি করছেন। এতে কৃষকের লাভের পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। তবে শুধু মুনাফা নয়, বোরো চাষিদের সহজে মানসম্মত বীজ সরবরাহ করাই এই ক্লাবের লক্ষ্য।

কৃষি কর্মকর্তা মো. জুলফিকার আলী বলেন, ‘কৃষকেরা কঠোর পরিশ্রম করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন। কৃষকের উৎপাদনে কৃষকেরাই যেন প্রকৃত ও ন্যায্য মুনাফা পান, এমন ধারণা থেকেই কমিউনিটি কৃষক ক্লাব গঠন করা হয়েছে।’
ক্লাব প্রতিষ্ঠার প্রথম বছর সাড়ে ছয় মেট্রিক টন বোরো বীজ উৎপাদন করা হয়। চার বছরের ব্যবধানে তা ২৫ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। এসবের মধ্যে ব্রি-২৯, ব্রি-৫৮, ব্রি-২৮, ব্রি-৬৭, ব্রি-৬১, বি আর-৩ ধান রয়েছে।

উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্যাকেজিং ও বিপণন
কৃষকের সংখ্যা যা-ই হোক, তাঁদের বীজ ‘হোমনা মডেল বীজ’ নামেই প্যাকেটজাত হয়ে বিপণন করা হচ্ছে। এ বছর ৫০ মেট্রিক টন বীজ উৎপাদন করতে চায় এই ক্লাব। এটিকে কৃষক পর্যায়ে বীজ উৎপাদনের বিপ্লব বলে মনে করছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

বীজ উৎপাদনকারী কোনো বোরো ধানের জমিতেই কোনো কীটনাশক ব্যবহার করেন না কৃষকেরা। ধানের পোকা তাড়াতে প্রতিটি জমিতে গাছের ডাল পুঁতে দেওয়া হয়। আর সেই ডালে উপকারী পাখিরা বসে ধানের জমিতে আসা পোকা খেয়ে ফেলে। কখনো কোনো সমস্যা হলে কৃষকেরা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা সমাধানের চেষ্টা চালান। তা ছাড়া সব রকম সহায়তা ও পরামর্শের জন্য কৃষি কর্মকর্তারা হাতের নাগালেই থাকেন।

ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন বিষয়ে আমরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। একজন অন্যজনের সঙ্গে সমস্যার কথা বলতে পারছি, আবার সেই সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যাবে, তা-ও জানা যাচ্ছে।’

ধান কাটার সময় অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। ধান কাটার দিনই গাছ থেকে ধান আলাদা করে ফেলেন কৃষকেরা। কারণ, কাটার পর ২৪ ঘণ্টা গাছের সঙ্গে ধান থাকলে তা বীজ হওয়ার গুণ ও মান হারিয়ে ফেলে। প্যাকেটজাত করার আগে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে সরকারি বীজ উইংয়ে বোরো ধানের বীজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় এ পরীক্ষা হয়ে থাকে। বীজ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মান ঘোষিত হলেই প্যাকেটজাত করার অনুমতি মেলে। বিপণনের মৌসুম শুরুর এক মাস আগে বীজ প্যাকেটজাত করা হয়।

সক্রিয় নারী কৃষকেরা
হোমনার কমিউনিটি কৃষক ক্লাবের সদস্যদের অন্তত ৫০ ভাগই নারী সদস্য। বীজের উৎপাদন, সংরক্ষণ থেকে শুরু করে প্রায় সব অংশেই নারীর অংশগ্রহণ পুরুষদের চেয়ে বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধানের চাষ, পরিচর্চা নারী কৃষকেরা করে থাকেন। আর সংরক্ষণের কাজটুকু বেশির ভাগই করেন নারীরা। তা ছাড়া ধান শুকানো, ড্রামে বা বস্তায় ভরে ছয়-সাত মাস বাড়িতে সংরক্ষণ এককভাবে নারীদের কাজ।

উপজেলার কাশিপুর গ্রামের কৃষক হাসেনা বেগম সবজির বীজের পাশাপাশি বোরো ধানের বীজও উৎপাদন করেন। তিনিই সম্ভবত দেশের প্রথম নারী কৃষক, যিনি কৃষিকাজের পাশাপাশি বোরো ধানের বীজ উৎপাদনকারী। একই গ্রামের কৃষক ফিরোজ মিয়ার মেয়ে শাহিনুর আক্তারও বোরো ধানের বীজ উৎপাদনে ভূমিকা পালন করছেন। তিনি ধান কাটা বাদে বীজতলা, রোপণ, সংরক্ষণ ও প্যাকেজিংয়ের কাজটুকু ভালোভাবেই করে থাকেন।

শাহিনুর আক্তার বলেন, ‘আমার বিয়ের কিছুদিন পর বিয়ে ভেঙে গেলে আমি আর বিয়েতে রাজি হইনি। আমার বড় কোনো ভাই নেই। বাবা বয়স্ক মানুষ, তিনিই কৃষিকাজ করছেন। আমি সব কাজে তাঁকে সাহায্য করি। ছোট ভাই লেখাপড়া করছে আমাদের আয়ে।’

সদস্যদের চাঁদায় তহবিল
সমিতির সদস্যদের চাঁদায় ক্লাবের একটি তহবিল গঠন করা হচ্ছে, যা থেকে সদস্যরা সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে কৃষিকাজ করতে পারছেন। প্রতি সপ্তাহে প্রত্যেক সদস্যের ১০০ টাকা করে চাঁদায় তহবিল দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকার। এ থেকে ঋণ নিলে এক হাজার টাকায় এক বছরে সুদ মাত্র ১৫০ টাকা।

মো. জুলফিকার আলী জানান, তহবিলের পরিধি বেড়েই চলেছে। এই টাকা থেকে কৃষকেরা কৃষিকাজের নানান প্রয়োজনে সহজ শর্তে ঋণ নিতে পারেন।
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক দিলীপ কুমার অধিকারী বলেন, বাংলাদেশের অন্য কোনো অঞ্চলে কৃষক পর্যায়ে উন্নত মানের বীজ উৎপাদনের কোনো নজির নেই। হোমনার কৃষকের এত উন্নত মানের বীজ উৎপাদন সত্যিই বিস্ময়ের ঘটনা। এটা দেশে অনন্য নজির।

কৃষক লাল মিয়া বলেন, ‘হোমনা কমিউনিটি কৃষক ক্লাব একটি বন্ধন। সরকার প্রশিক্ষণ ও আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করলে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারব।’
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ