হুমকির মুখে পোলট্রি খাত

1136

মুরগি

পোলট্রি নিয়ে অনেকেই স্বপ্ন দেখে। তাই বড় স্বপ্ন নিয়ে পোলট্রি খামার শুরু করেছিলেন গাজীপুরের আব্দুর রউফ স্বপন। কয়েক বছরের মধ্যে লাভের মুখও দেখতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু ফিডের অতিরিক্ত দাম, মুরগির নানা অসুখ-বিসুখে প্রয়োজনীয় প্রতিষেধকের অভাব, বড় উৎপাদনকারীদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন কারণে থমকে যায় তার স্বপ্ন। গত বছর যখন ক্রমাগত লোকসানে তিনি খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন, তখনো তার খামারে মুরগির সংখ্যা ছিল ১৫ হাজারের বেশি।

অনেক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারি খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক ক্ষুদ্র খামারি কমিয়ে আনছেন মুরগির সংখ্যা। আবার যারা বৃহত্ আকারে পোলট্রি খাদ্যের কারখানা করেছেন, করেছেন বড়ো খামার, নানা ধরনের কর ও ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে তারাও এর বিকাশ ঘটাতে পারছেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণে যে খাতটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, সেই পোলট্রি খাত নিজেই অপুষ্টিতে ভুগছে। পার করছে নানা সংকট। এক দশক আগে দেশে পোলট্রি খামারের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। বর্তমানে তা নেমে এসেছে প্রায় ৬৫ হাজারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব সংকটে এই খাতের বিনিয়োগও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অথচ এই খাতে বিনিয়োগ রয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কর্মসংস্থান ৬০ লাখ মানুষের, যার ৪০ শতাংশই নারী।

আন্তর্জাতিক কৃষি ও খাদ্য সংস্থার মতে, একজন সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের বছরে গড়ে ১০৪টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দেশে বছরে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডিম খান ৫০ থেকে ৬০টি। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন প্রায় তিন কোটি ডিম উত্পাদিত হয়। এই হিসাবে বছরে ১০৪টি ডিম খেতে হলে আমাদের আরো দেড় কোটি ডিম উত্পাদন করতে হবে।

তথ্যমতে, উন্নত বিশ্বের মানুষ বছরে ৪০ থেকে ৫০ কেজি মুরগির মাংস খায়। অথচ আমাদের দেশে এর পরিমাণ মাত্র ৬ দশমিক ৩ কেজি। এই হিসাবে পোলট্রি মাংসের উত্পাদন বাড়ানোর ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।

পোলট্রি খাবার, ওষুধসহ খামারের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ কারণে ডিমের উত্পাদন খরচ অনেক বেশি পড়ছে। আবার অনেক সময় মানহীন ফিড ও ভ্যাকসিনের কারণে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশের বেশি উত্পাদন পাওয়া যায় না। জলিল নামে এক খামারি বলেন, উত্পাদন যদি ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পাওয়া যেত, তাহলে খামারির যেমন লাভ হতো, তেমনি ভোক্তারা আরো কম দামে ডিম ও মুরগি পেত।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে পোলট্রি ফিডের কাঁচামালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে কাঁচামাল আমদানিতে আগাম কর আরোপের ফলে নতুন করে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে ফিডের দামের ওপর।

পোলট্রিশিল্পের উদ্যোক্তারা বলেছেন, পোলট্রিশিল্পের দাবি অন্তত ২০৩০ সাল পর্যন্ত এই খাতকে কর অব্যাহতি প্রদান করা। কিন্তু বাস্তবে সেই দাবি তো পূরণ হয়নি। উপরন্তু ২০১৫-১৬-পরবর্তী বছরগুলোয় করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। তারা বলেন, ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে এ বছরের বাজেটে আগাম কর যুক্ত করা হয়েছে এবং স্থানীয় কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে উেস কর আরোপ করা হয়েছে। কৃষি খাতে প্রান্তিক কৃষকদের প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকলেও পোলট্রি খামারিদের কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই।

ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (ফিআব) সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান বলেন, পোলট্রি ফিড তৈরির কাঁচামালগুলো মূলত আমদানিনির্ভর। মোট চাহিদার মাত্র ৫০ ভাগ ভুট্টা দেশে উত্পাদিত হয়। সয়াবিন উত্পাদন হয় না বললেই চলে। তবে সয়াবিন তেল উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রায় ৫০ ভাগ সয়াবিন মিলের চাহিদা মেটে। অবশিষ্ট উপকরণগুলোর সবই আমদানি করতে হয়।

তিনি বলেন, বিশ্বের বড়ো বড়ো দেশে ফিড তৈরিতে যেখানে খামারিদের ভর্তুকি দেওয়া হয়, সেখানে ফিড তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে আমাদের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আরোপ করা হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিরা।

প্রতি মুরগিতে খামারির লোকসান ১০ টাকা :বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। খামারিরা জানিয়েছেন, দেড় কেজি মুরগির খাবারের প্রয়োজন হয় আড়াই কেজি। প্রতি কেজি খাবারের দাম ৪৪ টাকা। এই হিসাবে একটি মুরগির জন্য খাবার লাগে ১১০ টাকার। মুরগির বাচ্চা কিনতে হয় ২০ থেকে ২৪ টাকায়। শ্রমিক ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য খরচ ১৫ টাকা। সব মিলিয়ে খরচ ১৪৫ টাকা। খামারি প্রতি কেজি মুরগি বিক্রি করে ৯০ টাকা। এ হিসাবে দেড় কেজির মুরগির দাম ১৩৫ টাকা। প্রতি মুরগিতে খামারির লোকসান ১০ টাকা। বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মোহসীন বলেন, লোকসানের এই অবস্থা চলতে থাকলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিরা পথে বসতে বাধ্য হবে।

বর্তমানে দেশে পোলট্রি শিল্পে সাতটি বিদেশি কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে পাঁচটি ভারতের, একটি থাইল্যান্ডের ও একটি চীনের। এদের সঙ্গে এক অসম প্রতিযোগিতা গড়ে উঠেছে দেশি খামারগুলোর। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশি খামারগুলো বিদেশ থেকে ৩ থেকে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করলেও দেশীয় খামারগুলোকে ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। ফলে দেশি খামারগুলো টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোটো খামারগুলো।

বর্তমানে কৃষিখাতে মসলা ফসল চাষের জন্য ৪ শতাংশ সুদে, দুগ্ধ খামার গড়ে তোলার জন্য পশু কিনতে ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পোলট্রি খাতে ব্যাংকঋণের সুদের হার ১২ থেকে ১৩ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা ঋণের সুদের ক্ষেত্রে এ বৈষম্য দূর করার দাবি জানান।

সূত্র জানায়, দেশে ডিম ও মাংসের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। ২০২১ সাল নাগাদ এই চাহিদা পূরণে নতুন করে আরো ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কারণে এ শিল্প বড়ো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে।

বাজারে প্লাস্টিকের ডিম পাওয়া যাচ্ছে—এমন গুজব ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে ডিম খাওয়া থেকে বিরত রাখা হচ্ছে। এতে মানুষ একদিকে যেমন পুষ্টি চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্যদিকে খামারিরাও ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ