বাংলাদেশে ভেটকি চাষে সম্ভাবনা ও সমস্যা

1556

Koral
ভেটকি মাছ পুষ্টি, স্বাদ ও উচ্চমূল্যের জন্য মাছ চাষিদের কাছে আকর্ষণীয়। আনুমানিক ৪০ বছর আগে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, অস্ট্রেলিয়া ও তাইওয়ানের উপকূলীয় অঞ্চলে এবং স্বাদুপানির পুকুরে, নদীতে ও নদীর মোহনায় ভেটকির চাষাবাদ খাঁচার মাধ্যমে শুরু হয়। বাংলাদেশে সাধারণ বেড়জাল, ফাঁদজাল ও তলদেশে ট্রলনেট ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন এলাকার চট্টগ্রাম, বরিশাল,খুলনা, পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে নদীর মোহনায় নদীতে এবং চিংড়ির ঘেরে ভেটকি পাওয়া যায়।

এ মাছে উন্নতমানের আমিষ ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড থাকে। এটা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ভেটকিতে ভিটামিন এ, বি এবং ডি, খনিজ পদার্থ ক্যালসিয়াম, জিংক, লৌহ, পটাসিয়াম, ম্যাগনিসিয়াম এবং সিলেনিয়াম যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। এগুলো শরীর গঠন ও বৃদ্ধির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভেটকির প্রজনন ক্ষমতা বেশি, এরা বছরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ ডিম দেয়।

এরা দ্রুত চলাচল করে এবং বেশি লবণাক্ততা সহিষ্ণু প্রজাতির মাছ, ভেটকি মাছের স্বাদ তো আছেই আবার কাঁটা কম থাকায় দেশে-বিদেশে এর চাহিদা প্রচুর উপকূলীয় অঞ্চলে ভেটকি চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে স্বাদুপানি এবং উপকূলীয় অঞ্চলের আধা-লবণাক্ত ও লবণাক্ত পানিতে ভেটকি চাষ করা যায় বলে বাংলাদেশে এর চাষাবাদ এলাকা অনেক বড়। আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের নদনদীতে ভেটকি চাষের পরিবেশ রয়েছে। আবার দেশে এবং বাইরে এ মাছের প্রচুর চাহিদা থাকায় ভেটকি মাছ উৎপাদন ও রফতানির সুযোগ বেড়েই যাচ্ছে।

ভেটকি চাষের কতগুলো অসাধারণ সুবিধার মধ্যে রয়েছে : লবণাক্ততা সহিষ্ণু হওয়ায় নদী, নদীর মোহনা এবং উপকূলীয় এলাকার জলাভূমিতে সহজে চাষ করা যায়। সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং এদের বেশি ঘনত্বে চাষ করা যায়। ভেটকির বৃদ্ধির হার বেশি এবং প্রতি ৬ মাস থেকে ২ বছরের মধ্যে এদের প্রতিটির ওজন ৩৫০ গ্রাম থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত হয়।

প্রজনন ক্ষমতা বেশি হওয়ায় মাঝারি আকৃতির একটি হ্যাচারি পরিচালনার জন্য কমসংখ্যক ব্রুড মাছই যথেষ্ট। উল্লেখ্য ব্রুভ মাছ হচ্ছে প্রজনন কাজে ব্যবহৃত বয়োপ্রাপ্ত স্ত্রী ও পুরুষ মাছ। ভেটকির পোনা ও প্রাপ্ত বয়স্ক মাছগুলো সহজে বিভিন্ন ধরনের তৈরি খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাছাড়া দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ভেটকির মূল্য বেশি হওয়ায় এই মাছ চাষ অধিক লাভজনক। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে ৭০০ থেকে ১২০০ গ্রাম ফজনের ভেটকির চাহিদা বেশি।

ভেটকি সারা বছর ডিম দিয়ে থাকে। তবে এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস এদের মূল প্রজননকাল হিসেবে বিবেচিত। এ সময় এক সেন্টিমিটার আকারের অনেক পোনা ধরা পড়ে। বর্ষার শুরুতে পুরুষ ভেটকি স্ত্রী ভেটকির সঙ্গে মিলেনের জন্য নদ-নদীর নিন্ম অববাহিকায় আসে। ভরা পূর্ণিমা এবং অসাবস্যার শুরুতে জোয়ারের পানি আসার সময় ৫ থেকে ১০ কেজি ওজনের প্রতিটি স্ত্রী ভেটকি ২১ লাখ থেকে ৭১ লাখ পর্যন্ত ডিম পাড়ে।

তারপর জোয়ারের পানিতে ভেসে ডিম এবং রেণু পোনা নদীর মোহনায় চলে আসে। রেণু পোনা মোহনা হতে নদীর উচ্চ অববাহিকার দিকে আসে। পরে পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় ডিম পাড়ার জন্য আবার সাগরের দিকে ফিরে যায়। এই মাছের একটা অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো বেশির ভাগ মাছ প্রুুষ মাছ হিসেবে প্রাপ্ত বয়স্ক হলেও স্ত্রী মাছের প্রাপ্যতা কম হলে একটি প্রজনন ঋতুর পর তারা লিঙ্গ পরিবর্তন করে স্ত্রী মাছ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

ভেটকির পোনা প্রাকৃতিক উৎস সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল এবং নদীর মোহনায় সংগ্রহ করা গেলেও বছরের বিভিন্ন সময় এর একই পরিমাণ পাওয়া যায় না। তাই ভেটকি চাষাবাদ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তা ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে পোনা কম পাওয়া গেলে এ মাছের চাষ ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। এ প্রেক্ষিতে কৃত্রিমভাবে পোনা উৎপাদন একান্ত জরুরি। থাইল্যান্ডে ১৯৭১ সালে ভেটকি মাছের কৃত্রিম প্রজনন শুরু হয়। তারপর ১৯৭৩ সালে বদ্ধ পরিবেশে হরমোন ব্যবহারের মাধ্যমে এ মাছের কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য অর্জিত হয়। ১৯৮১ সালে বিজ্ঞানী Kunguankij কৃত্রিমভাবে পোনা উৎপাদনে সফল হন।

সংক্ষেপে বলা যায় ভেটকি মাছের কৃত্রিম প্রজনন প্রধানত দুভাগে সম্পন্ন করা যায়। একটা হচ্ছে হরমোন ব্যবহার করে এবং দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে পরিবেশের নিয়ামক পরিবর্তনের মাধ্যমে।

ভেটকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই মৃদু ঘোলা পানি, স্বাদুপানি এবং সমুদ্রের পানিতে খাঁচায়ও চাষ করা হচ্ছে। ভেটকি মাংসাশী হওয়ায় সকালে এবং বিকালে কম দামি মাছ ট্রাস ফিশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে স্বভোজী স্বভাবের জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে মৃত্যুহার বেড়ে যায়। সে কারণে ছোট বড় মাছ আলাদা করে ভেটকি চাষ করা বাঞ্ছনীয়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় ২০ বছরের বেশি সময় ধরে পুকুরে ভেটকি চাষ হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে পুকুরে বিশেষ লবণাক্ত পানিতে ভেটকি চাষ শুরু হয়ে গেছে। পুকুরে ৬ মাসে প্রতিটি ভেটকি গড়ে ৩৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। তবে চাষ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৬ টন মাছ উৎপাদন সম্ভব এবং বিনিয়োগের দেড় থেকে দুইগুণ লাভ করা যায়।

ভেটকি পুকুরে দুইভাবে চাষ করা যায় :
একক চাষ পদ্ধতিতে এবং মিশ্র চাষ পদ্ধতিতে। প্রথম ক্ষেত্রে চাষ সম্পূর্ণভাবে সম্পূরক খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকে এবং সম্পূরক খাদ্য তাজা মাছের মূল্য বেশি হওয়ায় মুনাফা অনেক কম হওয়ার আশংকা এক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়। তবে মিশ্রচাষ পদ্ধতিতে ভেটকি মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যায়, এমন দ্রুতবর্ধনশীল ও প্রজননক্ষম মাছ চাষ করে সফলতা অর্জন করা যায়। ভেটকির সঙ্গে খাদ্যের প্রতিযোগিতা করে এমন মাছ হলে চলবে না। তবে তেলাপিয়া এবং নাইলোটিকা মিশ্রচাষের ক্ষেত্রে নির্বাচিত করা যেতে পারে।

ভেটকি চাষে সমস্যার মধ্যে রয়েছে :
প্রাকৃতিক উৎসে পোনার স্বল্পতা এবং এই মাছের কৃত্রিম প্রজননে সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা, রাক্ষুসে এবং স্বজাতিভোজী বৈশিষ্ট্যের কারণে ভেটকি চাষের ক্ষেত্রে মৃত্যুহারের আধিক্য। তা ছাড়া রয়েছে ট্রাস ফিশ সরবরাহের সমস্যা এবং তা ব্যয়বহুলও বটে।

তবে কোনো কোনো দেশ ভেটকি চাষে সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ইতোমধ্যে সাফল্য অর্জন করেছে। যেমন- থাইল্যান্ডে হ্যাচারিতে উৎপাদিত ভেটকির পোনার মান প্রাকৃতিক উৎসে উৎপাদিত পোনার সমতুল্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ভেটকি চাষের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে। তবে আমরা এখনও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনে কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। এ ব্যাপারে দুইবছর আগেও গবেষণা হয়েছে। তারপর গত দুই বছর ধরে নিয়মিত গবেষণা চলছে। তাছাড়া লবণাক্ত পানির স্বল্পতাও রয়েছে। ভেটকি মাছের প্রজনন এবং দ্রুত বৃদ্ধির জন্য লবণাক্ত পানি অত্যাবশ্যক। এ মাছের খাদ্যের সমস্যা যে থাকবেই না সেটাও এখনো নিশ্চিত করে বলার মতো সময় বোধ হয় হয়নি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৎস্য বিজ্ঞানীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। সেখানে এ ব্যাপারে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে।

পরিশেষে আশা করব : থাইল্যান্ডের মতো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা ও অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ভেটকির কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে এবং ট্রাস ফিশের পরিবর্তে তৈরি খাবার পদ্ধতিও উদ্ভাবন হবে। উল্লেখ্য, থাইল্যান্ডের মৎস্য বিজ্ঞানীরা হ্যাচারিতে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে চার দশক আগেই সাফল্য অর্জন করেছেন। তাদের উৎপাদিত পোনার মান প্রাকৃতিক উৎসের পোনার মানের সমতুল্য বলেও প্রমাণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে সফল হতে পারলে ভেটকি চাষে আমাদেরও অসাধারণ উন্নতি হতে পারে। কারণ বাংলাদেশের মাঠপর্যায়ে ভেটকি চাষের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/৭ফেব্রু২০২০