গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

1141

86723715_1374815569358081_402049114029686784_n
সাম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন জায়গা গরু এলএসডি আক্রন্ত হয়‌েছে । যশোর , গোপালগঞ্জ , শর‌িয়তপুর সহ একাধিক জেলায় ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়‌েছে। এল এস ডি গরুর জন্য একটা ভয়ংকর ভাইরাস বাহিত চর্মরোগ যা খামারের ক্ষতির কারণ। এই রোগের গড় মৃত্যুহার আফ্রিকাতে ৪০%।

মূলত আফ্রিকায় একাধিকবার মহামারী আকারে দেখা গেলেও আমাদের দেশে গরুতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব কখনো মহামারী আকারে দেখা যায় নাই। একটা খামারকে অর্থনৈতিক ভাবে ধসিয়ে দেয়ার জন্য এফ এম ডি বা খুরারোগের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর রোগ হিসাবে ধরা হয়। ১৯২৯ সালে আফ্রিকার ‘জাম্বিয়া’ প্রথম অফিসিয়ালি সনাক্ত হওয়া এই রোগ ১৯৪৩ সল্ থেকে ৪৫ সালের মধ্যে মহাদেশের বিস্তীর্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

এই সময়ের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, মোজাম্বিক শোঃ পার্শ্ববর্তী দেশ গুলোতে হাজার হাজার গরু আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং শত শত খামার বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে সত্তর এবং আশির দশকে আফ্রিকার প্রায় সব দেশের গরু এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং হাজার হাজার খামার বন্ধ হয়ে যায় অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

রোগের কারণ : মূলত এক প্রকার পক্স ভাইরাস বা এল এস ডি ভাইরাসের সংক্রমণে গবাদিপশুতে এই রোগ দেখা দেয় এবং এক গরু থেকে আরেক গরুতে ছড়িয়ে পড়ে।

রোগের সময় : প্রধানত বর্ষার শেষে, শরতের শুরুতে অথবা বসন্তের শুরুতে যে সময়ে মশা মাছি অধিক বংশবিস্তার সেই সময়ে প্রাণঘাতী এই রোগটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।

রোগের লক্ষণ : এল এস ডি আক্রান্ত গরু শুরু থেকে যে লক্ষণ প্রকাশ করে যা আক্রান্তের শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে দেখা যায় :

১. জ্বর : আক্রান্ত গরু প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং খাবার রুচি কমে যায়।

২. লালাক্ষরণ : জ্বরের সাথে সাথে মুখ দিয়ে এবং নাক দিয়ে লালা বের হয়।পা ফুলে যায়। সামনের দু “পায়‌ের মাঝ স্থান পান‌ি জমে যায়।

৩. শরীরের বিভিন্ন জায়গা চামড়া পিন্ড আকৃতি ধারণ করে, লোম উঠে যায় এবং ক্ষত সৃষ্ট হয়। ধারাবাহিকভাবে এই ক্ষত শরীরের অন্যান্য জায়গা ছড়িয়ে পড়ে।

৪. ক্ষত মুখের মধ্যে , পায়ে এবং অন্যান্য জায়গা ছড়িয়ে পড়তে পারে।

৫. ক্ষত স্থান থেকে রক্তপাত হতে পারে। শরীর‌ে ক‌োথায় ফুল‌ে যায় যা ফেট‌ে টুকরা মাংশের মত ব‌ের হয়‌ে ক্ষত হয় , পুঁজ কষান‌ি বের হয়।

৬. পাকস্থলী অথবা মুখের ভিতরে সৃষ্ট ক্ষতের কারণে গরু পানি পানে অনীহা প্রকাশ করে এবং খাদ্য গ্রহণ কমে যায়।

কিভাবে ছড়ায় : লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত গরু থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে রোগটি অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগ এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ার প্রধান মাধ্যম গুলো হচ্ছে :

১. মশা ও মাছি : এই রোগের ভাইরাসের প্রধান বাহক হিসাবে মশা মাছিকে দায়ী করা হয়। অন্যান্য কিট পতঙ্গের মাধ্যমেও ভাইরাসটি আক্রান্ত গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

২. লালা : আক্রান্ত গরুর লালা খাবারের মাধ্যমে অথবা খামারে কাজ করা মানুষের কাপড়ের মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়াতে পারে।

৩. দুধ : যেহেতু আক্রান্ত গভীর দুধে এই ভাইরাস বিদ্যমান থাকে তাই আক্রান্ত গভীর দুধ খেয়ে বাছুর দুধ খেয়ে আক্রান্ত হতে পারে।

৪. সিরিঞ্জ : আক্রান্ত গরুতে ব্যবহার করা সিরিঞ্জ থেকে এই ভাইরাস বাহিত হতে পারে।

৫. রক্ষণাবেক্ষণকারী : খামারে কাজ করা মানুষের পোশাকের মাধ্যমে আক্রান্ত গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

৬. আক্রান্ত গরুর সিমেন : ভাইরাস আক্রান্ত ষাঁড়ের সিমেন এই রোগের অন্যতম বাহন কারণ আক্রান্ত গরুর সিমেনেও এই ভাইরাস বিদ্যমান থাকে।
৭. শুধু মাত্র গরু মহিষ আক্রান্ত হয়, মানুষ হয় না।

প্রতিকার : যেকোন রোগের চিকিতসার চেয়ে প্রতিকার সব সময় অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।

১. আক্রান্ত গরুকে নিয়মিত এল এস ডি ভ্যাকসিন দেয়া। আমাদের দেশে ইতিপূর্বে রোগটির প্রাদুর্ভাব কম দেখা গেছে তাই এই রোগের ভ্যাকসিন সহজলভ্য নয়।

২. খামারের ভিতরের এবং আসে পাশের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যেন মশা মাছির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

৩. আক্রান্ত খামারে যাতায়ত বন্ধ করা এবং আক্রান্ত খামার থেকে আনা কোন সামগ্রী ব্যবহার না করা।

৪. আক্রান্ত গরুকে শেড থেকে আলাদা স্থানে মশারি দিয়ে ঢেকে রাখা মশা মাছি কামড়াতে না পারে। কারণ আক্রান্ত গরুকে কামড়ানো মশা মাছি সুষ্ঠ গরুকে কামড়ালে এই রোগের সংকরণ হতে পারে।

৫. আক্রান্ত গভীর দুধ বাছুরকে খেতে না দিয়ে ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দেয়া।

৬. আক্রান্ত গরুর পরিচর্যা শেষে একই পোশাকে সুষ্ঠ গরুর মধ্যে প্রবেশ না করা।

৭. আক্রান্ত গরুর খাবার বা ব্যবহার্য কোনো জিনিস সুষ্ঠ গরুর কাছে না আনা।

৮. ক্ষত স্থান টিনচার আয়োডিন মিশ্রণ দিয়ে পরিষ্কার রাখা।

চিকিৎসা : এল এস ডি আক্রান্তের লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত চিকিতসার ব্যবস্থা করতে হবে।

তথ্যসূত্র :
১. জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা।
২. এম এস ডি এনিমেল হেলথ ম্যানুয়াল।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৮ফেব্রু২০২০