মাটি ছাড়াই সবজি চাষ সম্ভব। এবার পানি ছাড়াই ধান চাষ করলে কেমন হয়। অবাক হচ্ছেন! এটি আবার কীভাবে সম্ভব। হ্যাঁ, এটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। নামমাত্র পানি ব্যবহার করে বোরো ধান চাষের নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। আর এ প্রযুক্তিটি অ্যারোবিক বা শুকনো পদ্ধতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। দীর্ঘ ৫ বছর গবেষণার পর এমন একটি কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবনে সফল হয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি গবেষকরা।
ডিএই (এইসি)-ডানিডা এএসপিএসের অর্থায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মশিউর রহমানের সঙ্গে এ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণায় সহযোগিতা করেন পিএইচডি শিক্ষার্থী মেহেদী মাসুদ ও মাস্টার্স শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান। প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কাজ প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ গবেষণাগারে সফলভাবে শেষ করার পর দিনাজপুরের সুন্দরবন, রাজশাহীর বিজয়নগর, নেত্রকোনার নারান্দিয়া ও টাঙ্গাইলের নরকোনায় পরীক্ষামূলক মাঠপর্যায়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কৃষকরা এ পদ্ধতিতে আর্থিকভাবে লাভবান হবে বলে জানিয়েছেন।
এ পদ্ধতিতে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে সেচের পানি ৬০ শতাংশ কম লাগে। ফলনও প্রতি ধানের গোছায় বেশি হয়। বিদ্যুৎ সঙ্কটের এ সময় এ পদ্ধতি সারা দেশে সম্প্রসারণ করলে প্রতি বছর দেশের ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ডিজেল ও বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। জানা যায়, বোরো ধান চাষের জন্য ভূগর্ভ থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি উত্তোলনের প্রয়োজন হয়, যার জন্য বিপুল পরিমাণ বিদ্যুত্, ডিজেল বা জ্বালানি লাগে, সে কারণে বোরো মৌসুমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি বেড়ে যায়। তাছাড়া অনেক সময় বিপুল পরিমাণ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায় এবং ফসলহানি ঘটে থাকে। অন্যদিকে প্রচুর পানি উত্তোলনের ফলে অনেক সময় ভূমি দেবে যায়, মাটিতে লবণাক্ততা, আয়রন, আর্সেনিক দূষণ ইত্যাদি পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেচের জন্য সেচ সাশ্রয় করতে পারলে একদিকে বিদ্যুৎ, ডিজেল ইত্যাদি সাশ্রয় হবে এবং উৎপাদন খরচ কমে যাবে, অন্যদিকে পরিবেশগত সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে।
বোরো ধান চাষে সেচ সাশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বনের চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ম্যাজিক পাইপ পদ্ধতিটি ব্যাপকভাবে গ্রহণের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০ ভাগ সেচের পানি সাশ্রয় হয় বলে জানা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের গবেষণার মাধ্যমে অ্যারোবিক বা শুকনা পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ করলে কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ সেচের পানি সাশ্রয় হবে ও ধানের ফলন প্রচলিত বা এডব্লিুউডি পদ্ধতির সমান বা বেশি হবে।
এ পদ্ধতির জন্য ব্রিধান ২৯ সবচেয়ে ভালো। তবে বিনা ধান ৬, ব্রিধান ৪৭ ও ব্রিধান ২৮ জাতের চাষ করা যেতে পারে। ধানের বীজ প্রথমে ২৪-৩০ ঘণ্টা পানিতে ভিজানো হয় ও পরে ২৪-৩০ ঘণ্টা জাগ দিয়ে ধান বীজের মুখ ফাটা অবস্থা তৈরি করা হয়। আমন ধান কাটার পর জো অবস্থায় প্রয়োজন মতো চাষ ও মই দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে। জমিতে রস না থাকলে সেচ দিয়ে পরে জো অবস্থা তৈরি করতে হবে। হাতে অথবা যন্ত্রের সাহায্যে ২৫ সে.মি. দূরে দূরে লাইন এবং লাইনে ১৫ সে.মি. দূরে দূরে ৩-৫ সে.মি. গভীর গর্তে ও প্রতিগর্তে ৪-৬টি বীজ বপন করা হয়। জমির উর্বরতা ও ধানের জাতভেদে সারের মাত্রা নির্ধারিত হবে। গোবর, কম্পোস্ট, টিএসপি, এমপি, জিপসাম ও দস্তা সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ৪ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।
যন্ত্র/নিড়ানির মাধ্যমে আগাছা দমন করা যাবে। শুকনো পদ্ধতিতে আগাছার আক্রমণ রোধ করতে প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ২ বা ৩টি বেশি নিড়ানি দরকার হয়। নিড়ানি খরচ বেশি হলেও পানি ও চারা রোপণের খরচ কম লাগে বলে অধিক মুনাফা পাওয়া যাবে। চীন ও ভারতে বিভিন্ন আগাছা নাশক যেমন- বাই স্পাইরিকেব সোডিয়াম, ট্রাইফ্লুরালিন, পেনক্সসুলাম ইত্যাদি ব্যবহার করে কম খরচে সফলতার সঙ্গে শুকনো পদ্ধতির ধানের জমিতে আগাছা দমন করা হয়। বপনের পর জমিতে রস না থাকলে হালকা সেচ দিতে হবে। এরপর ৬০-৭০ দিন পর হতে প্রয়োজন মতো ৭-১০টি সেচ দিতে হবে। উল্লেখ্য, অ্যারোবিক পদ্ধতিতে বপন থেকে ৯০ দিন পর্যন্ত খুব অল্প পরিমাণ সেচ লাগে। থোড় আসার সময় থেকে বীজ পুষ্ট হওয়ার সময় পর্যন্ত জমিতে সামান্য পানি রাখা ভালো। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় এ পদ্ধতিতে পোকামাকড় ও রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ হলে আইপিএম অথবা আইসিএম পদ্ধতি অনুসরণ করে দমন করতে হবে। এ পদ্ধতিতে প্রচলিত বা এডব্লিউডির তুলনায় বীজ থেকে বীজ পর্যন্ত ১৫-২০ দিন কম সময় লাগে। প্রচলিত বা এডব্লিউডি পদ্ধতিতে ৩০ দিনের চারা রোপণের দিন থেকে ফসল কর্তন পর্যন্ত যে সময় লাগে শুকনো পদ্ধতিতে বীজ বপন থেকে ফসল কর্তন পর্যন্ত তার থেকে ১০-১৫ দিন বেশি সময় লাগে। অ্যারোবিক পদ্ধতিতে অবস্থাভেদে প্রচলিত বা এডব্লিউডি পদ্ধতির সমান অথবা কিছুটা বেশি ফলন পাওয়া যাবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৬মার্চ২০