রাসায়নিক সার সাশ্রয়ী বায়ো-অর্গানিক সার উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের বিজ্ঞানীরা। রাসায়নিক সার ব্যবহারে উৎপাদন বাড়লেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে মাটির উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস পায়। তাই কৃষি বিজ্ঞানীরা মাটির গুণাগুণ ঠিক রাখতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমানো ও জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন।
আদর্শ ও উর্বর মাটিতে শতকরা ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশের মাটিতে বর্তমানে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১ শতাংশ বা তারও কম। তাই মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ কিভাবে ২% বা তারও বেশি পর্যায়ে উন্নীত করা যায় এ ব্যাপারে বাস্তবসম্মত গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন ব্রির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের বিজ্ঞানীরা।
এ জন্য ইতিমধ্যে তারা গৃহস্থলীর আবর্জনা সংগ্রহ ও রিসাইক্লিং করে বায়ো-অর্গানিক সার ও কম্পোস্ট সার তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ কর্তৃক উদ্ভাবিত বায়ো-অর্গানিক ফার্টিলাইজার মাঠ পর্যায়ে দ্রুত সম্প্রসারণ ও উপযোগিতা যাচাইয়ের পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে এই সার সহজলভ্য করতে উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন ব্রির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের বিজ্ঞানীরা।
জানা গেছে, ব্রি নতুন উদ্ভাবিত এবং ধান চাষে ব্যবহারযোগ্য বায়ো-অর্গানিক ফার্টিলাইজার এরই মধ্যে মাঠপর্যায়ে আউশ, বোরো ও আমন মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আউশ মৌসুমে এ সার হেক্টরপ্রতি এক টন এবং বোরো ও আমন মৌসুমে দুই টন হারে ব্যবহার করা হয়।
ফলাফলে দেখা গেছে, এ সার ব্যবহার করলে ধানের জমিতে টিএসপি পূর্ণমাত্রায় ও ইউরিয়া শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ সাশ্রয় করা যায়। এটি ব্যবহার করলে ফলনেও কোনো তারতম্য হয় না। এই সার উদ্ভাবক দলের একজন অন্যতম বিজ্ঞানী ও মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. উম্মে আমিনুন নাহার জানান, পরিবেশবান্ধব ১০টি ব্যাকটেরিয়া, বাজারের কাঁচা শাক সবজির অবশিষ্টাংশ, রান্না ঘরের পচনশীল বর্জ্য পদার্থ, রক ফসফেট (শতকরা ৫ ভাগ) ও বায়োচার (শতকরা ১৫ ভাগ) মিশিয়ে বায়ো-অর্গানিক সার উদ্ভাবন করেছেন। বায়ো-অর্গানিক সারের উদ্ভাবক দলের অন্য সদস্যরা হলেন, ড. যতীশ চন্দ্র বিশ্বাস, মো. ইমরান উল্লাহ সরকার ও আফসানা জাহান। ইউরিয়া ও টিএসপি সারের জন্য সরকারকে প্রতি বছরে বিপুল পরিমাণে অর্থ ভর্তুকি দিতে হয়। তাছাড়া সার উৎপাদনে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি কেজি ইউরিয়া ও টিএসপি উৎপাদনে প্রায় সাড়ে ছয় কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাসে যুক্ত হয়। টিএসপি অথবা ডিএপি সার তৈরীর প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে রক ফসফেট, যার বাজার মূল্য কেজি প্রতি মাত্র পাঁচ টাকা। রক ফসফেট সহজে দ্রবীভূত হয় না বিধায় এটিকে ধানসহ বিভিন্ন স্বল্প মেয়াদি ফসলে সরাসরি ব্যবহার করা যায় না। মাটিতে বসবাসকারী এক শ্রেণির পরিবেশবান্ধব ব্যাকটেরিয়া যা ফসফেট দ্রবণকারী ব্যাকটেরিয়া নামে পরিচিত এবং খুব সহজেই রক ফসফেটকে স্বল্প সময়ে দ্রবীভূত করে উদ্ভিদের গ্রহণযোগ্য করে তোলে। তাই বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত সার অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখবে।
উদ্ভাবিত বায়ো-অর্গানিক সার ধান চাষে ব্যবহারে একদিকে যেমন শতকরা ৩০ ভাগ ইউরিয়া সার ও পূর্ণ মাত্রার টিএসপি সারের ব্যবহার কমাবে, অন্যদিকে কাঁচা বাজারসহ রান্নাঘরের বর্জ্য দ্রব্যকে ধান চাষে জৈব সার রূপে ব্যবহার করে পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আনা যাবে। তদুপরি মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। এই উদ্ভাবিত সারটির সঙ্গে শতকরা ১৫ ভাগ বায়োচার আছে বিধায় মাটিতে সরাসরি কার্বন যোগ করে মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি করবে।
লেখক
এম এ মোমিন।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৭মার্চ২০