জাতঃ বাংলাদেশে উদ্ভাবিত জাতগুলি হচ্ছে বারি ড্রাগন ফল-১, বাউ ড্রাগন ফল-১( সাদা) , বাউ ড্রাগন ফল-২ (লাল), বাউ ড্রাগন ফল-৩
বংশবিস্তারঃ অঙ্গজ উপায়ে অথবা বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করলেও মাতৃগুণ বজায় রাখার জন্য অঙ্গজ উপায়ে বংশবিস্তার কাম্য। বীজ দিয়ে সহজে বংশবিস্তার করানো গেলেও ফল ধরতে সময় বেশি লাগে এবং মাতৃ গাছের গুনাগুণ বজায় থাকে না। সেজন্য কাটিং এর মাধ্যমে বংশবিস্তার উত্তম এবং ফল ধরতে সময় কম লাগে ও মাতৃ গাছের বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে। এক বছর বয়স্ক গাঢ় সবুজ শাখা হতে ২০-৩০ সেমি লম্বা টুকরা কাটিং হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।৮×১০ ইঞ্চি সাইজের পলিব্যাগে ৫০ ভাগ পচা গোবর ও ৫০ ভাগ ভিটি বালুর মিশ্রণ তৈরি করে সেখানে কাটিং স্থাপন করে ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে দিতে হবে। ৩০-৪৫ দিন পর কাটিং এর গোড়া থেকে শিকড় এবং কান্ডের প্রান্ত থেকে নতুন কুশি বেরিয়ে আসার পর এটি মাঠে লাগানোর উপযুক্ত হবে। তবে উপযুক্ত পরিবেশ ও প্রয়োজন অনুযায়ী কাটিংকৃত কলম সরাসরি মূল জমিতে লাগানো যেতে পারে।
জমি নির্বাচন ও তৈরিঃ সুনিষ্কাশিত উঁচু ও মাঝারি উঁচু উর্বর জমি নির্বাচন করতে হবে। পর্যায়ক্রমিক কয়েকটি চাষ ও মই দিয়ে জমি সমান করতে হবে এবং আগাছা বিশেষ করে উলুঘাস মূলসহ অপসারণ করতে হবে ।
রোপণ পদ্ধতি ও রোপণের সময়ঃ সমতল ভূমিতে বর্গাকার কিংবা ষড়ভুজাকার এবং পাহাড়ি জমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে কাটিং রোপণ করতে হবে । কাটিং রোপণের পর হালকা ও অস্থায়ী ছায়ার ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল। ড্রাগণ ফল এর কাটিং রোপণের উপযুক্ত সময় মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য অক্টোবর।
মাদা তৈরি, চারা রোপণ ও পরিচর্যাঃ উভয় দিকে ২.৫-৩ মিটার দুরত্বে ১.৫×১.৫×১ মিটার আকারের গর্ত করে উন্মুক্ত অবস্থায় রাখতে হবে।গর্ত তৈরির ২০-২৫ দিন পর প্রতি গর্তে ২৭-৩০ কেজি পচা গোবর , ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি, ১৫০ গ্রাম জিপসাম ও ৫০ গ্রাম জিংক সালফেট সার গর্তের মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে রেখে দিতে হবে । মাটিতে রস কম থাকলে পানি সেচ দিতে হবে। গর্ত ভরাট করার ১২-১৫ দিন পর প্রতি গর্তে ৫০ সেমি দুরত্বে ৪ টি ড্রাগন ফলের কাটিং সোজাভাবে গর্তের মাঝখানে লাগিয়ে চারার চারদিকের মাটি হাত দিয়ে চেপে ভালভাবে বসিয়ে দিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পানি সেচ দিতে হবে। এর পর নিয়মিত পানি সেচ ও প্রয়োজনীয় বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গাছ লতানো এবন ১.৫-২.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হওয়ায় সাপোর্টের জন্য চারা চারটির মাঝখানে ৪ মিটার লম্বা সিমেন্টের খুটি এমনভাবে পুতে দিতে হবে যাতে করে মাটির উপরে ৩ মিটার অবশিষ্ট থাকে । চারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে নারিকেলের রশি দিয়ে সিমেন্টের খুটির সাথে বেঁধে দিতে হবে । প্রতিটি খুটির মাথায় একটি মোটর সাইকেলের পুরাতন টায়ার মোটা তারের সাহয্যে আটকিয়ে দিতে হবে এবং গাছের মাথা ও অন্যন্য ডগা টায়ারের ভেতর দিয়ে বাহিরের দিকে ঝুলিয়ে দিতে হবে ।ঝুলন্ত ডগায় ফল ধরার পরিমাণ বেশি থাকে।
ড্রাগন ফল গাছে সার প্রয়োগঃ চারা রোপণের এক মাস পর থেকে এক বছর পর্যন্ত ৩ মাস অন্তর প্রতি গর্তে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।
বিভিন্ন বয়সের গাছের জন্য সারের পরিমাণ নিম্নরুপঃ
গাছের বয়স মাদা প্রতি সারার পরিমাণ / বছর
গোবর( কেজি) ইউরিয়া(গ্রাম) টিএসপি (গ্রাম) এমওপি( গ্রাম)
১-৩ বছর ৪০-৫০ ৩০০ ২৫০ ২৫০
৩-৬ বছর ৫০-৬০ ৩৫০ ৩০০ ৩০০
৬-৯ বছর ৬০-৭০ ৪০০ ৩৫০ ৩৫০
১০ বছরে উর্ধে ৭০-৮০ ৫০০ ৫০০ ৫০০
উল্লেখিত সার সমান তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে
১ম কিস্তি- ফেব্রুয়ারি
২য় কিস্ত-জুন
৩য় কিস্তি- অক্টোবর
সার প্রয়োগের পর প্রয়োজনে সেচ প্রদান করতে হবে।
আগাছা দমনঃ বর্ষার শুরুতে বা বর্ষার শেষদিকে কোদাল দ্বারা কুপিয়ে বা চাষ দিয়ে ।
পানি সেচ ও নিষ্কাশনঃ ড্রাগন ফল খরা ও জলাবদ্ধতার প্রতি সংবেধনশীল । চারার বৃদ্ধির জন্য শুকনো মৌসুমে ১০-১৫ দিন পর পর সেচ দিতে হবে । ফলন্ত গাছের বেলায় সম্পুর্ণ ফুল ফোটা পর্যায়ে একবার, দানার মত হলে একবার এবং এর ১৫ দিন পর আরেকবার মোট তিনবার সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। সার দেয়ার পর সেচ দেয়া ভাল। বর্ষার সময় যাতে গাছের গোড়ায় পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ফুল আসার ৬-৮ সপ্তাহ আগে সামান্য পানির কষ্ট/ পীড়ন দিলে আগাম অধিক ফুল আসে।
ড্রাগন গাছের রোগঃ ড্রাগন গাছে মূলপঁচা, কান্ড ও গোড়া পঁচা রোগ দেখা যায়।
ড্রাগন গাছের মূলপচাঁ রোগ: গোড়ায় অতিরিক্ত পানি জমে গেলে মূল পঁচে যায়। এ রোগ হলে মাটির ভিতরে গাছের মূল একটি দুটি করে পঁচতে পঁচতে গাছের সমস্ত মূল পঁচে যায়। গাছকে উপরের দিকে টান দিলে মূল ছাড়া শুধু কান্ড উঠে আসে। তবে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে উঁচু জমিতে এ ফলের চাষ করা ভালো। এ রোগটি Fusarium sp. দ্বারা সংঘটিত হয়।
ড্রাগন গাছের কাণ্ড ও গোড়া পঁচা রোগ: ছত্রাক অথবা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগ হতে পারে। এ রোগ হলে গাছের কাণ্ডে প্রথমে হলুদ রং এবং পরে কালো রং ধারণ করে এবং পরবর্তীতে ঐ অংশে পঁচন শুরু হয় এবং পঁচনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এ রোগ দমনের জন্য যে কোন ছত্রাকনাশক (বেভিস্টিন, রিডোমিল, থিওভিট ইত্যাদি) ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করে সহজেই দমন করা যায়।
ড্রাগন গাছের পোকা মাকড়ঃ ড্রাগন ফলের জন্য ক্ষতিকর পোকা মাকড় খুব একটা চোখে পড়ে না, তবে মাঝে মাঝে এফিড ও মিলি বাগের আক্রমণ দেখা যায়। এফিডের বাচ্চা ও পূর্ণ বয়স্ক পোকা গাছের কচি শাখা ও পাতার রস চুষে খায়, ফলে আক্রান্ত গাছের কচি শাখা ও ডগার রং ফ্যাকাশে হয়ে যায় ও গাছ দূর্বল হয়ে পড়ে। এ পোকা ডগার উপর আঠালো রসের মতো মল ত্যাগ করে ফলে শুটিমোল্ড নামক কালো ছত্রাক রোগের সৃষ্টি হয়। এতে গাছের খাদ্য তৈরি ব্যাহত হয়। এতে ফুল ও ফল ধারণ কমে যায়। এ পোকা দমনে ম্যালাথিয়ন গ্রুপের কীটনাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২৫ মিলিলিটার বা ৫ কাপ ভালো ভাবে মিশিয়ে স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
ফল সংগ্রহঃ ফুল আসার ৩০- ৩৫ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায় । ফল সম্পূর্ণ লাল রঙ ধারণের ৫-৭ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করা উত্তম।
ড্রাগন ফলের পুষ্টিমানঃ ভক্ষণযোগ্য প্রতি ১০০ গ্রামে পাওয়া যায়-
পানি – ৮০-৯০ গ্রাম,শর্করা – ৯-১০ গ্রাম, প্রোটিন – ০.১৫-০.৫ গ্রাম, আঁশ – ০.৩৩-০.৯০ গ্রাম, খাদ্যশক্তি – ৩৫-৫০ কিলোক্যালরি, চর্বি – ০.১০-০.৬ গ্রাম, ক্যালসিয়াম – ৬-১০ মি গ্রাম, আয়রন – ০.৩-০.৭ মি.গ্রাম, ফসফরাস – ১৬-৩৫ গ্রাম, ক্যারোটিন, ভিটামিন-এ ও ভিটামিন –ই পাওয়া যায়।
এছাড়াও অল্প পরিমানে চর্বি পাওয়া যায় যা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী।
ড্রাগন ফলের গুরুত্বঃ
১. ক্যারোটিন সমৃদ্ধ থাকায় চোখের দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি করে ও ক্যান্সারের বৃদ্ধি ব্যাহত করে।
২. আঁশ বেশি থাকায় হজম শক্তি বৃদ্ধি করে।
৩. আঁশ শরীরের চর্বি কমায়।
৪. এর প্রোটিন শরীরের বিপাকীয় কাজে সহায়তা করে।
৫. ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত ও সুস্থ দাঁত তৈরি করে।
৬. ভিটামিন-বি-১ কার্বহাইড্রেট বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে।
৭. ভিটামিন বি-৩ রক্তের কোলেস্টেরল কমায় এবং ত্বক মসৃণ রাখে।
৮. ভিটামিন সি শরীরের কাটা, ভাঙা জোড়া লাগাতে সাহায্য করে।
৯. ভিটামিন বি-২ শরীরে ক্ষুধা তৃষ্ণা, যৌন বাসনা, প্রভৃতি মিটানোর আকাঙক্ষা উন্নয়ন ও পূরণে সাহায্য করে।
১০. ফসফরাস বেশি থাকায় কোষ কলা গঠনে সাহায্য করে।
১১. শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ থেকে রক্ষা করে।
ড্রাগন ফলের ঔষধি গুণঃ রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণ এর পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
তাইওয়ানে ডায়াবেটিসের রোগীরা ভাতের পরিবর্তে এ ফল প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে।
ফলটিতে ফাইটো অ্যালবুমিন, এন্টি অক্সিডেন্ট থাকে যা ক্যান্সারের কারণ ফ্রি রেডিক্যাল তৈরিতে বাধা দেয়।
এ ফল খেলে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে। এবং আন্ত্রিক সমস্যার সমাধান হয়।
লিভারের জন্য খুবই উপযোগী।গবেষণায় জানা গেছে এ ফল নিয়মিত খেলে ওজন কমে এবং শরীরের গঠন সুন্দর হয় ।
তথ্যের উৎসঃ কৃষি প্রযুক্তি হাতবই , ফেসবুক, ওয়েবসাইট ও কৃষিবিদ হুমায়ূন হিমু (বিসিএস,কৃষি)
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৭মার্চ২০