প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাবে দেশের কিছু নির্দ্দিষ্ট এলাকায় পটল চাষ সীমাবদ্ধ

1018

KRISHE-18
পটল একটি জনপ্রিয় উচ্চমূল্য সবজি। পটল মূলত খরিপ মৌসুমের ফসল। তবে সারা বছর ধরেই কম-বেশি পাওয়া যায়। অন্যান্য সবজির তুলনায় এর বাজারমূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বাজারে যখন সবজির ঘাটতি দেখা দেয় তখন পটল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের মোট সবজির চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ পটল পূরণ করে থাকে। সুস্থ থাকার জন্য একজন মানুষের দৈনিক কমপক্ষে ২৩৫ গ্রাম সবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে উৎপাদিত সবজির মাথাপিছু দৈনিক গড় প্রাপ্যতা ৮২ গ্রাম। চাহিদার তুলনায় প্রাপ্যতার এই বিশাল ঘাটতি পূরণের জন্য দেশের সবজি উৎপাদন অবশ্যই বাড়ানো প্রয়োজন। বাংলাদেশের জলবায়ু ও আবহাওয়া পটল চাষের উপযোগী। দেশের সকল এলাকাতেই পটল চাষ করা সম্ভব। তবুও প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাবে দেশের কিছু নির্দ্দিষ্ট এলাকায় এর চাষ সীমাবদ্ধ। বৃহত্তর রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, ফরিদপুর, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায় পটল চাষ বেশি হয়। দেশের অন্যান্য এলাকায় পটল চাষ সম্প্রসারণ করে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করলে একদিকে যেমন মোট সবজির উৎপাদন বাড়বে অপরদিকে কৃষকদের আর্থিক সচ্ছলতাও বাড়বে।

জলবায়ু ও মাটি: পটল গাছের দৈহিক বৃদ্ধি এবং ফলনের জন্য উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়া দরকার। এ জন্য খরিপ মৌসুম পটল চাষের উপযুক্ত সময়। পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন উঁচু ও মাঝারী উঁচু জমি এবং বেলে দো-আঁশ থেকে দো-আঁশ মাটি পটল চাষের জন্য উপযোগী। পটল বেশ খরা সহিষ্ণু। তবে পানির ঘাটতি দীর্ঘায়িত হলে ফলন কমে যায়।

জাত: বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় স্থানীয় অনেক জাতের পটল দেখা যায়। যেমন- বালি, মুর্শিদাবাদী, কানাইবাঁশী এসব। জাতগুলোর মধ্যে আকার এবং রংয়ের অনেক বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায়। যেমন- কোনটি লম্বা ও চিকন, কোনটি লম্বা ও মোটা, কোনটি খাট ও মোটা, কোনটি গাঢ় সবুজ, কোনটি হালকা সবুজ, কোনটি ডোরাকাটা, কোনটি ডোরাবিহীন, কোনটির পুরু ত্বক আবার কোনটির পাতলা ত্বক। এসব জাতই এতদিন চাষ হয়ে আসছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি পটল-১ ও বারি পটল-২ নামে পটলের দুটি জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতগুলো উচ্চ ফলনশীল এবং রোগবালাই সহিষ্ণু। উপযুক্ত পরিচর্যা করলে জাতগুলো প্রতি শতাশে ১২০ থেকে ১৫০ কেজি ফলন দিয়ে থাকে।

বপন সময়: বাংলাদেশে বর্ষার শেষে আশ্বিন-কার্তিক মাস এবং শীতের শেষে ফাল্গুন-চৈত্র মাস পটল লাগানোর উপযুক্ত সময়। আশ্বিন-কার্র্তিক মাসে পটলের কাটিং বা শিকড় লাগালে তীব্র শীত শুরুর আগেই গাছের কিছুটা অংগজ বৃদ্ধি হয়ে থাকে। এতে জীবনকাল কিছুটা দীর্ঘায়িত হলেও ফালগুন-চৈত্র মাসে আগাম ফলন পাওয়া যায় এবং বাজারমূল্য বেশি পাওয়া যায়। বৃষ্টিবহুল এলাকায় বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে অবশ্যই আশ্বিন-কার্তিক মাসে পটল লাগানো উচিত। ফালগুন-চৈত্র মাসে পটল লাগালে গাছ দ্রুত বাড়ে, জীবনকাল কমে যায় এবং জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে ফল আসা শুরু হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে পানের বরজে ছায়াদানকারী গাছ হিসাবে আশ্বিন-কার্তিক মাসে পটল লাগানো হয়। চরাঞ্চলে বর্ষজীবি ফসল হিসাবে প্রতি বছর আশ্বিন-কার্তিক মাসে পটল চাষ করা হয়। পলিব্যাগে চারা করে মূল জমিতে শ্রাবন-ভাদ্র মাসে লাগানো গেলে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে ফলন পাওয়া যায়।

বংশ বিস্তার: পটল একটি পরপরাগায়িত উদ্ভিদ। এর স্ত্রী ও পুরুষ ফুল আলাদা গাছে ফোটে। বীজ দ্বারা এর বংশবিস্তার করা হয় না। বীজ থেকে জন্মানো গাছে ফুল আসতে প্রায় দুই বছর সময় লাগে। কন্দমূল অথবা কান্ডের শাখা কলম দিয়ে পটলের বংশবিস্তার করা হয়। শাখা কলমের ক্ষেত্রে পরিপক্ক কান্ড ব্যবহার করা হয়। পটলের কান্ড মরে গেলেও মূল জীবিত থাকে। শীতের শেষে কান্ড থেকে নতুন চারা বের হয়। পটলের শাখা কলম বা লতার কাটিং করার জন্য একাধিক পদ্ধতি রয়েছে। যেমন- প্রায় এক বছর বয়সের মোটা আকারের লতা ৫০ সে.মি. বা একটু বেশি লম্বা করে কেটে নিয়ে রিংয়ের মত করে পেঁচিয়ে মূল জমিতে বেডে লাগানো যায়। এতে ৪-৫ টি গিট মাটির নিচে থাকে এবং একটি গিট মাটির উপরে থাকে।

মূল জমির বেডে নির্দ্দিষ্ট দূরত্বে লাঙ্গল দিয়ে ১৫ সে.মি. গভীর নালা করে পরিপক্ক লতা লম্বা করে নালায় বিছিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে লতার দুই প্রান্ত মাটির উপরে উন্মুক্ত থাকে। পরিপক্ক লতা কেটে রিংয়ের মতো করে পেঁচিয়ে বাড়িতে বা নার্সারীতে ছায়ায় লাগানো হয়। এক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি গিট মাটি দিয়ে ঢাকা থাকে। এরপর গজানো চারা মুলসহ উঠিয়ে নিয়ে বেডে লাগানো হয়।

শাখাকলম লাগানোর সময় মাটিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে কলম শুকিয়ে মারা যায়। এক্ষেত্রে পরিব্যাগে চারা গজিয়ে নিলে মূল জমিতে সময় মতো লাগানো যায়। এ পদ্ধতিতে খরচ কিছুটা বাড়লেও চারার মৃত্যুর হার অনেক কমে যায় ফলে মোট উৎপাদন বেড়ে যায়। মাটিতে আর্দ্রতা কম থাকলে একটু গভীরে শাখা কলম লাগাতে হয়। তবে বেশি আর্দ্র জমিতে কলম লাগালে তা পচে যেতে পারে।

জমি তৈরি ও রোপণ: পটলের জমি গভীর করে ৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করে নিতে হয়। এতে পটলের মূলের বিস্তার সহজ হয় এবং গাছ সহজেই মাটি থেকে পানি ও পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে। জমি চাষ করার পর বেড তৈরি করে নিতে হয়ে। বেড পদ্ধতিতে পটল চাষ করা ভাল। এতে বর্ষাকালে ক্ষেত নষ্ট হয় না। রোপণ পদ্ধতির উপর নির্ভর করে বেডের প্রস্থ ও রোপণ দূরত্ব কম-বেশি হয়ে থাকে। জমির দৈর্ঘ বরাবর ২৬০ সে.মি. চওড়া বেড তৈরি করে নিয়ে পাশাপাশি দুটি বেডের মাঝে ৩০-৩৫ সে.মি. প্রস্থ এবং ২০ সে.মি. গভীর নালা রাখতে হয়। এতে সেচ ও নিকাশের সুবিধা হয়। প্রতি বেডে ২০০ সে.মি. দূরত্বে লাঙ্গল দিয়ে ১০-১৫ সে.মি. গভীর করে দুটি নালা করে নিতে হয়। প্রতি নালায় ৫০ সে.মি. পর পর ১০-১৫ সে.মি. গভীরে শাখা কলম লাগাতে হয়। দেশের বৃষ্টিবহুল এলাকায়, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে, চাষের জন্য বেডের প্রস্থ হবে ১৫০ সে.মি.। প্রতি বেডের মাঝ বরাবর এক সারিতে ১৫০ সে.মি. দূরে দূরে মাদা তৈরি করে মাদায় চারা রোপণ করতে হয়। মাদার আকার হবে যথাক্রমে ৫০ ী ৫০ ী ৪০ সে.মি.। এক্ষেত্রে সেচনালার প্রস্থ হবে ৪০-৪৫ সে.মি.। একসঙ্গে চারা লাগালেও স্ত্রী ফুলের ১০-১৫ দিন পরে পটলের পুরুষ ফুল ফোটে। পুরুষ ফুলের অভাবে প্রথম দিকে ফোটা স্ত্রী ফুলগুলিতে ফল হয় না। তাই মূল জমিতে সারিতে বা মাদায় প্রতি ১০ টি স্ত্রী গাছের পর পর একটি পুরুষ গাছ ১০-১৫ দিন আগেই লাগানো উচিত।

সার প্রয়োগ: পটলের ভাল ফলন পাওয়ার জন্য মাঝারী উর্বর জমিতে বিঘাপ্রতি ১৩০০ কেজি গোবর বা কম্পোষ্ট, ৪০ কেজি ইউরিয়া, ২৭ কেজি টিএসপি, ২০ কেজি এমওপি এবং ৮ কেজি জিপসাম সার ব্যবহার করা প্রয়োজন। ইউরিয়া ছাড়া বাকী সব সারের অর্ধেক পরিমাণ জমি তৈরির সময় এবং বাকী অর্ধেক সার মাদায় দিতে হবে। ইউরিয়া সার চারা গজানোর ২০ দিন পর পর সমান ৩ কিস্তিতে মাদার চারপাশে প্রয়োগ করতে হবে। পটলের জমিতে মাচা না দিলে ইউরিয়া সার দেয়া অসুবিধাজনক। সেক্ষেত্রে অর্ধেক ইউরিয়া বেডে এবং বাকী অর্ধেক ইউরিয়া চারা গজানোর ৩০ দিন পর গাছের গোড়ার চারপাশে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। পটলের ফলন প্রথম দিকে বাড়তে থাকে পরে আস্তে আস্তে কমতে থাকে। ফলন একেবারে কমে আসলে মাদার চারপাশ পরিষ্কার করে হালকাভাবে মাটি কুপিয়ে মাদাপ্রতি অতিরিক্ত ২০-৩০ গ্রাম ইউরিয়া, ৩০-৩৫ গ্রাম টিএসপি এবং ২০-২৫ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করলে গাছে নতুন নতুন ফুল ধরে এবং ফলন অনেক বেড়ে যায়। এভাবে দুবার সার দেয়া যেতে পারে।

পরিচর্যা: ভাল ফলন পাওয়ার জন্যে পটলের জমিতে বিভিন্ন পরিচর্যা করতে হয়। যেমন- বাউনি বা মাচা দেয়া: পটল একটি লতানো উদ্ভিদ। তাই পটল গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধি এবং ভাল ফলনের জন্য বাউনি বা মাচা দেয়া অবশ্যই দরকার। বাঁশের কাঠির সাহায্যে চারা গাছকে মাচায় তুলে দেয়া হয়। এক মিটার উচ্চতায় মাচা বা বাউনি দিলে পটলের ফলন প্রায় দ্বিগুণ পাওয়া যায়। পটলের মাচা বা বাউনি দু’ভাবে দেয়া যায়। বাঁশের তৈরি আনুভূমিক এবং রশি দ্বারা তৈরি খাড়া বা উল্লম্ব। মাচার দৈর্ঘ ও প্রস্থ হবে বেডের সমান। পটলের আকর্ষি ছোট হওয়ায় বাউনি যত চিকন আকারের দেয়া যায় ততই ভাল। পটলের মাচা বা বাউনি বেশ খরচ সাপেক্ষ। তাই অনেক এলাকায় পটল চাষীরা বাউনির বদলে মাটির উপর খর-কুটা বা কচুরিপানা দিয়ে তার উপর গাছ তুলে দিয়ে থাকেন। এতেও ভাল ফলন পাওয়া যায় এবং উৎপাদন খরচও কম হয়। তবে পটলের মাটির সংস্পর্শে থাকা অংশ ফ্যাকাশে হলুদ হয়ে যায় এবং বাজারমূল্য কিছুটা কমে যায়। যেসব এলাকায় বৃষ্টিপাত কম হয় সেসব এলাকায় এ পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। তবে রপ্তানীযোগ্য উচ্চ গুণাগুণসম্পন্ন পটল পেতে হলে অবশ্যই বাউনি বা মাচা দিতে হবে।

আগাছা দমন: পটলের জমিতে সাধারণত: হেলেঞ্চা, দূর্বা, দন্ডকলস এসব আগাছার উপদ্রব দেখা যায়। এসব আগাছা জমি থেকে খাদ্য গ্রহণ করে পটল গাছকে দুর্বল করে দেয় ফলে পটলের ফলন কমে যায়। তাই পটলের জমি সবসময় আগাছামুক্ত রাখা উচিত। অংগ ছাটাই ঃ পটল গাছ মাচার উঠার আগ পর্যন্ত পার্শ¦শাখা ছাটাই করে দিতে হয়। পরবর্তীতে প্রতিবার ফসল সংগ্রহের পর মরা এবং রোগ ও পোকা আক্রান্ত পাতা ও শাখা ছাটাই করে দিতে হয়। এতে ফলধারী নতুন শাখার সংখ্যা বেড়ে যায় এবং ফলন বেশি হয়।

জাবরা: পটল চারা লাগানো হয় শুকনো মৌসুমে। তাই কলম বা চারা লাগানোর পর মাদায় বা গাছের গোড়ায় জাবরা দেয়া প্রয়োজন। জাবরা মাদায় আর্দ্রতা সংরক্ষণে সহায়তা করে। পটল গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি সময়মতো নালা দিয়ে বের করে দিতে হবে।

পরাগায়ন: চারা লাগানোর ৯০ দিনের মাথায় পটলের ফুল আসতে শুরু করে। পটল একটি পরপরাগায়িত উদ্ভিদ। স্ত্রী ফুল ও পুরুষ ফুল আলাদা গাছে ফোটে। কাজেই পরাগায়ন না হলে পটলের ফলন পাওয়া যাবে না। পটলের পরাগায়ন সাধারণত বাতাস এবং কীটপতঙ্গের দ্বারা হয়ে থাকে। তবে জমিতে পুরুষ ফুলের সংখ্যা খুব কমে গেলে কৃত্রিমভাবে পরাগায়ন করা প্রয়োজন হয়। সকাল ৬টা থেকে ৭টা পটলের পরাগায়ন করার উপযুক্ত সময়। কৃত্রিম পরাগায়ন করার জন্য একটি পুরুষ ফুল তুলে নিয়ে পুংকেশর ঠিক রেখে পাপড়িগুলি ছিড়ে ফেলতে হয়। তারপর পুংকেশর দ্বারা সদ্যফোটা প্রতিটি স্ত্রী ফুলের গর্ভমুন্ডে ২-৩ বার স্পর্শ করতে হবে। এর ফলে গর্ভমুন্ডের মাথায় পরাগরেণু আটকে যাবে এবং পরাগায়ন হবে। একটি পুরুষ ফুল দিয়ে ৮-১০ টি স্ত্রী ফুল পরাগায়ন করা যায়। এছাড়াও পরুষ ফুল সংগ্রহ করে পরাগরেণু আলাদা করে পানিযুক্ত একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে নিয়ে হালকা ঝাকি দিয়ে পরাগরেণু পানিতে মিশিয়ে পরাগরেণু মিশ্রিত পানি ড্রপার দিয়ে ১ ফোটা করে প্রতিটি স্ত্রী ফুলের গর্ভমূন্ডে লাগিয়েও পরাগায়ন করা যায়। কৃত্রিম পরাগায়নের ফলে পটলের ফলন অনেক বেড়ে যায়।

মুড়ি ফসল: পটল গাছ থেকে প্রথম বছর ফসল সংগ্রহ করার পর গাছের গোড়া নষ্ট না করে রেখে দিয়ে পরবর্তী বছর পরিচর্যার মাধ্যমে গুড়িচারা থেকে যে ফসল পাওয়া যায় তাকেই মুড়ি ফসল বলে। উঁচু জমিতে পটল চাষ করলে মুড়ি ফসল করা যায়। আশ্বিন-কার্তিক মাসে পুরানো শুকনো লতা কেটে দিতে হয়। তারপর জমির আগাছা পরিষ্কার করে কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে দিতে হয়। এতে গাছ নতুনভাবে উদ্বীপিত হয়। মুড়ি ফসলেও নতুন ফসলের মতো সার প্রয়োগ ও অন্যান্য পরিচর্যা করতে হয়। পটল গাছ একবার লাগালে ৩ বছর পর্যন্ত ফলন দিয়ে থাকে। পটল গাছে ১ম বছর ফলন কম হয়, ২য় বছর ফলন বেশি হয় এবং ৩য় বছর ফলন কমতে থাকে। একবার লাগানো পটল গাছ ৩ বছরের বেশি রাখা উচিত নয়।

বালাই দমন: পটলের গাছ ও ফল বিভিন্ন প্রকার পোকা ও রোগ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। এদের মধ্যে ফলের মাছি পোকা, কাঁঠালে পোকা এবং পাউডারি মিলডিউ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

ফলের মাছিপোকা: এ পোকা পটলের বেশ ক্ষতি করে। স্ত্রীপোকা কচি ফলের ত্বক ছিদ্র করে ভিতরে ডিম পারে। ডিম ফুটে কীড়া বেড় হয়ে ফলের ভিতরের নরম অংশ খায়। এতে পটল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে এবং অনেক সময় ফল ঝরে যায়।

প্রতিকার: জমি পরিষ্কার রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল দেখা মাত্র সংগ্রহ করে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে। বিষফাঁদ বা ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পোকা দমন করতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ১ মি.লি. হারে ডিপটেরেক্স ৮০ এমপি মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর ৩-৪ বার ¯েপ্র করলে পোকা নিয়ন্ত্রণে আসে।

কাঁঠালে পোকা: পূর্ণাঙ্গ পোকা ও কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে জালের মতো ঝাঝড়া করে ফেলে। ফলে পাতা শুকিয়ে মরে যায় এবং গাছ আস্তে আস্তে পাতাশূন্য হয়ে পড়ে। আক্রমণ তীব্র হলে গাছ মারা যেতে পারে।

প্রতিকার: আক্রমণ দেখামাত্রই পাতাসহ পোকার ডিম ও কীড়া সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে। নিম বীজের মিহিগুড়া ৩০-৪০ গ্রাম এক লিটার পানিতে ১২-১৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে পানি ছেকে নিয়ে ঐ পানি আক্রান্ত গাছে ¯েপ্র করলে পোকা দমন হয়। আক্রমণের মাত্রা তীব্র হলে ফেনিট্রোথিয়ন ৫০ ইসি জাতীয় কীটনাশক ১ লিটার পানিতে ২ মি.লি পরিমাণ মিশিয়ে ¯েপ্র করে আক্রান্ত গাছের পাতা ভিজিয়ে দিতে হবে। পাউডারি মিলডিউ ঃ এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। প্রথমে বয়ষ্ক পাতায় রোগের লক্ষণ দেখা যায়। আক্রান্ত পাতার উপরের দিকে এবং কান্ডে সাদা পাউডারের মতো জীবাণুর প্রলেপ পড়ে। আস্তে আস্তে উপরের দিকে কচি পাতাও আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত পাতা ক্রমে ক্রমে হলুদ হয় এবং এক পর্যায়ে সম্পূর্ণ পাতা শুকিয়ে মারা যায়।

প্রতিকার: সুষম সার এবং পরিমিত সেচ দিলে এ রোগের আক্রমণ কম হয়। আক্রমণ দেখা গেলে থিওভিট জাতীয় ছত্রাকনাশক ২ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ৩ বার ¯েপ্র করতে হবে।

ফসল তোলা ও ফলন: পটল কচি অবস্থায় সংগ্রহ করা উচিত। ফুল ফোটার ১০-১২ দিন পর পটল সংগ্রহের উপযোগী হয়। পটল এমন পর্যায়ে সংগ্রহ করা উচিত যখন ফলটি পূর্ণ আকার প্রাপ্ত হয়েছে কিন্তু পরিপক্ক হয়নি। বেশি পাকা ফলের বীজ শক্ত হয়ে যায় এবং খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। জাত ও পরিচর্যার উপর পটলের ফলনের তারতম্য হয়। আধুনিক জাতগুলো চাষ করলে এবং সঠিক পরিচর্যা করলে বিঘাপ্রতি ৪০০০ থেকে ৫০০০ কেজি ফলন পাওয়া সম্ভব।

পুষ্টিমান ও ব্যবহার: উচ্চ পুষ্টিমান ও বহুবিধ ব্যবহারের জন্য পটল সবার পছন্দের একটি সবজি। খাবার উপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম পটলে রয়েছে ২.৪ গ্রাম প্রোটিন, ৪.১ গ্রাম শ্বেতসার, ০.৬ গ্রাম চর্বি, ৭৯০ মা.গ্রা. ক্যারোটিন, ০.৩০ মি.গ্রা. ভিটামিন বি-১, ০.০৩ মি.গ্রা. ভিটামিন বি-২, ২৯ মি.গ্রা. ভিটামিন সি, ২০ মি.গ্রা. ক্যালসিয়াম, ১.৭ মি.গ্রা. আয়রণ, এবং ৩১ কিলো ক্যালরি খাদ্যশক্তি। পটলের ব্যবহারেও রয়েছে বৈচিত্র। বিভিন্নভাবে পটল ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন- তেলে ভাজি পটল, পটল মিশ্র সবজি, পটল চিংড়ি, পটল মোরব্বা, আলু-পটলের দোলমা এসব। এছাড়াও বিভিন্ন তরকারীতে পটল ব্যবহার করা হয়। পটল সহজেই হজম হয়। তাই হৃদরোগীদের জন্য পটল উপকারী।

আয় ব্যয়: গবেষণায় দেখা গেছে এক বিঘা জমিতে পটল চাষ করলে প্রায় ৭ হাজার টাকা খরচ হয়। আর এক বিঘা জমির পটল বিক্রি করে আয় হয় কমপক্ষে ২১ হাজার টাকা। খরচ বাদে এক বিঘা জমিতে নীট লাভ হয় ১৪ হাজার টাকা। কাজেই নীট আয় ও আয়-ব্যয়ের অনুপাত বিবেচনায় নি:সন্দেহে বলা যায় পটল একটি লাভজনক সবজি।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২০মার্চ২০