জমিতে পরভোজী পোকামাকড়কে সহজেই দেখা যায়। কিন্তু অনেকে এদের অনিষ্টকারী পোকা বলে ভুল করেন। এ ধরনের পরভোজী- পোকামাকড়ের মধ্যে কয়েক ধরনের মাকড়সা, লেডি বিটল এবং ক্যারাবিড বিটল প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পোকা দমন বেশ কার্যকরী। এছাড়া পার্চিং করে পোকা দমন ক্রমশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
ধানক্ষেতে বহু ধরনের উপকারী পোকা, মাকড়সা ও জীবাণু বাস করে। এসব পোকামাকড় ও জীবাণু অনেক ক্ষেত্রে ধানের অনিষ্টকারী পোকা দমন করে রাখতে পারে। ধানের বিভিন্ন অনিষ্টকারী পোকার প্রজনন ক্ষমতা অনেক বেশি। একটি স্ত্রী বাদামি গাছফড়িং থেকে এক প্রজন্মেই প্রচুর সংখ্যায় বাচ্চা জন্ম নেয়, কিন্তু ওই প্রজন্মের পর তাদের মধ্যে মাত্র ১-২টা বেঁচে থাকে। কারণ এদের অধিকাংশ পরভোজী পোকামাকড় খেয়ে ফেলে অথবা পরজীবী পোকা ও জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
এভাবে পোকা ও জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ৯৮-৯৯ শতাংশ অনিষ্টকারী পোকা ধ্বংস হয়। এরকম না হলে অনিষ্টকারী পোকার বিস্ফোরণ ঘটত। জমিতে পরভোজী পোকামাকড়কে সহজেই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু অনেকে এদের অনিষ্টকারী পোকা বলে ভুল করেন।
এ ধরনের পরভোজী-পোকামাকড়ের মধ্যে কয়েক ধরনের মাকড়সা, লেডি বিটল এবং ক্যারাবিড বিটল ধানগাছে তাদের শিকার খুঁজে বেড়ায়, ধানগাছের পাতাফড়িং, গাছফড়িং বিভিন্ন ধরনের মথ, মাজরা পোকার কিড়া এবং বিভিন্ন ধরনের পাতাভূক কিড়া এসব শিকারের অন্তর্ভুক্ত। পরভোজী মাকড়সা চলন্ত ও জীবন্ত পোকা খেতে ভালোবাসে। তবে এরা পোকার ডিমও খায়। অনেক সময় পরভোজী পোকা অনিষ্টকারী পোকার শতকরা ৮০-৯০ ভাগ ডিম খেয়ে এদের বংশ বৃদ্ধিকে রোধ করে দেয়। একটি পূর্ণ বয়স্ক উল্ফ (নেকড়ে) মাকড়সা প্রতিদিন ৫-১৫টি বাদামি গাছছড়িং খেয়ে ফেলতে পারে। পরভোজী পোকামাকড় তাদের নিজেদের দেহের বাড়-বাড়তির জন্য এভাবে অনেক পোকা শিকার করে খায়। কৃত্রিম উপায়ে পরভোজী পোকামাকড়ের বংশ বৃদ্ধি করিয়ে জমিতে ছেড়ে দিতে পারলে পোকা দমন অনেক সহজ হতো। কিন্তু তা করা সম্ভব নয়। কারণ কৃত্রিম উপায়ে এদের বংশ বৃদ্ধি করা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। এজন্য যেসব পরভোজী পোকামাকড় জমিতে সবসময় প্রচুর সংখ্যায় পাওয়া যায় তাদের রক্ষা করাই সবেচেয়ে সহজ ও বাস্তবসম্মত।
তাই যখন-তখ ক্ষেতে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে নিতান্ত প্রয়োজনেই এর ব্যবহার করা উচিত। পরভোজী পোকামাকড়দের জীবনধারণের জন্য প্রতিদিন অনেক পোকা শিকার করা প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে পরজীবী পোকা তার জীবনধারণের জন্য সাধারণত একটা পোকা শিকার করে তা থেকে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। পরজীবী স্ত্রী পোকারা তার পোষক পোকার ভেতরে বা তার উপরে একটা বা অনেক করে গাদায় ডিম পাড়ে। ওই ডিম থেকে পরজীবী পোকার বাচ্চারা ফোটে যখন পোষক পোকাকে খেতে থাকে তখন পোষক পোকা খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং পরে নিস্তেজ হয়ে মারা যায়।
এ দেশ থেকে অন্য দেশে পরজীবী পোকা আমদানি করে এবং সেগুলো ফসলের ক্ষেতে অনুপ্রবেশ করিয়ে ফসলের অনিষ্টকারী ও ধানের অনিষ্টকারী পোকা দমনের জন্য এ ধরনের প্রচেষ্টা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিফল হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃত্রিম উপায়ে পরজীবী পোকায় বংশ বৃদ্ধি করিয়ে তাদের ধানের জমিতে ছেড়ে দেয়া সম্ভব। এজন্য জমিতে যেসব পরজীবী পোকা থাকে তাদের সংরক্ষণ করাই সবচেয়ে ভালো উপায় এবং এটা করতে গেলে খুব বিচার-বিবেচনা করে কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত। প্রকৃতিতে অনিষ্টকারী পোকা ও তাদের শক্রদের মধ্যে একটা ভারসাম্য আছে। এর ফলে অনিষ্টকারী পোকা সংখ্যায় বেশি বাড়তে পারে না। কিন্তু বিচার বিবেচনাহীনভাবে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করলে এ প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই এসব কীটনাশক খুব সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োগ করা উচিত। যাতে অনিষ্টকারী পোকার প্রাকৃতিক শক্রগুলো ধ্বংস না হয়। কারণ অনিষ্টকারী পোকার এসব প্রাকৃতিক শক্ররাই হচ্ছে আমাদের প্রকৃত বন্ধু।
পার্চিং : ধানক্ষেতের ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমনে পার্চিং পদ্ধতি কৃষকের মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কীটনাশক ছাড়া জৈবিক উপায়ে পোকামাকড় দমন এবং প্রতিরোধে সুফল পাওয়ায় কৃষকরা পার্চিং পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকছে। ক্ষেতের ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমনে পার্চিং বা ডাল-পালা পোতা কার্যক্রম ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। দিন দিন এ পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার কমে আসছে। এর সুফলও পাচ্ছেন কৃষক। কৃষকরা তাদের আবাদী জমিতে জৈব বা রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক এই পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে। জমিতে পার্চিং করা বা ডাল-পালা, বাঁশের কঞ্চি পোতা পদ্ধতিটি খুবই সহজ এর কোনো খরচ নেই, পাখি ডালে বসে মাজরা পোকার মথ, পাতা মোড়ানো পোকা মথ ও ফড়িংজাতীয় পোকাগুলো সহজেই ধরে খেতে পারে। এতে পোকা আর বংশ বিস্তার করতে পারে না। পার্চিং দুই ধরনের হয়। জীবন্ত ও মৃত। জীবন্ত পার্চিং হলো ধঞ্চে, ছন, পাট এবং মৃত পার্চিং হলো বিভিন্ন ধরনের মৃত ডাল-পালা দিয়ে পাখির জন্য আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলা। ইতোমধ্যেই মাঠে সবুজের সমারোহ দেখা যাচ্ছে।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও পোকা-মাকড় থেকে ফসলকে রক্ষা করতে কৃষকদের রাসায়নিক বালাই-নাশকের পরিবর্তে ধানক্ষেতে পার্চিং করে বা ডাল-পালা পুতে পোকা দমন করা সম্ভব এবং পোকার বংশ বিস্তার রোধ করাও সম্ভব। পার্চিং করা ধান ক্ষেতের ডাল-পালায় পাখিরা বসে ধানের ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফসল রক্ষা করে। আর এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে কৃষকদের কৃষি কর্মকর্তারা পরামর্শ ও উৎসাহ দিচ্ছেন। ধানক্ষেতে পার্চিং বা ডাল পোতা জৈবিক পোকা দমন এটি খুবই কার্যকরী পদ্ধতি, ধানক্ষেতে শক্র পোকা যেমন মাজরা, গান্ধি, চুঙ্গি পোকাসহ বাদামি গাছফড়িং নিধনে বিশেষ করে মাজরা পোকার আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করতে এটি খুবই কার্যকর পদ্ধতি।
একটি মাজরা পোকার মথ ২০০ থেকে আড়াইশ ডিম পাড়ে। ডিম থেকে কিড়া বের হয়ে একটি করে ধানের কুশি কাটে। যা কৃষককে খুব ক্ষতি করে আর এই ক্ষতিকারক পোকার মথ পার্চিং করা ডালে বসে পাখি খেয়ে ফেলে। এটি পরিবেশবান্ধব হওয়ায় কৃষকরা একটু চেষ্টা করে জমিতে ডাল-পালা পুতে দিলেই হলো।
পার্চিং পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে ফসলের রোগবালাই দমন যেমন সহজভাবে করা যায় তেমনি অর্থও সাশ্রয় হয়। পাশাপাশি জমির উর্বরতাও বৃদ্ধি পায়। কেননা কীটনাশক ব্যবহারে জমির উর্বরতা হ্রাসসহ মৎস্য প্রজননে মারাত্মক ক্ষতি করে। এ ছাড়া কীটনাশকের মূল্যও অনেক বেশি। তাই ধান চাষে পার্চিং পদ্ধতির প্রতি কৃষকদের আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৬মার্চ২০