অর্জুন গাছের যত গুণ

2411

92097804_1413707815468856_6945165076311572480_n
ভেষজ শাত্রে ঔষধি গাছ হিসাবে অর্জুনের ব্যবহার অগনিত। বলা হয়ে থাকে, বাড়িতে একটি অর্জুন গাছ থাকা আর এক জন ডাক্তার থাকা একই কথা। এর ঔষধি গুন মানবসমাজের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে সুপ্রাচীন কাল থেকেই।

ভেষজ শাস্ত্রে ঔষধি গাছ ( অর্জুন গাছের পরিচিতি )
অর্জুন একটি পত্রঝরা মাঝারি ধরনের বৃক্ষ। পরিণত বয়সে একটি গাছ ১০-১৫ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। গোড়ায় অধিমূল আছে। গাছের কাণ্ড একধিক ভাঁজ বা স্তর যুক্ত। বাকল পাতলা স্তরে বিভক্ত। পাতা লম্বাটে ৭.৫ – মে সে. মি. ফুল হলুদাভ ও স্পাইক সোজা এবং ফুলের পাপড়ি নাই। ফল লম্বাটে ৫টি ভাজ ও পাখায় বিভক্ত।

চলুন জেনে নেই পারিবারিক ডাক্তার অর্জুনের ঔষধি গুনাগুন……

হৃদরোগ অর্জুনের ব্যবহার

অর্জুনের প্রধান ব্যবহার হৃদরোগে। অর্জুন ছালের রস কো-এনজাইম কিউ-১০ সমৃদ্ধ। এইকো-এনজাইম কিউ-১০ হৃদরোগ এবং হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করে। বাকলের রস ব্লাডপ্রেসার এবং কোলেস্টেরল লেভেল কমায়।

অর্জুনের ছাল বেটে রস খেলে হৃদপিন্ডের পেশি শক্তিশালী হয় এবং হৃদযন্ত্রের ক্ষমতা বাড়ে। বাকলের ঘন রস দুধের সাথে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেতে হবে।বাকলে রস না থাকলে শুকনো বাকলের গুঁড়া ১-২ গ্রাম দুধের সাথে মিশিয়ে সকালে খালিপেটে খেতে হবে।

রক্ত নিম্নচাপ ও রক্তক্ষরন কমাতে

রক্তে নিম্ন চাপ থাকরে অর্জুনের ছালের রস সেবনে উপকার হয়। রক্তক্ষরণে ৫-৬গ্রাম ছাল রাতে জলে ভিজিয়ে রেখে সকালে ছেকে জল খেলে আরোগ্য হয়।

হাঁপানি ও হার্ণিয়া

এছাড়া হাঁপানিতে অর্জুন ফল টুকরো করে তামাকের মত ধোঁয়া টানলে উপকার হয়। হার্নিয়াতে অর্জুন ফল কোমরে বেঁধে রাখলে উপকার পাওয়া যায়। কাঁচা পাতার রস সেবনে আমাশয় রোগ ভাল হয়।

হৃদপিন্ডের দুর্বলতা ও সাধারণ দুর্বলতায়

৩-৪ গ্রাম অর্জুন ছাল চূর্ণ প্রত্যহ দুবার এক গ্লাস পরিমাণ দুধসহ সেব্য । এক মাস নিয়মিত সেবন করে যাওয়া আবশ্যক।

রক্ত আমাশয় নিরাময়ে

কাচাঁ অর্জুনের ছাল ৫ গ্রাম পরিমাণ নিয়ে ভালোভাবে পিষে ঠাণ্ডা জলসহ দিনে দুবার খেলে রক্ত আমাশয়ে বিশেষ উপকারী

লো – ব্লাড্প্রেসারে

উপরিউক্ত পদ্ধতিতে তৈরীকরে খেলে প্রেসার স্বাভাবিক হয়।

যাঁদের প্রস্রাবের সঙ্গে Puscell বা পুঁজ বেশী যায়, তাঁরা ৩/৪ গ্রাম শুকনো অর্জুন ছাল আধপোয়া আন্দাজ গরম জলে ৪/৫ ঘন্টা ভিজিয়ে পরে ছেঁকে তার সঙ্গে একটু রান্না করা বার্লি মিশিয়ে খেলে ওটা চলে যাবে।

ফোঁড়া

ফোঁড়া হলে পাতা দিয়ে ঢেকে রাখলে ফোঁড়া ফেটে যায়, তারপর পাতার রস দিলে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়।

ক্ষত বা ঘা

শরীরে ক্ষত বা ঘা হলে, খোস-পাঁচড়া দেখাদিলে অর্জুনের ছালের ক্বাথ দিয়ে ধুয়ে ছালেরমিহি গুঁড়া জল দিয়ে মিশিয়ে লাগালে দ্রুত ঘা সেরে যায়।

কানের ব্যথায়

কানের ব্যথায় অর্জুন ব্যবহার করা হয়। কচি পাতার রস কানের ভিতরে দুই ফোঁটা করে দিলে কানের ব্যথা ভালো হয়।

অ্যাজমা

অর্জুন ছালের পাউডার ১২ গ্রাম দুধের ক্ষীর বা পায়েসের সাথে মিশিয়ে খেলে অ্যাজমা আক্রান্ত ব্যক্তির অ্যাজমা রোগের স্থায়ী সমাধান হবে।

ক্ষয়কাশে

অর্জুন ছালের গুঁড়া, বাসক পাতার রসে ভিজিয়ে শুকিয়ে রাখতেন প্রাচীন বৈদ্যেরা। দমকা কাশি হতে থাকলে একটু ঘি ও মধু বা মিছরির গুঁড়া মিশিয়ে খেতে দিতেন। এতে কাশির উপকার হতো।

হাড় মচকে গেলে বা চিড় খেলে

অর্জুন ছাল ও রসুন বেটে অল্প গরম করে মচকানো জায়গায় লাগিয়ে বেঁধে রাখলে সেরে যায়। তবে সেই সাথে অর্জুন ছালের চূর্ণ ২-৩গ্রাম মাত্রায় আধা চামচ ঘি ও সিকি কাপ দুধ মিশিয়ে অথবা শুধু দুধ মিশিয়ে খেলে আরও ভালো হয়।

ত্বকের পরিচর্যা

ত্বকে ব্রণের ক্ষেত্রে অর্জুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছালের চূর্ণ মধুর সাথে মিশিয়ে ব্রণের উপর লাগালে খুব দ্রুত উপকার হয়। এছাড়া ছালের মিহি গুঁড়া মধু মিশিয়ে লাগালে মেচতার দাগ দূর হয়।

বুক ধড়ফড়

যাদের বুক ধড়ফড় করে অথচ উচ্চ রক্তচাপ নেই, তাদের পক্ষে অর্জুন ছাল কাঁচা হলে ১০-১২ গ্রাম, শুকনা হলে ৫-৬ গ্রাম একটু ছেঁচে২৫০ মিলি দুধ ও ৫০০ মিলি জলের সাথে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে আনুমানিক ১২৫ মিলি থাকতে ছেঁকে বিকাল বেলা খেলে বুক ধড়ফড়ানি অবশ্যই কমবে। তবে পেটে যেন বায়ু না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

রক্তপিত্তে

মাঝে মাঝে কারণে বা অকারণে রক্ত ওঠে বা পড়ে। সেক্ষেত্রে ৪-৫ গ্রাম ছাল রাতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে ছেঁকে নিয়ে পানিটা খেলে উপকার পাওয়া যায়।

শ্বেত বা রক্তপ্রদরে

উপরিউক্ত মাত্রা মত ছাল ভিজানো জল আধ চামচ আন্দাজ কাঁচা হলুদের রস মিশিয়ে খেলে উপশম হয়।

মাড়ির রক্তপাত বন্ধে

এই ছাল মুখ, জিহ্বা ও মাড়ির প্রদাহের চিকিত্‍সায় ব্যবহৃত হয়, এটি মাড়ির রক্তপাত বন্ধ করে।

জ্বর কমাতে

এটি সংকোচন ও জ্বর রোধক হিসেবেও কাজ করে।

শুক্রমেহে (Spermatorrhoea)

অর্জুন ছালের গুড়ো ৪/৫ গ্রাম আধ পোয়া আন্দাজ গরম জলে ৪/৫ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর ছেঁকে ঐ জলে আন্দাজ ১ চামচ শ্বেতচন্দন ঘষা মিশিয়ে খেলে উপকার হয়।

যৌন রোগে

যাদের মধ্যে যৌন অনীহা (Lack of Libido) দেখা দেয় তাদের ক্ষেত্রে অর্জুনের ছাল চূর্ণ উপকারী। এই ছাল চূর্ণ দুধের সাথে মিশিয়ে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিত খেলে এই রোগদূর হয়।

এছাড়া যাদের শুক্রমহ (Spermatorrhoea) আছে তারা অর্জুন ছালের গুঁড়া ৪-৫ গ্রাম ৪-৫ ঘণ্টা আধা পোয়া গরম জলে ভিজিয়ে রেখে, তারপর ছেঁকে ওই জলের সাথে ১ চামচ শ্বেতচন্দন মিশিয়ে খেলে উপকার হয়।

দন্তরোগে

দাঁত নড়া, দাঁত দিয়ে রক্ত পড়া, ঠান্ডা বা গরম জলে দাঁত শিরশির করা, দাঁতের গোড়া ফুলে যাওয়া, মুখের দুর্গন্ধসহ যাবতীয় দন্তরোগের ক্ষেত্রে অর্জুন ফল,অর্জুন ছাল, নারিকেল গাছের নতুন শিকড় সবগুলো একত্রে জাল দিয়ে গাদ তৈরি করে নিতে হবে। তারপর এতে সামান্য পরিমাণ কর্পূর মিশিয়ে প্রত্যহ দু’বার ওই দ্রবণ মুখের ভেতর গড়গড়ালে দন্তরোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।

এছাড়াও ২০০ গ্রাম অর্জুন ছাল চূর্ণ, ২০ গ্রাম লবঙ্গ, ২০ গ্রাম কাবাব চিনি, ৫০গ্রাম নিমের ছাল, ৫০ গ্রাম নারিকেল গাছের শিকড়, ১ গ্রাম কর্পূর, ১ গ্রাম পিপারমেন্ট সবগুলো উপাদান একত্রে মিশায়ে পাউডার প্রস্তুত করে নিয়মিত সকাল ও রাতে দাঁতব্রাশ করলে দন্তরোগ থেকে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হওয়া যায়।

হজম ক্ষমতা বাড়ায়

ডায়রিয়া বা পেটের অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিলে অর্জুনের ছাল ৪৫-৩০ গ্রাম করে খেলে হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও অসুবিধা দূর হয়। মুখ, জিহ্বা ও মাড়ির প্রদাহে অর্জুনের ছাল এসব রোগের চিকিত্‍সায় ব্যবহৃত হয়। এটি মাড়ির রক্তপাতও বন্ধ করে। অর্জুনের ছাল সংকোচক ও জ্বর নিবারক হিসেবেও কাজ করে।

এছাড়াও এর রয়েছে অনেক ঔষধিগুণ। ইদানিং অর্জুন গাছের ছাল থেকে ‘অর্জুন চা’তৈরি হচ্ছে যা হৃদরোগের জন্য অত্যন্তকার্যকরী। DOS থেরাপি অনুযায়ী অর্জুন ফল দেখতে মানব দেহের হৃদপিন্ডের মতো তাই অর্জুনকে হৃদরোগের মহৌষধ বলা হয়।

ভারত, পাকিস্তান,শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ অর্জুনের আদি নিবাস। বাংলাদেশের সর্বত্রই পাওয়া যায়। ভেষজ শাত্রে ঔষধি গাছ অর্জুন নিচু ও স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় ভাল জন্মায়।

ফার্মসএন্ডফার্মার/০১ এপ্রিল২০