বাংলাদেশে কৃষিপণ্য উৎপাদনে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের বিষয়টি প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের জন্য নিঃসন্দেহে ভীতিপ্রদ। কেননা, কীটনাশক ও রাসায়নিকের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে প্রায় সবাই কম-বেশি অবগত। বিশেষজ্ঞরাও বার বার এসবের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সতর্ক করে আসছেন। রাসায়নিক ও কীটনাশক যে জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, চাষিরাও যে তা জানেন না তেমনটিও নয়। অথচ জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে কৃষকরা এসব প্রয়োগ করে থাকেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিষমুক্ত সবজি চাষেও কৃষকরা এগিয়ে আসছেন। যা অবশ্যই ইতিবাচক।
অনস্বীকার্য যে, নিরন্তর জনসংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই তুলনায় কৃষি জমি ও চাষাবাদ বাড়ানো সম্ভব নয়। এটা শুধু আমাদের নয়, গোটা বিশ্বেরই সমস্যা। ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা পূরণ করতে উচ্চফলনশীল ফসলের চাষাবাদের ওপর জোর দেয়া হয়েছে কয়েক দশক আগে থেকেই। এই চাষাবাদের প্রয়োজনেই দেখা দিয়েছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের। যদিও এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর দিক কয়েক দশক ধরেই আলোচিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে জমির গুণগত মান বুঝে কী পরিমাণ কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের প্রয়োগ দরকার বেশির ভাগ কৃষকই তা যথাযথভাবে জানেন না। যে কারণে এসবের ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত। বেসরকারি বিভিন্ন জরিপেরও চাষাবাদে ক্ষতিকর এসব উপাদান ব্যবহারের সূচক ঊর্ধ্বমুখী। বিষয়টি সঙ্গত কারণে উদ্বেগের জন্ম দেয়। এর মধ্যে কীটনাশকবিহীন সবজি চাষের খবর আমাদের আশান্বিত করে।
যশোর জেলার বড় একটা অংশে ‘ফেরোমন ট্রাপ’ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে প্রথম বিষমুক্ত সবজি চাষ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখন এ পদ্ধতিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করছেন কৃষকরা। এ প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ বাংলাদেশের কৃষিবিদদের যেমন এক অনন্য সাফল্য, তেমনি দেশের জনসাধারণের জন্যও যে হিতকর, তা নতুন করে বলার কিছুই নেই। আমরা লক্ষ্য করেছি, যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে শুরু করে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন প্রক্রিয়া মাগুরা, ঝিনেদা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঢাকার ধামরাইসহ বিভিন্ন জেলায় সম্প্রসারিত হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার জিলেরডাঙ্গা গ্রামের ৫০০ কৃষক ৬ বছর ধরে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করে চলেছেন। শুধু বিষমুক্ত সবজিই নয়, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জমির আলের ওপর সবচি চাষ করেও সফলতা পেয়েছেন এ গ্রামের চাষিরা। বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। আমরা এ গ্রামের চাষিদের অভিনন্দন জানাই।
চাষিরা সবজি উৎপাদনে পোকা-মাকড় দমনের জন্য কীটনাশকের পরিবর্তে যে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করেন তা কৃষকদের কাছে ‘জাদুর ফাঁদ’ নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে সবজি চাষে খরচও কমে আসে তিন ভাগের এক ভাগ। ফলনও হয় বেশি। সবজির চেহারাও হয় সতেজ। কেঁচো ও গোবর দিয়ে তৈরি ভার্মি কম্পোস্টও রাসায়নিক সারমুক্ত চাষাবাদের জন্য জনপ্রিয় পদ্ধতি। আর পোকা দমনের জন্য ভেষজ উপকরণ যেমন, নিমপাতা, বিষকাঁটালি, পিতরাজ, থানকুনি, ধুতুরা, ভেরেন্ডার নির্যাসও ব্যবহার করা হয়। আমরা মনে করি স্বাস্থ্যবান্ধব এই চাষাবাদে বিপ্লব ঘটানো এখন সময়ের দাবি।
সর্বোপরি বলতে চাই, এ প্রক্রিয়ায় কৃষিবিদদের সাফল্য এবং চাষিদের আগ্রহ- কোনোটারই ঘাটতি নেই, সারাদেশে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট। সুতরাং সরকার তথা সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার আরো সহজলভ্য করে চাষিদের মধ্যে এ প্রযুক্তি উপস্থাপন। পাশাপাশি রাসায়নিক ও কীটনাশকের সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর দিক সম্পর্কেও জনগণকে সচেতন করা জরুরি। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিষমুক্ত সবজি চাষের পাশাপাশি অন্যান্য ফসলও কিভাবে ‘বিষমুক্ত’ভাবে উৎপাদন করা যায় তার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সরকার পদক্ষেপ নেবে বলেই আমরা আশাবাদী।
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৪এপ্রিল২০