বিজ্ঞানভিত্তিক ষ্টল ফিডিং পদ্ধতিতে ছাগল পালন

645

বাংলাদেশে ছাগল পালনের ক্ষেত্রে সাধারণত ছাগলকে ছেড়ে বা মাঠে বেঁধে খাওয়ানো হয়। গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত বিজ্ঞানভিত্তিক বাসস্থান, খাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অনুসারে ছাগল পালনের প্যাকেজ প্রযুক্তিকে স্টল ফিডিং পদ্ধতি বলা হয়।

স্টল ফিডিং পদ্ধতির করণীয়ঃ

ছাগল নির্বাচনঃ এ পদ্ধতিতে ছাগল খামার করার উদ্দেশ্যে ৬-১৫ মাস বয়সী স্বাভাবিক ও রোগমুক্ত ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের পাঁঠা/ছাগী সংগ্রহ করতে হবে। পাঁঠার বয়স ৫-৭ মাস হতে পারে।

ছাগলের ঘরঃ স্টল ফিডিং পদ্ধতিতে প্রতিটি বয়স্ক ছাগলের জন্য প্রায় ১০ বর্গফুট ঘরের জায়গা প্রয়োজন। ঘরটি বাঁশ, কাঠ বা ইটের তৈরী হতে পারে। শীতের রাতে ঘরের বেড়া চট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং মেঝেতে খড় বিছিয়ে দিতে হবে।

ছাগলকে ঘরে থাকতে অভ্যস্ত করানোঃ ছাগল সংগ্রহের সাথে সাথেই সম্পূর্ণ আবদ্ধ অবস্থায় রাখা উচিত নয়। প্রথমে ছাগলকে দিনে ৬-৮ ঘন্টা চরিয়ে বাকী সময় আবদ্ধ অবস্থায় রেখে পর্যাপ্ত খাদ্য (ঘাস ও দানাদার খাদ্য) সরবরাহ করতে হবে। এভাবে ১-২ সপ্তাহের মধ্যে চরানোর সময় পর্যায়ক্রমে কমিয়ে সম্পূর্ণ আবদ্ধ অবস্থায় রাখতে হবে। তবে বাচ্চা বয়স থেকে আবদ্ধ অবস্থায় রাখলে এ ধরনের অভ্যস্ততার প্রয়োজন নেই।

বাচ্চার পরিচর্যাঃ জন্মের পরপরই বাচ্চাকে পরিষ্কার করে শাল দুধ খাওয়াতে হবে। এক মাস পর্যন্ত বাচ্চাকে দিনে ১০-১২ বার দুধ খাওয়াতে হবে। বাচ্চার চাহিদার তুলনায় কম দুধ থাকলে প্রয়োজনে অন্য ছাগী থেকে দুধ খাওয়াতে হবে। তাছাড়া দুধ না পাওয়া গেলে বাচ্চাকে মিল্ক রিপেৱসার খাওয়াতে হবে। দুধ খাওয়ানোর আগে ফিডার, নিপলসহ আনুসাংগিক জিনিসপত্র পানিতে ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।

১-১.৫ কেজি ওজনের একটি ছাগল ছানার দৈনিক ২৫০-৩৫০ গ্রাম দুধ প্রয়োজন। ওজন বৃদ্ধিও সাথে সাথে দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। বাচ্চার বয়স ৬০-৯০ দিন হলে দুধ ছেড়ে দেবে। সাধারণত ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগীকে প্রয়োজনমত খাওয়ালে বাচ্চার প্রয়োজনীয় দুধ পাওয়া যায়। বাচ্চার ১ মাস বয়স থেকেই ধীরে ধীরে কাঁচা ঘাস এবং দানাদার খাদ্যে অভ্যস্ত করতে হবে।

স্টল ফিডিং পদ্ধতিতে ছাগলকে খাওয়ানোঃ

ছাগল সাধারণতঃ তার ওজনের ৪-৫% হারে খেয়ে থাকে। এর মধ্যে ৬০-৮০% আঁশ জাতীয় খাবার (ঘাস, লতা, পাতা, খড় ইত্যাদি) এবং ২০-৪০% দানাদার খাবার (কুড়া, ভূষি, চাল, ডাল ইত্যাদি) দিতে হবে। একটি বাড়ন্ত- খাসীকে দৈনিক ১-১.৫ কেজি কাঁচা ঘাস এবং ২০০-২৫০ গ্রাম দানাদার খাবার (সারণী-১) দিতে হবে। দুই থেকে তিন বাচ্চা বিশিষ্ট ২৫ কেজি ওজনের ছাগীর দৈনিক প্রায় ১.৫-২.৫ কেজি কাঁচা ঘাস এবং ৩৫০-৪৫০ গ্রাম দানাদার খাদ্য প্রয়োজন হয়। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক পাঁঠার দৈনিক ১.৫-২.৫ কেজি কাঁচা ঘাস এবং ২০০-৩০০ গ্রাম দানাদার খাদ্য প্রয়োজন।

সারণী-১: ছাগলের দানাদার খাদ্যের সাধারণ মিশ্রন (%)

খাদ্য উপাদান শতকরা হার (%)
চাল/গম/ভুট্টা ভাঙ্গা ১২.০০
গমের ভূষি/আটা/কুঁড়া ৪৭.০০
খেসারী/মাসকালাই/অন্য ডালের ভূষি ১৬.০০
সয়াবিন/তিল/নারিকেল/সরিষা/খৈল ২০.০০
শুটকি মাছের গুড়া ১.৫০
ডাই-ক্যালসিয়াম ফসফেট ২.০০
লবণ ১.০০
ভিটামিন মিনারেল প্রিমিক্স ০.৫০
বিপাকীয় শক্তি (মেগাজুল/কেজি) ১০.০০
বিপাকীয় প্রোটিন (গ্রাম/কেজি) ৬২.০০
ছাগলের জন্য ঘাস চাষঃঘাস সরবরাহের জন্য বিভিন্ন জাতের দেশী ঘাস খাওয়ানো যায়। ইপিল ইপিল, কাঁঠাল পাতা, খেসারী, মাসকালাই, দুর্বা, বাকসা ইত্যাদি দেশী ঘাসগুলো বেশ পুষ্টিকর। এছাড়া উচ্চ ফলনশীল নেপিয়ার, স্পেনডিডা, এন্ড্রোপোগন, পিকাটুলুম ইত্যাদি ঘাস আবাদ করা যেতে পারে।

ছাগলকে খড় খাওয়ানোঃ ঘাস না পাওয়া গেলে খড়কে ১.৫-২.০ ইঞ্চি (আঙুলের দুই কর) পরিমানে কেটে নিমেড়ব বর্ণিত পদ্ধতিতে পক্রিয়াজাত করে খাওয়ানো যেতে পারে। এজন্য ১ কেজি খড়ের সাথে ২০০ গ্রাম চিটাগুড়, ৩০ গ্রাম ইউরিয়া ৬০০ গ্রাম পানির সাথে মিশিয়ে ইউএমএস তৈরী করে খাওয়ানো যেতে পারে। এর সাথে এ্যালজি উৎপাদন করে দৈনিক ১-১.৫ লিটার পরিমানে খাওয়াতে হবে। একটি ছাগল দৈনিক ১.০-২.০ লিটার পানি খায়। এজন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।

পাঁঠার ব্যবস্থাপনাঃ যেসব পাঁঠা বাচ্চা প্রজনন কাজে ব্যবহার করা হবে না তাদেরকে জন্মের ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে খাসী করানো উচিত। পাঁঠাকে যখন প্রজনন কাজে ব্যবহার করা হয় না তখন তাকে পর্যাপ্ত পরিমানে শুধু ঘাস খাওয়ালেই চলে। তবে প্রজনন কাজে ব্যবহারের সময় ওজন ভেদে ঘাসের সাথে ২০০-৫০০ গ্রাম পরিমান দানাদার খাবার দিতে হবে। পাঁঠাকে প্রজননক্ষম রাখার জন্য প্রতিদিন পাঁঠাকে ১০ গ্রাম পরিমাণ গাঁজানো ছোলা দেয়া উচিত। পাঁঠাকে কখনই চর্বিযুক্ত হতে দেয়া যাবে না।

ছাগলের স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনাঃ সব ছাগলকে বছরে দু’বার (বর্ষার শুরু এবং শীতের শুরুতে) কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। ছাগলের মারাত্মক রোগ, যেমনঃ পিপিআর, গোটপক্স হলে অতি দ্রুত নিকটস্থ পশুহাসপাতালে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া ছাগলে তড়কা, হেমোরেজিক সেপ্টিসেমিয়া, এন্টারোটক্সিমিয়া, বিভিনড়ব কারণে পাতলা পায়খানা এবং নিউমোনিয়া হতে পারে। সঠিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এ সকল রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে সুস্থ ছাগলের জন্য একথাইমা রোগের ভ্যাকসিন জন্মের ৩য় দিন ১ম ডোজ এবং ২য় ডোজ জন্মের ১৫-২০ দিন পর দিতে হবে, পিপিআর রোগের ভ্যাকসিন ৪ মাস বয়সে এবং গোট পক্সের ভ্যাকসিন ৫ মাস বয়সে দিতে হবে।

জৈব নিরাপত্তাঃ খামারে কোন নতুন ছাগল আনতে হলে অবশ্যই রোগমুক্ত ছাগল সংগ্রহ করতে হবে এবং ১৫ দিন খামার থেকে দূরে অন্যত্র রেখে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোন রোগ দেখা না দিলে ১৫ দিন পর পিপিআর ভ্যাকসিন দিয়ে ছাগল খামারে রাখা যাবে। অসুস্থ ছাগল পালের অন্য ছাগল থেকে দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।

ছাগলের প্রজনন ব্যবস্থাপনাঃ ছাগলের ঘর নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। সকল ছাগলকে বছরে ৫-৬ বার ০.৫% ম্যালাথায়ন দ্রবণে চুবিয়ে চর্মরোগ মুক্ত রাখতে হবে। পাঁঠী ১২-১৩ কেজি ওজন (৭-৮ মাস বয়স) হলে তাকে পাল দেয়া যেতে পারে।

পাঁঠী বা ছাগী গরম হওয়ার ১২-১৪ ঘন্টা পর পাল দিতে হয়। অর্থাৎ সকালে গরম হলে বিকেলে এবং বিকেলে হলে পরদিন সকালে পাল দিতে হবে। পাল দেয়ার ১৪২-১৫৮ দিনের মধ্যে সাধারণত বাচ্চা দেয়। পাল দেয়ার জন্য নির্বাচিত পাঁঠা সবসময় নিঃরোগ, ভাল বংশের ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের হতে হবে। ‘‘ইনব্রিডিং’’ এড়ানোর জন্য ছাগীর বাবা বা দাদা বা ছেলে বা নাতীকে দিয়ে প্রজনন করানো যাবে না।

ছাগলের বাজারজাতকরণঃ সুষ্ঠু খাদ্য ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় ১২-১৫ মাসের মধ্যে খাসি ২০-২২ কেজি ওজনের হয়। এসময় খাসী বিক্রি করা যেতে পারে। অথবা খাসির মাংস প্রক্রিয়াজাত করেও বিক্রি করা যেতে পারে।

সূত্র: তথ্য আপা প্রকল্প

ফার্মসএন্ডফার্মার/০৭এপ্রিল২০