পামঅয়েল বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় ভোগ্য ভোজ্যতেল। আর প্রতি হেক্টর জমিতে পামঅয়েলের উৎপাদন সয়াবিনের থেকে প্রায় ১০ গুণ বেশি। পৃথিবীতে বর্ধিত জনসংখ্যার ভোজ্যতেলের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে পামঅয়েল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। আবার পুষ্টির চাহিদা পূরণেও পামঅয়েলের ভূমিকা অনেক। আর এসব কারণেই সয়াবিনের স্থান দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে পামঅয়েল। কেবল আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই পামঅয়েল খাওয়ার প্রবণতা কয়েকগুণ বেড়েছে। এ জন্য বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে সরকারি উদ্যোগে পাম গাছ থেকে তেল পাওয়ার জন্য ২০ লাখের অধিক পামঅয়েল চারা রোপণ করা হয়েছিল।
এ ছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্যোগে- সিলেট, দিনাজপুর, পাবত্য অঞ্চলেও লাগানো হয়েছিল প্রচুর পামগাছ। কিন্তু যন্ত্রের অভাবে গাছ থেকে তেল প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হচ্ছিল না। এর প্রধান কারণ ছিল বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মেশিনের দাম ছিল অনেক বেশি। যা ছোট কৃষকের একার পক্ষে কেনা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে দেশের বাহির থেকে মেশিন কেনা হলেও তা এ দেশের কৃষকের জন্য উপযোগী ছিল না। এতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন পামচাষিরা। এসব বিষয়কে মাথায় রেখে পামঅয়েল প্রক্রিয়াজাতকরণ মেশিন উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল আওয়াল।
আর এ দেশীয় প্রযুক্তি ও কাঁচামাল দিয়ে উদ্ভাবিত এই মেশিন দিয়েই প্রক্রিয়াজাত শুরু হয়েছে পামঅয়েলের। এতে করে পামচাষিদের মধ্যে নতুন করে পাম চাষে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সারাদেশে মেশিনটি ছড়িয়ে দিতে পারলে পামঅয়েল উৎপাদনে বিপ্লব সাধিত হবে। রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও ভূমিকা রাখতে পারবে পামঅয়েল বলেও জানিয়েছেন এই উদ্ভাবক। মেশিনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে উদ্ভাবক বলেন, এটি তৈরি করা অনেকটা চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল। কারণ মেশিনের একটু এদিক সেদিক হলে তেল প্রক্রিয়াজাতকরণে অনেক সমস্যা হতো। প্রথমে ডিজাইন থিউরির ওপরে ভিত্তি করে মেশিনটির অটোক্যাড ডিজাইন করা হয়। মেশিনের জন্য স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য ও গুণগতমান সম্পন্ন কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে করে মেশিনটি টেকসই ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
সহজে যেন কৃষকরা এটি ব্যবহার করতে পারে সেটির দিকেও যথেষ্ট নজর ছিল আমার। পামঅয়েলের ব্যাঞ্চ কাটা থেকে ক্রুড ওয়েল তৈরি করতে যত কম সময় লাগে, ততই তেলের উৎপাদন বেশি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সময়োপযোগী মেশিনের অভাবে এটি করা যাচ্ছিল না। এতে কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন এমনকি এটি চাষের আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে মেশিনটি উদ্ভাবিত হওয়ায় নতুনভাবে এটির সুযোগ তৈরি হলো। এখন থেকে ছোট ছোট পামচাষিরাও এটি ব্যবহার করে সুফল পাবেন। সারাদেশে এটি পৌঁছাতে পারলে বাহির থেকে পামঅয়েল আমদানি তো বন্ধ হবেই এমনকি বিদেশেও রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিত্যক্ত সমুদ্র অঞ্চলে ও পাবর্ত্য অঞ্চলের পরিত্যক্ত জমিতে পাম গাছ রোপণ করা গেলে পামঅয়েলের চাহিদা মেটানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে লাখ লাখ বেকারের কর্মস্থানও হবে বলে মনে করেন এই উদ্ভাবক। তিনি আরো জানান, পাম ফলকে প্রক্রিয়াজাত করে দুধরনের তেল পাওয়া যায়।
ফলটির মাংসল অংশ (মেসোকার্প) থেকে পামঅয়েল আহরণ করা হয়, আর বীজ বা শাঁস থেকে পাওয়া যায় পাম কার্নেল তেল। প্রতিটি ফল থেকে ৯ ভাগ পাম তেল ও ১ ভাগ পাম কার্নেল তেল পাওয়া যায়। সংগৃহীত তাজা ফলকে দ্রুত কারখানায় নিয়ে স্টেরিলাইজ ও গুচ্ছবিহীন করার পর মাড়াই করে অপরিশোধিত তেল আহরণ করা হয়। চূড়ান্ত পরিশোধনের পর তেল খাদ্যে ব্যবহার উপযোগী স্বর্ণাভ তেলে পরিণত হয়। একটি সরল পৃথকীকরণ প্রক্রিয়ায় তরল পাম অলিন ও জমাট পাম স্টিয়ারিনকে পৃথক করা যায়। কোনো দ্রাবক ছাড়াই শুধুমাত্র যান্ত্রিক ও ভৌত প্রক্রিয়ায় পাম তেল আহরণ করা হয় বলে পাম তেল একান্তভাবেই প্রাকৃতিক। আর এ মেশিনটি উদ্ভাবন করার মাধ্যমে পামঅয়েল প্রাপ্তি আরো সহজ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৮এপ্রিল২০