সভ্যতার আদি শ্রমিক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের জন্য উৎপাদন করে যাচ্ছে খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্য। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতোই বলতে চাই-
“গাহি তাহাদের গান- ধরণীর হাতে দিল যারা আনি’ ফসলের ফরমান”
বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের কৃষি ও কৃষক। শিল্প বিপ্লবের পর অন্যান্য শিল্পের বিস্তার বাড়ার ফলে কিছুটা কমতে থাকে কৃষির প্রভাব। এখনও বহুদেশে কৃষিখাত প্রধানতম ও উল্লেখযোগ্য খাত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। শুধু খাদ্য উৎপাদনই নয় অন্যান্য অনেক শিল্পের কাঁচামালের মূল যোগানও আসে কৃষি থেকে। কৃষিপণ্য রপ্তানি করে প্রতি বছর বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও নেহাত কম নয়। সারাবছর এমনকি যেকোন দুর্যোগকালীন সময়ে এই খাতই হয়ে উঠে দেশের মানুষকে বাঁচানোর নির্ভরতার প্রতীক। যদিও এই শিল্পের সাথে জড়িত কারিগড়রা সবসময় থেকেছে অবহেলিত।
১৭ই নভেম্বর ২০১৯, চীনের হুবেই প্রদেশের ইউহানে ৫৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তির শরীরে প্রথম কোভিড-১৯ রোগটি ধরা পড়ে। শুরুর দিকে চীন বিষয়টি চেপে রাখলেও দ্রুত তা বিশ্ব মিডিয়ায় যায়গা করে নেয়। অদৃশ্য করোনা ভাইরাস দ্রুততার সাথে বিশ্ব পরিভ্রমণ করে মানুষকে ঘরবন্দি করতে সক্ষম হয়েছে। সেইসাথে রাষ্ট্রের সমগ্র উৎপাদন খাতকে ফেলেছে হুমকির মুখে। জানি না এই অচল অবস্থা কতদিন চলবে? আশা করছি দ্রুত সুস্থ্য হয়ে উঠবে পৃথিবী। তবে নিশ্চয়ই এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বিশ্ববাসীর উপর। তার ধারাবাহিকতায় হয়তো ফিরে আসতে পারে বিশ্ব মন্দা। রাষ্ট্রসংঘ ও আইএমএফ এর পূর্বাভাস সেরকমই। ঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্ন দাতাদেশ আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে বিভিন্ন সময়। এবারের মহামারিতে দাতা দেশগুলোও আক্রান্ত হয়েছে। তাই তাদের সাহায্যের আশা না করাই শ্রেয়। যদি পাওয়া যায় সেটা ভালো।
তাহলে কিভাবে কাটিয়ে উঠবো আমরা এই সমস্যা?
মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও প্রধানতম চাহিদা হচ্ছে খাদ্য। খাবার ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব। তাইতো যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবার আগে মানুষ এগিয়ে আসে খাদ্য সাহায়তা নিয়ে। আগে বাঁচার ব্যবস্থা তারপর অন্যকিছু। চারিদিকে এখন শুধু অনিশ্চয়তা! এতো অনিশ্চয়তার পরেও আমাদের সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে খাদ্য উৎপাদনে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমান চাল, ডাল, সবজি আছে বিদায় সরকার, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সাধারণ মানুষ সেগুেেলা যাদের দরকার তাদের কাছে কিছুটা হলেও পৌঁছে দিতে পারছে। ধরুণ আপনার হাতে টাকা আছে কিন্তু কেনার মতো পণ্য বাজারে নাই! তখন কি অবস্থা হবে একটু ভেবে দেখুন?
এবার আমনের ফলন ভালো হয়েছে, ২ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরে ধানেরও বাম্পার ফলন আশা করছে সংশ্লিষ্টজনেরা। যদি অতিবৃষ্টি বা আগাম বন্যা না হয়, তাহলে ভাতের চাহিদা পূরণ করতে পারবে আমাদের কৃষকরা। মাছ-মাংস, সবজি, দুধ, ডিম ও অন্যান্য শস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের কৃষকের সাফল্য বলে শেষ করা যাবে না। কয়েকটি কৃষিজ উৎপাদনে বিশ্বের প্রথম সারির ৫টি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। করোনার পাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর মোটামোটি সবাই আমরা ঘরে আছি। কৃষক কিন্তু রোধে ভিজে-বৃষ্টিতে পুড়ে মাঠে আছে। এই মহূর্তে তাদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। যদি কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়, তাহলে দেশ খাদ্য সংকটে পড়বে। মানুষের পেটে খাবার না থাকলে সবকিছু ভেঙে পড়বে। আইন শৃঙ্খলা, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবণ প্রবাহে চরম নৈরাজ্য দেখা দিবে!
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামনের সারিতে আছেন স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টজনরা। আছেন স্থানীয় প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, সামরিক ওআধাসামরিক বাহিনী, ব্যাংকার, মিডিয়াকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং জরুরি সেবার সাথে জড়িত অগনিত বীর। তাদের পরিশ্রমের কোন বিনিময় হয় না। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবার-পরিজনের কথা চিন্তা না করে দেশের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এই মানুষগুলোর জন্য এবং ১৬ কোটি মানুষের খাবার উৎপাদনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে সভ্যতার আদিমতম সেই শ্রমিকরা! যাদের কথা আমরা সারাবছরে একবারও মনে করার সময় পাইনা বা প্রয়োজনবোধ করি না। রবী ঠাকুরের ভাষায় যদি বলতে হয়:
“যাদের আমরা বলি চাষাভুষা, পুঁথির পাতার পর্দা ভেদ করে তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি পৌঁছায় না, তাদের উপস্থিতি আমাদের কাছে অস্পষ্ট। এই জন্যই ওরা আমাদের সকল প্রচেষ্টা থেকে স্বভাবতই বাদ পড়ে যায়।”
বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কৃষি বান্ধব প্রধানমন্ত্রী। তিনি কৃষিকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কৃষকের জন্য অনেক কিছু করেছেনও বটে। সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি ও মৎস্য যান্ত্রিকীকরণ এবং সেচের জন্য ডিজেলে বরারই ভর্তুকি দিয়ে থাকেন। করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপি খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে তাই তিনি কৃষকের জন্য ৫% সুদে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছেন। সেজন্য নিঃসন্দেহে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা-বানিজ্য, শিল্প প্রতিষ্ঠান, গরীব, দিনমজুর ও কর্মহীন মানুষের জন্য তিনি নানাবিধ সুযোগ-সুবিদার কথা তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ইতোপূর্বে সরকার গার্মেন্টস মালিকদের জন্য ২%, ভারী শিল্পের জন্য ৪% সুদে প্রনোদনার প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছেন।
দেশের শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য এটি সময়উপযোগী উদ্যোগ তা একবাক্যে সবাই স্বীকার করবে। কিন্তু কিছু প্রশ্ন সবসময় থেকেই যায়। তর্কের জন্য নয় জানার আগ্রহ বলছি। যেমন সরকারি সাধারণ ছুটি অমান্য করে যখন মালিকরা পোশাক কর্মীদের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য অন্যায়ভাবে ঢাকায় নিয়ে আসলেন। তখন স্যোসাল মিডিয়া ও সংবাদ মাধ্যমের সমালোচনার জবাবে এক পোশাক শিল্প মালিক খুবই দম্ভ করে লাইভে এসে বললেন, তারা শ্রমিকদের পালেন, জনগনের খাবার দেয়…ইত্যাদি ইত্যাদি। এই বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়! আচ্ছা এফবিসিসিআই এর ঐ পরিচালকে যদি প্রশ্ন করি শ্রমিকদের আপনি কিভাবে পালেন? শ্রমিকরা শ্রম দেয় মেহনত করে বিনিময়ে আপনার পারিশ্রমিক দেন। ঠিক একই কথা একজন কৃষক যদি আপনাকে বলে। আপনি কি উত্তর দিবেন? তারাতো পুরো দেশকে ও দেশের মানুষকে খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে।
প্রায় চল্লিশ বছরের একটা শিল্প এর মালিকেরা দেশে-বিদেশে সুপরিচিত। এখানকার শীর্ষ সংগঠনের নেতারা মেয়র, এমপি, মন্ত্রী ও দেশের বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হয়। তারপর সবসময় তাদের প্রনোদনা লাগে, প্রতিটি বাজেটে তাদের জন্য প্রনোদনা রাখতে হয়। দেশে মহামারির সময়ও তাদের সবচেয়ে কম সুদে প্রনোদনা লাগে। বিভিন্ন সুবিধার জন্য সবার আগে তারা সরকারের সাথে দেনদরবার শুরু করেন। ঈদের আগে প্রায়শই অনেক মালিক শ্রমিকদের বেতন দিতে পারে না। শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে। করোনার কারণে বন্ধের সময়ও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। শ্রমিকরা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে।
আর আমাদের কৃষক ঋণের কিস্তি দিতে না পেরে গলায় দড়ি দেয়, বজ্রপাতে মরে মাঠে পড়ে থাকে। বন্যায় মাছ ও ফসল ভেসে গেলে পরিবার পরিজন নিয়ে অভুক্ত থাকে। সারের দাবিতে গুলি খেয়ে মরে। তারপরও তাদের কোন অভিযোগ নাই। হয়তো তারা মাঝে মাঝে অনুযোগ করে অথবা হতাশ হয়ে বলে ২টাকা কেজি টমোটো বিক্রি করি তাও লোক পাই না! তারা কখনো সেলিব্রেটি হতে চায় না, তারা লড়াই করে বেঁচে থাকাতে চায় এবং এই সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে চায় সমস্ত শক্তি শ্রম ভালোবাসা দিয়ে। এরাই আমাদের মানবতার ভেন্টিলেটর। তাদের জন্য নয়, আমাদের নিজেদেরর জন্যই কৃষকের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।
সরকার কৃষকের প্রণোদনার সুদের হার ৫% থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে কমিয়ে আনবে আমরা সেটাই প্রত্যাশা করি। সেইসাথে যথাসময়ে যাতে কৃষকের হাতে টাকাগুলো পৌঁছায় তার নিশ্চয়তার বিধান করতে হবে। কৃষিকের প্রনোদনায় সুদের হার কখনই অন্যদের চেয়ে বেশি হওয়া কাম্য নয়।
আরেকটি বিষয় সাধারণ ছুটির কারণে পণ্য পরিবহণ কিছুটা সংকটের মুখে পড়েছে। তাছাড়া করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বিভিন্ন জেলা লকডাউন করার প্রয়োজন হচ্ছে। এই বিরূপ পরিস্থিতিতেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যাতে মৎস্য ও পশু খাদ্য, সার, বীজ, কীটনাশক, মৎস্য ও পল্ট্রি বীজ, কৃষি ও মৎস্য যন্ত্রপাতি কৃষকের নিকট পৌঁছাতে কোন ধরণের সমস্যা না হয়। পরবর্তী উৎপাদন সচল রাখতে এর কোন বিকল্প নেই। আবার উৎপাদিত খাদ্য শস্য আহরণ ও সংরক্ষণ, ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ-মুরগি, দুধ, ডিম ইত্যাদি প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যাতে প্রয়োজনীয় সব যায়গায় বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছায় সে বিষয়টি যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
সারাদেশে খাদ্য চাহিদার প্রয়োজন মেটানো ও বাজার নিয়ন্ত্রন এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কৃষক যেন তাদের উৎপাদিত পন্যের ন্যায্যমূল্য পায় তা নিশ্চিত করণের মাধ্যমে কৃষককে পরবর্তী উৎপাদনে মনোনিবেশকল্পে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী, পরিবহণ মালিক-শ্রমিক, প্রাশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আমাদেরও নাগরিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তাদের প্রতি সযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। মনে রাখবেন কৃষক বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, মানুষ বাঁচলে দেশ বাঁচবে, অর্থণীতির চাকাও সচল হবে। তাই কৃষকের সুযোগ সুবিদা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত স্বনির্ভর সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে কৃষি শিল্পের বিকাশ তরান্বিত করবো এই হউক আমাদের অঙ্গিকার।
লেখক:
কৃষিবিদ মোঃ আসাদুজ্জামান (আসাদ)
ফার্মসএন্ডফার্মার/২০এপ্রিল২০