টমেটো আমাদের দেশের একটি প্রধান শীতকালীন সবজি, তবে বাংলাদেশে গ্রীস্মকালেও টমেটো সাফল্যজনক ভাবে চাষ করা যায়। আকর্ষনীয়তা, ভাল স্বাদ, উচ্চ পুষ্টিমান এবং বহুবিধ উপায়ে ব্যবহারযোগ্যতার কারণে এটি সারাবিশ্বেরই জনপ্রিয় সবজী। এ সবজীতে প্রচুর পরিমানে আমিষ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-এ এবং ভিটামিন-সি রয়েছে।
জলবায়ু ও মাটি: শীতকালীন টমেটোর ফল ধারণের জন্য সাধারণত দিনে ২০-২৫ ডিগ্রী সে. এবং রাতে ১০-১৫ ডিগ্রী সে. তাপমাত্র প্রয়োজন হয়। তবে ৩০ ডিগ্রী সে. এর উপরে এবং ১০ ডিগ্রী সে. নীচের তাপমাত্র শীতকালীন টমেটো চাষ বিরুপ প্রভাব ফেলে। রাত্রিকালীন তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রী সে. উপরে হলে ফল ধারণ কমে যায় এবং ফলের আকার ছোট হয়ে যায়। টমেটোর জন্য প্রচুর সূর্যালোক প্রয়োজন, মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতের কারণে ফল ধারণে বাধার সৃষ্টি হয়। প্রায় সব ধরনের মাটিতেই টমেটোর চাষ করা যায়। তবে দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি বেশী উপযোগী। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে টমেটো চাষাবাদ হয়। গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষাবাদের জন্য উঁচু, সুনিষ্কাশিত, বেলে দো-আঁশ অথবা দো-আঁশ মাটি উত্তম।
জাতসমূহ: বর্তমানে আমাদের দেশে উদ্ভাবিত ও আমদানীকৃত বেশকিছু শীতকালীন ও গ্রীস্মকালীন জাতের টমেটোর আবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি টমেটো-২ (রতন), বারি টমেটো-৩, বারি টমেটো-৬ (চৈতী), বারি টমেটো-১০ (অনুপমা) ইত্যাদি জাতগুলো শীত মৌসুমে এবং বারি টমেটো-৪,৫, ৬ এবং বারি টমেটো-৯ (লালিমা), গ্রীস্ম মৌসুমে চাষ করা যায়। বারি টমেটো-৬ (চৈতী) জাতটি উভয় মৌসুমেই চাষ করা যায়। এছাড়া শীতকালে চাষযোগ্য অন্যান্য জনপ্রিয় জাত হলো সুপ্রীম সীড কোম্পানীর হাইব্রিড টমেটো এস্ট্রা, হাইব্রিড টমেটো নোভা, ব্রাক সীড এন্টারপ্রাইজের হাইব্রিড জাত তৃপ্তি, নামধারী মালিক সীডস্ এর (রোমা,সুরক্ষা,),ইস্পাহানী সীডস্ এর রতন,ম্যাগস ইকো আর্থ লিমিটেডের (মী রেড রোজ, মী রেড প্রিন্স), এ.আর.মালিক এ্যান্ড কোং (প্রাঃ) লিঃ এর (জেসিকা, ইপক, ডায়নামো, রেডহিট), হাইটম, রুপালি ইত্যাদি।
বীজ বপন ও চারা উৎপাদন: উন্নতমানের ও সুস্থ্য সবল চারা উৎপাদনের জন্য প্রথমে বীজতলায় চারা উৎপাদন করে নিতে হবে। প্রচুর সূর্যালোক, খোলামেলা স্থানে এবং বেলে দো-আঁশ মাটিতে একটু উঁচু করে বীজতলা তৈরী করা উত্তম। নির্দিষ্ট পরিমাপের (২০ গ্রাম) বীজ গজানোর জন্য বীজতলা সাধারণত ৩ মিটার লম্বা এবং ১ মিটার প্রস্থের হয়ে থাকে। তবে বীজের পরিমান বেশী হলে আনুপাতিক হারে বীজতলার প্রস্থ অপরিবর্তিত রেখে দৈর্ঘ্য বাড়ানো যেতে পারে। বীজতলার চারা গোড়া পচা ও ড্যাম্পিং অফ রোগ হতে রক্ষা করার জন্য বীজ বপনের পূর্বে মাটি শোধন করে নিতে হবে। আমাদের দেশে খড়কুটা জ্বালিয়ে সরাসরি তাপ দিয়ে, সৌরতাপে এবং রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগে (প্রতি ১ ভাগ ফরমালডিহাইড এর সাথে ৫০ ভাগ পানি মিশিয়ে প্রতি বর্গমিটারে ১২ লিটার হারে) বীজতলার মাটি শোধন করা যেতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে সুস্থ্য সবল চারা প্রাপ্তির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানান্তর করে টমেটো চারা উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রথম বীজতলায় ৫০ গ্রাম বীজ ঘন করে বপন করতে হয়। বীজ গজানোর ৮-১০ দিন পর গজানো চারা দ্বিতীয় বীজতলায় (৪ সে.মি ৪ সে.মি দুরত্বে) স্থানান্তর করতে হয়। আগাম চাষের জন্য আগষ্ট মাসেই বীজ বপন করতে হয়। নাবি জাতের টমেটো চাষের জন্য নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত বীজ বপন করা যায় । প্রতি হেক্টর জমির জন্য ১৫০-১৭৫ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
জমি তৈরী ও চারা রোপন: শীতকালীন টমেটো চাষের জন্য বর্ষার পর জমিতে জো আসলে ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে ঝুরঝুরে করে নিতে হয়। এক মিটার প্রস্থ দুই বেডের মাঝে ৩০ সে.মি সেচ নালা রাখতে হবে। গ্রীষ্মকালীন চাষের জন্য ২০-২৫ সে.মি. উচু এবং ২৩০ সে.মি. চওড়া বেড তৈরি করতে হয় । বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সুবিধার্থে দুই বেডের মাঝে ৩০ সে. মি. চওড়া নালা রাখতে হয়।
চারা রোপণ: বীজ বপনের ৩০-৪০ দিনের মধ্যে মাঠের চারা রোপণ করতে হয়। সারি থেকে সারির দুরত্ব ৬০ সে. মি. এবং চারা থেকে চারার দুরত্ব ৪০ সে. মি. রাখতে হবে। শীত মৌসুমে চাষের জন্য নভেম্বর থেকে মধ্য জানুয়ারী পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়।
অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা: টমেটোর ভাল ফলন পেতে এবং গাছকে নুয়ে পড়া ও ফল পচন হতে রক্ষার জন্য “ উল্টা- ভি ” ঠেকনা দেয়া প্রয়োজন। সাধারণত বাঁশের বা ধঞ্চার কাঠি এ ক্ষেত্রে খুটি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। টমেটোর গাছ যাতে অত্যাধিক ঝোপালো না হয় সেজন্য অঙ্গ ছাঁটাই করা প্রয়োজন। প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তি সার প্রয়োগের আগে পার্শ্বকুশি ও মরা পাতা ছাঁটাই করে দিতে হয়। গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনমত নিড়ানী দিয়ে আগাছা পরিস্কার ও মাটির উপরিভাগ আলগা করে দিতে হয়। টমেটো চাষের জন্য ৪-৫ বার সেচের প্রয়োজন হয়। মাটির প্রকার ভেদে ১৫-২০ দিন অন্তর সেচ দেয়া দরকার। চারা লাগানোর ৩-৪ দিন পর হালকা সেচ এবং পরবর্তীতে প্রতি কিস্তি সার প্রয়োগের পর জমিতে সেচ দেয়া প্রয়োজন।
রোগবালাই: বীজতলায় সাধারনত ’ড্যাম্পিং অফ’ ও আশুধ্বসা’ রোগের আক্রমন হয়। ড্যাম্পিং অফ একটি ছত্রাক জাতীয় রোগ। এ রোগে আক্রান্ত অংকুরিত চারার রঙ ফ্যাকাসে সবুজ হয় ও কান্ডের নীচের দিকে গাছের গোড়া বরাবর বাদামী রঙের পানি ভেজা দাগ পড়ে। আক্রান্ত চারার গোড়া পচে চারা মারা যায়। আশুধ্বসা রোগ হলে আক্রান্ত পাতার উপর কালো কিংবা বাদামী রঙের বৃত্তাকার দানা পড়ে। ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হলে শেষ পর্যন্ত ফুল ও ফল ঝরে পড়ে। পুস্প মঞ্জুরীর বোঁটা আক্রান্ত হলে ফুল ও অপরিপক্ক ফল ঝরে পড়ে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২২এপ্রিল২০