বাঙালির খাদ্য তালিকায় তিনবেলা যে খাবারটি থাকে তার নাম ভাত। আমরা প্রতিদিন যে সব খাবার খাই সেটা যদি ঠিকঠাক হজম না হয় তাহলে তা শরীরের কোনো কাজেই আসে না। আপনি যে খাবারই খান সেটাকে পরিপাকের মাধ্যমে শরীরের গ্রহণ উপযোগী করে তোলার জন্য সবজির কোনো জুড়ি নেই। সবজি যে কেবল খাবার পরিপাক করতেই সাহায্য করে তা কিন্তু নয়। আমাদের শরীরের জন্য দরকারি অনেক পুষ্টি উপাদানও জোগান দিয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ তার অন্যতম।
একজন সুস্থ সবল মানুষের জন্য প্রতিদিন ২২০ গ্রাম সবজি গ্রহণ প্রয়োজন হলেও বর্তমানে দেশের মানুষ প্রতিদিন গ্রহণ করছেন ৫০ গ্রাম সবজি। এ হিসেবে দৈনিক চাহিদার মাত্র চতুর্থাংশ সবজি খাচ্ছেন মানুষ। কৃষি ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, বিভিন্ন প্রকার খনিজ লবণ ও ভিটামিনের পর্যাপ্ত প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সবজি গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। খাদ্য জগতে বিভিন্ন ধরনের সবজিই একমাত্র খাদ্য শরীর গঠনে যার ইতিবাচক ছাড়া নেতিবাচক কোনো প্রভাব নেই। তাই খাদ্যাভাস পরিবর্তন করে খাদ্য তালিকায় বৈচিত্রময় পাতা ও ফলমূল জাতীয় সবজিকে প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন। নানান ধরনের সবজি উৎপাদনের জন্য আমাদের মাটি খুবই উপযোগী।
শীত ও গ্রীষ্মকালীন সময়ে চাষ করা যায় এমন সবজির তালিকাটাও বেশ বড়। কিন্তু নানান কারণে আমাদের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। যে সব জমি আবাদযোগ্য আছে সেসব জমিতে প্রধান ফসল ধান, পাট কিংবা গমের চাষই প্রাধান্য পায়। সবজি চাষের জন্য বরাদ্দ থাকে রান্না বা গোয়াল ঘরের পেছনের এক চিলতে জমি। অথচ পুষ্টি চাহিদার কথা মাথায় রাখলে সবজি চাষের কথা ভাবতেই হবে। এ জন্য ধান-পাট চাষের মতো অনেক বেশি জমি ব্যবহার করতে হবে তা নয়। সত্যি বলতে কি, কম জমি কাজে লাগিয়ে পুষ্টির চাহিদা পূরণের একমাত্র উপায় সারা বছর সবজির নিবিড় চাষ। আমাদের দেশে বেশির ভাগ সবজি উৎপাদন হয় রবি মৌসুমে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ মাসে। খরিপ মৌসুম অর্থাৎ এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর আবহাওয়া অনুকূল না থাকায় সবজি চাষ খুব কম হয়।
ফলে বাজারে এ সময় সবজির দাম থাকে আকাশ ছোঁয়া। বিশেষ করে মে থেকে জুলাই মাসে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও খরার কারণে সবজির উৎপাদন কম হওয়ার জন্য বাজার মূল্য বেশি থাকে। একটু কৌশল অবলম্বন করলেই কম জমিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে সারা বছর সবজি চাষ করা যায়। মৌসুমে বাজারে সবজির সরবরাহ বেশি থাকায় চাষি ভাইয়েরা ন্যায্য মূল্য পান না। তাই মৌসুম শুরুর আগেই যদি আগাম সবজি উৎপাদন করে বাজারজাত করা যায়, তাহলে দ্বিগুণেরও বেশি দাম পাওয়া যায়। যে কৌশল অবলম্বন করে সারা বছর সবজি চাষ করা বা আগাম শীতকালীন সবজি উৎপাদন করা যায় তার নাম ‘টানেল টেকনোলজি’। সোজা কথায় নৌকার ছইয়ের মতো ছাউনি দিয়ে সবজি চাষ। প্রকৃত মৌসুম ছেড়ে অন্য মৌসুমে সবজি চাষ করার জন্য এই কৌশলের কোনো জুড়ি নেই।
তবে এই কৌশলের মাধ্যমে শীতকালীন সবজিকে গ্রীষ্মকালে চাষ করা কঠিন। কারণ শীতকালীন সবজি চাষের জন্য যে ধরনের তাপমাত্রা প্রয়োজন সেই ধরনের তাপমাত্রা কৃত্রিম পরিবেশে তৈরি করা বেশ ব্যয়বহুল। তবে এই কৌশলের মাধ্যমে কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে গ্রীষ্মকালীন সবজিকে শীতকালে চাষ করা খুবই সহজ। কারণ প্লাস্টিক ছাউনি ব্যবহারের মাধ্যমে শীতকালে খুব সহজেই সৌরশক্তি সঞ্চয় করে তাপমাত্রা বাড়িয়ে নেয়া যায়, যা শীতকালে গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষের জন্য যথেষ্ট। টানেল টেকনোলজি বা ছাউনি পদ্ধতি ব্যবহার করে যে সব সবজি খুব সহজেই চাষ করা যায় সেগুলো হলো- শসাজাতীয় সবজি, টমেটো, পালংশাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শীম ইত্যাদি। এই কৌশলে একজন চাষি আগাম সবজি চাষ করে প্রকৃত মৌসুমের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন। এই পদ্ধতিতে আমাদের দেশের অনেক অঞ্চলের চাষি ভাইয়েরা সবজি চাষ করে আসছেন যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। টানেলের ধরন ও আকার দুই রকমের হতে পারে। নিচু টানেল ও উঁচু টানেল। নিচু টানেল হয় অস্থায়ী এবং এ ধরনের টানেল তৈরিতে খরচ কম।
কিন্তু যে সব এলাকায় খুব জোরে বাতাস প্রবাহিত হয় সেসব এলাকায় এ ধরনের টানেল উপযোগী নয়। তবে আমাদের দেশে প্রধানত যেসব এলাকায় সবজি চাষ হয় সেসব এলাকায় এ ধরনের বাতাস খুব একটা প্রবাহিত হয় না। এ ধরনের টানেল তৈরিতে বাঁশ এবং পলিথিন ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের টানেলের মাধ্যমে প্রকৃত মৌসুমের চেয়ে প্রায় এক মাস আগে সবজি উৎপাদন করা যায়। উঁচু টানেল হলো স্থায়ী টানেল। এ ধরনের টানেল তৈরিতে খরচ বেশি। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় স্টিল ফ্রেম ও বাঁশ। এ ধরনের টানেল যে কোনো এলাকাতেই তৈরি করা যায়। টানেল সবজি চাষের জমি তৈরি করে বীজ বা চারা রোপণের আগেও করা যায়, পরেও করা যায়। নিচু টানেল তৈরি ঃ এ ধরনের টানেল তৈরির প্রধান উপকরণ বাঁশ। টানেলের দৈর্ঘ হতে হবে ৯৮.৪ ফুট এবং চওড়ায় হতে হবে ১৪.৭৬ ফুট। টানেলের ভেতরের মাঝ বরাবর উচ্চতা হবে ৭ ফুট এবং পাশের উচ্চতা হবে ৫ ফুট। সেচ ও পানি নিকাশের জন্য দুই বেড বা টানেলের মাঝখানে ৬ ইঞ্চি গভীরতার ২ ফুট চওড়া নালা রাখতে হয়। তারপর স্বচ্ছ কালো বা নীল রঙের পলিথিন দিয়ে টানেলটি নৌকার ছইয়ের মতো ঢেকে দিতে হয়। উঁচু টানেল তৈরি ঃ এ ধরনের টানেল তৈরির প্রধান উপকরণ স্টিল ফ্রেম বা বাঁশ।
টানেলের দৈর্ঘ হতে হবে ১৩০ ফুট এবং চওড়ায় হতে হবে ৩২ ফুট। টানেলের ভেতরের মাঝ বরাবর উচ্চতা হবে ১২ ফুট এবং পাশের উচ্চতা হবে ১০ ফুট। সেচ ও পানি নিকাশের জন্য দুই বেড বা টানেলের মাঝখানে ৬ ইঞ্চি গভীরতার ৩ ফুট চওড়া নালা রাখতে হয়। চারা বা বীজ থেকে বীজের দূরত্ব রাখতে হয় ১.৫ ফুট। এরপর স্বচ্ছ কালো বা নীল রঙের পলিথিন দিয়ে টানেলটি নৌকার ছইয়ের মতো ঢেকে দিতে হয়। এই পদ্ধতিতে সবজি চাষের জন্য যে জমিটি বাছাই করা হয় তা অবশ্যই উর্বর হতে হয়। মাটির পিএইচ থাকতে হয় ৫ থেকে ৭ এর মধ্যে। টানেল তৈরির পর জমি কোদাল দিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে ভালোভাবে চাষ বা কর্ষণ করে প্রতি টানেলে পর্যাপ্ত জৈব সার, ২.৫ কেজি খৈল, ইউরিয়া ৮০০ গ্রাম, টিএসপি ৫০০ গ্রাম এবং এমওপি ৭০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়া ও পটাশ সারের অর্ধেক জমি তৈরির সময় এবং বাকি অর্ধেক চারা গজানোর দুই সপ্তাহ পরে উপরি প্রয়োগ করতে হয়।
এগুলো সম্পন্ন হলে চারা বা বীজ রোপণের আগে বেড তৈরি করে নিতে হয়। জৈষ্ঠ মাসের শুরুতে টানেল প্রতি ২০০ গ্রাম পালংকশাকের বীজ বুনলে ১ মাস পর অর্থাৎ আষাঢ় মাসে ফসল তোলা যায়। পরে পালংশাক তোলার পর পুনরায় টানেলের জমি উত্তমরূপে কর্ষণ করে এবং উপরোল্লিখিত রাসায়নিক সার জমিতে প্রয়োগ করে জমি প্রস্তুত করতে হয়। কোনো কোনো সময় টানেলের মাটি জো থাকলে কর্ষণ ছাড়াই সবজি চারা রোপণ করা যায়। সবজি হিসেবে বাঁধাকপি, ফুলকপি ও টমেটো চারা আষাঢ় মাসের শুরুতেই রোপণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে জৈষ্ঠ মাসেই অন্য বীজতলায় চারা তৈরি করে নিতে হয়। ২০ থেকে ২৫ দিন বয়সের চারা টানেলের জমিতে লাইন করে রোপণ করতে হয়। বীজ বা চারা রোপণ করার আগে ভিটাভেক্স বা ব্যাভিস্টিন দিয়ে বীজ বা চারা শোধন করে নিতে হয়।
প্রয়োজনমতো সেচ নিকাশ, আগাছা দমন, রোগ পোকা ব্যবস্থাপনা করলে সহজেই ভালো ফলন নিশ্চিত করা যায়। টানেল পদ্ধতিতে অমৌসুমে সবজি চাষ করে পৃথিবীর অনেক দেশ বিশেষ করে ভারত- প্রতি বছর নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর সবজি মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। আমাদের দেশের চাষিদের যদি সবজি চাষের এই কৌশল সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে তাহলে আমাদের দেশও নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে। সরকারের কৃষি বিভাগ অনেক আগে থেকেই সবজি চাষের এই কৌশলটি নিয়ে কাজ করলেও খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি। কেন পারেনি, কী কী সমস্যা ছিল সেসব নিরূপণ করে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে চাষিদের পাশে এসে দাঁড়াতে পারলে সবজি চাষের মাধ্যমেও দিন বদলের প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে নেয়া যেতে পারে। লেখক ঃ কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৩এপ্রিল২০