বাংলামতি: যে ধানের প্রচার ও প্রসার খুব বেশি জরুরি!

1809

পাকিস্তানে এবং ভারতে গড়ে হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদন ৩-৩.৫ টন। যেখানে বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ৪.৪.৫ টন। কিন্তু এই বাংলামতি ধানের উৎপাদন ৬ টনের বেশি। এই ব্রি-৫০ জাতের ধান এখন বাংলামতি (বাসমতির বাংলা ভার্সন) নামেই পরিচিত…

ওয়াসি উদ্দিন মাহিনঃ বাংলাদেশ আরব আমিরাতকে বাংলাদেশের উদ্বাবিত ব্রি-৫০ ধানের চাল বাংলামতি দিয়েছে। কিন্তু কেন এই বাংলামতি? কেন অন্য কোন ধান নয়? সরু, লম্বা পাকিস্তানি বাসমতি চালের জুরি মেলা ভার। ভারতেও খুব ভাল মানের বাসমতি চাল উৎপন্ন হয় তবে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বাসমতি চাল পাকিস্তানেই হয়। এর জন্য আরব বিশ্বে বিরিয়ানির জন্য পাকিস্তানের বাসমতির কোন বিকল্প নেই।

আমাদের দেশেও বাসমতি চাল পাওয়া যায়। তবে সেটা ২০০-২৫০ টাকা কেজি। এত দাম দিয়ে কিনে খাওয়া কঠিন। তবে কিছু বিরিয়ানির দোকানে এই বাসমতি চালের লম্বা ভাতের দেখা মেলে। বাংলাদেশে এই জাতটি একদম ভাল হয়না। তাই চাইলেও আমরা এই জাতের চাষ করতে পারিনি। তাই বলে কি আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীগন চুপ করে বসে থাকবেন? সেটা হতে পারে না।

আর এই অনুপ্রেরণা নিয়েই তারা তাদের ৫০ তম ধানের জাত আবিস্কার করে যেটার নাম দেয় ব্রি-৫০। এই ব্রি-৫০ জাতের ধান এখন বাংলামতি (বাসমতির বাংলা ভার্সন) নামে পরিচিত। দেশের বাজারে এই জাতের চাল এখন ৫৭-৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় যেখানে পাকিস্তানের বাসমতি ২৩০ টাকা করে কেজি বিক্রি হয়।

আমাদের আবিস্কার ব্রি-৫০ পাকিস্তানের বাসমতি থেকেও এগিয়ে। কারন বাংলামতি ধানে পোলাওর চালের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। যেটাকে আমরা বলি সুগন্ধী চাল। শুধু এখানেই শেষ নয়। এর আরো কিছু দিক তুলে ধরা দরকার। বাংলাদেশে উৎপাদিত উৎকৃষ্ট মানের ও সুগন্ধ সম্পন্ন বাংলামতি চাল দিয়ে পোলাও এবং বিরিয়ানী রান্না করা হয়। এ চালের ভাত আঠালো নয়। বাংলামতি উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের বোরো মৌসুমে বাংলামতি ধানের প্রথম বাণিজ্যিক চাষ হয়।

৪-৫ জেলায় মাত্র ১-১২ জন কৃষক এ ধান চাষ করেছেন প্রথম বছরে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার মেছাঘোনা গ্রামের এক কৃষক এস এম আতিয়ার রহমান এই ধান উৎপন্ন করে একরে ৭ মন (প্রতি হেক্টরে ৭ মেট্রিক টন) পেয়েছেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০০৯-এর বোরো মৌসুমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট যশোরে পরীক্ষামূলকভাবে এ ধানের চাষ করে সফল হয়েছিল।

পাকিস্তানে এবং ভারতে গড়ে হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদন ৩-৩.৫ টন। যেখানে বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ৪.৪.৫ টন। কিন্তু বাংলামতি ধানের উৎপাদন ৬ টনের বেশি। পাকিস্তানের বাসমতি ধানের সর্ব্বোচ্চ একরপ্রতি ফলন যেখানে ৩০-৪০ মণ সেখানে বাংলাদেশের বাংলামতি ধানের একরপ্রতি ফলন ৭০-৮০ মণ। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে ব্যাপকভাবে চাষকৃত ব্রি-২৮ ধানের থেকেও এর ফলন বেশি, ব্রি-২৮ ধানের একরপ্রতি ফলন ৪৫-৫০ মণ।

বোরো মৌসুমে বাংলাদেশে সুগন্ধি ধানের জাত যেমন নেই, তেমনি চাষও হয় না বললেই চলে। বাংলদেশে সুগন্ধি ধান হিসেবে কালজিরা, চিনি কানাই, ব্রি উদ্ভাবিত দুলাভোগ বা অন্য দুই চারটি জাত যা চাষ হয় তার সবই আমন মৌসুমে। বাংলামতি ধান ( ব্রি-৫০) সে অভাব পূরণ করবে বলে সংশ্লিষ্ট সকলের ধারণা।

বাংলামতি ধান লম্বা এবং সরু হওয়ায় প্রচলিত মিলে মিলিং করলে চাল ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশে সবখানে এটা মিলিং করা যায় না। এই ধান রাবার রোল হলার যুক্ত অটো রাইস মিলে মিরিং করতে হবে, এতে চালের সুগন্ধ বজায় থাকে। আপাতত কুষ্টিয়ায় এটা করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে কৃষি প্রযুক্তির উন্নতির কোন বিকল্প নেই। জমি কমছে। তাই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে উফশি ধান ছাড়া বিকল্প নেই। যেহেতু এই ধান ৬ টনের অধিক ফলন দেয় তাই বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই ধান।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে সারা বিশ্বে ভারত এবং পাকিস্তানের বাসমতি চালের বাজার। কিন্তু আমরা এত ভাল ধান উৎপন্ন করলেও এদেশের অনেক মানুষ এর সাথে পরিচিত নন। দাম কম হউয়া, ফলন বেশি, সুগন্ধ যুক্ত হবার পরো আমরা সারা বিশ্বের বাসমতি চালের বিশাল বাজার ধরতে পারছি না। আরব আমিরাতের মত মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলিতে আমাদের এই চালের বাজার সৃষ্টি করতে হবে।

বাসমতি চালের ৪ ভাগের এক ভাগ দাম যেহেতু, তাই যদি সেখানের মানুষদেরকে এই চালের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায় তবে ভবিষ্যতে বড় একটি বাজার আমাদের দখলে আসবে। আর এই কারনেই আরব আমিরাতকে আমরা বাংলামতি বা ব্রি-৫০ ধানের চাল উপহার দিয়েছি। আরব আমিরাত আমাদেরকে পিপিই এবং ঔষধ সামগ্রি সাহায্য হিসাবে পাঠিয়েছে। আমরাও পাঠিয়েছি। তবে যেটা পাঠিয়েছি সেটা গভীর ভাবে চিন্তা করলে আমাদের রপ্তানির নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১২মে২০