নারিকেল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। আমাদের দেশে বর্তমানে যে প্রচলিত নারিকেলগুলো রয়েছে তা থেকে ফলন পেতে স্বাভাবিকভাবে ৭ থেকে ৮ বছর সময় লাগে। তাই নারিকেলের ফলন যাতে তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় তাই নতুন এ ‘ ডোয়ার্ফ (খাটো) জাতের নারিকেল আবাদের ব্যাপারে জোর দেয়া হচ্ছে। নতুন জাতের এ নারিকেল গাছ থেকে যথাযথ পরিচর্যা করলে ২৮ মাসেই ফলন আসবে। ফলনের পরিমাণ আমাদের দেশের জাতের থেকে প্রায় তিনগুণ। উপযুক্ত পরিচর্যা করলে প্রতি বছর প্রায় ২৫০টি নারিকেল পাওয়া যায়। উন্নত এ জাতের সম্প্রসারণ করা গেলে আমাদের দেশের নারিকেলের উৎপাদন প্রায় ৩ গুণ বৃদ্ধি পাবে।
জাত : ডোয়ার্ফ বা খাটো হাইব্রিড নারিকেল।
উৎপাদন প্রযুক্তি ও পরিচর্যার ইতিবৃত্তান্ত:
মাটি : নিকাশযুক্ত দো-আঁশ থেকে বেলে দো-আঁশ মাটি।
রোপণের সময় : জুন-সেপ্টেম্বর।
রোপণের দূরত্ব : ৬ মিটার বাই ৬ মিটার হিসেবে হেক্টরপ্রতি ২৭৮টি চারা প্রয়োজন।
পিট তৈরি : আদর্শ পিটের মাপ হবে ৩ ফুট বাই ৩ ফুট বাই ৩ ফুট। গর্ত তৈরির পর প্রতি গর্তে ১৫ থেকে ২০ কেজি পচা গোবর অথবা আবর্জনা পচা সার দিতে হবে। মাটিতে অবস্থানরত পোকার আক্রমণ থেকে চারা রক্ষার জন্য প্রতি গর্তে ৫০ গ্রাম বাসুডিন প্রয়োগ করতে হবে। সব কিছু মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে। ভরাটের পর পানি দিয়ে গর্তটাকে ভিজিয়ে দিতে হবে যাতে সব সার ও অন্যান্য উপাদান মাটির সঙ্গে মিশে যায় যা চারা গাছের শিকড়ের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।
চারা রোপণ : গর্তের মাঝখানে নারিকেল চারা এমনভাবে রোপণ করতে হবে যাতে নারিকেলের খোসা সংলগ্ন চারার গোড়ার অংশ মাটির ওপরে থাকে। চারা রোপণের সময় মাটি নিচের দিকে ভালোভাবে চাপ দিতে হবে যাতে চারাটি শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
আন্তঃপরিচর্যা
* ১ম মাস : চারা রোপণের পর চারার চারপাশের মাটি ভালোভাবে চাপ দিয়ে শক্ত করে দিতে হবে। এরপর সেচ দিতে হবে। নারিকেল ফসলের জন্য সেচ ও নিষ্কাশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শুষ্ক মৌসুমে প্রতিদিন সেচ এবং বর্ষার সময় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২০ দিন পর আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। ছত্রাক জাতীয় রোগ থেকে মুক্তির জন্য ১৫ দিন পরপর ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
* ২য় ও ৩য় মাস : নিয়ম অনুযায়ী যথাযথ সেচ প্রদান করতে হবে। পোকামাকড় ও রোগবালাই আক্রমণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ছত্রাক রোগ দমনে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। নিয়মিত মাটি নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে।
* ৪র্থ মাস : নিয়মিত ছত্রাকনাশক স্প্রে ও আগাছা দমন করতে হবে। শিকড় বৃদ্ধির জন্য মাটির আর্দ্রতা সবসময় ৪০% থেকে ৮০% এ রাখতে হবে। এ মাসে প্রথম ডোজের সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা প্রতি ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০০ গ্রাম টিএসপি, ৪০০ গ্রাম এমওপি এবং ১০ কেজি গোবরজাত সার ভালোভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে। এ সময় চারা থেকে পাতা ছড়ানো শুরু হবে।
* ৫ম ও ৬ষ্ঠ মাস : নিয়মিত ছত্রাকনাশক স্প্রে এবং আগাছা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময়ে গণ্ডার পোকা দমনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
* ৭ম মাস : অন্যান্য মাসের মতো নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। এ সময় থেকে গাছের গোড়া থেকে ১ ফুট দূরত্বে সেচ ও সার প্রয়োগ করতে হবে।
* ৮ম মাস : নির্ধারিত মাত্রার পানি সেচ এবং বালাইনাশকের ব্যবহার অব্যাহত রাখতে হবে। বিভিন্ন পোকামাকড় এবং রোগবালাইয়ের আক্রমণের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এ মাসে সারের ২য় ডোজ দিতে হবে। চারা প্রতি ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০০ গ্রাম টিএসপি, ৪০০ গ্রাম এমওপি এবং ১০ কেজি গোবরজাত সার ভালোভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দেয়া প্রয়োজন।
* ৯ম মাস : এ সময়ে ছত্রাকের আক্রমণ কমতে থাকে বিধায় ছত্রাকনাশকের ব্যবহার কমানো যেতে পারে। তবে পাতা কাটা পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে।
* ১০ম ও ১১তম মাস : যথাযথ বৃদ্ধির জন্য গাছের গোড়ার মাটির আর্দ্রতা ৪০% থেকে ৮০% এর মধ্যে রাখতে হবে। রোগবালাই ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে
* ১২তম মাস : এ মাসে ৩য় সারের ডোজ দিতে হবে। পূর্বের মতো চারা প্রতি ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০০ গ্রাম টিএসপি, ৪০০ গ্রাম এমওপি, ৫০ গ্রাম বোরন এবং ১০ কেজি গোবরজাত সার ভালোভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে। গাছের বৃদ্ধির প্রতি লক্ষ্য রাখলে দেখা যাবে যে, এ সময়ে গাছের উচ্চতা ১২.৫ ফুট, গোড়া ২.৯ ফুট এবং পাতার মাপ হবে ৯.৫ ফুট। পাতার সংখ্যা হবে ১৫ টি।
* ১৩তম ও ১৪তম মাস : সাধারণ পরিচর্যা করতে হবে এবং পোকামাকড়ের আক্রমণের দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
* ১৫তম মাস : এ মাসে পরিচর্যার ক্ষেত্রে গাছের বেসিন এরিয়া বাড়াতে হবে ৫ ফুট পর্যন্ত এবং ৪র্থ ডোজের সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছপ্রতি ৫৪০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৭৫০ গ্রাম এমওপি সার এবং ২০ কেজি গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে।
* ১৬তম মাস : এ মাসে নারিকেল গাছের ট্রাঙ্ক দেখা যেতে পারে। তাই এ সময়ে বিশেষ যতœ নিতে হবে। বিটলের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য গাছ প্রতি বাসুডিন (১০জি) ২০ গ্রাম, নিম কেক ও নদীর বালুর সাথে মিশিয়ে গাছের ৩-৪টি পাতার খাঁজের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে। পরিমিত সেচ প্রদান করতে হবে।
*১৭তম মাস : গাছের গোড়া নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। পরিমিত সেচের মাধ্যমে মাটির আর্দ্রতা ঠিক রাখতে হবে।
* ১৮তম মাস : এ মাসে ৫ম ডোজের সার দিতে হবে। গাছপ্রতি ইউরিয়া ৬৫০ গ্রাম, টিএসপি ১২৫০ গ্রাম, ৮৫০ গ্রাম এমওপি এবং ১০০ গ্রাম বোরন প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে। পোকামাকড়ের আক্রমণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
* ১৯তম মাস : পরিমিত সেচ এবং রোগবালাইয়ের আক্রমণের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।
* ২০তম মাস : গাছের গোড়ার চারপাশের ১ ফুট উঁচু করে সবুজ লতাপাতা জমিয়ে পচাতে হবে যাতে মাটির হিউমাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এতে গাছের বৃদ্ধি যথাযথ হবে। মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে।
* ২১তম মাস : এ মাসে ৬ষ্ঠ ডোজের সার দিতে হবে। গাছ প্রতি ইউরিয়া ৬৫০ গ্রাম, টিএসপি ১২৫০ গ্রাম এবং ৮৫০ গ্রাম এমওপি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে। পোকামাকড়ের আক্রমণের দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
* ২২তম মাস : গাছের এ বয়সে বেসিনের আকার ৬ ফুট পর্যন্ত বাড়াতে হবে। এর মধ্যে গাছের গোড়ার ২ ফুট স্থান অব্যবহৃত রাখতে হবে এবং বাকি ৪ ফুটের মধ্যে সার ও সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
* ২৩তম মাস : এ সময়ে গাছের সঠিক পরিচর্যা করতে হবে। যথাযথ সার ও সেচ দিতে হবে। গাছের গোড়ার ২ ফুটের মধ্যে যাতে পানি ও সার দেয়া না হয় তা বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
* ২৪তম মাস : এ বয়সে নারিকেল গাছ পূর্ণ বয়স্ক গাছ হিসেবে ধরা যায়। তাই এ সময়ে পরিপূর্ণ মাত্রার সার ব্যবহার করতে হবে। ৭ম ডোজ হিসেবে গাছ প্রতি ইউরিয়া ৮০০ গ্রাম, টিএসপি ২০০০ গ্রাম এবং ১১০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। এ সময়ে কিছু গাছে ফুল আসতে শুরু হবে এবং ২৮-৩০ মাসে প্রায় সব গাছে ফুল আসবে। ফুল আসার পর মুকুল ঝড়ার পরিমাণ বেশি হলে ১০ গ্রাম-লিটার হিসেবে বোরাক্স সার স্প্রে করতে হবে।
* গাছের ২৪ মাস বয়সের পর প্রতি গাছে বছরে ৫.৫ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি এবং ৭ কেজি এমওপি সার ও ৫০ কেজি গোবর সার প্রতি বছর চার ভাগে ৩ মাস পরপর গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে। অন্যান্য সারের ক্ষেত্রে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ১৫০ গ্রাম করে প্রতি ৬ মাস অন্তর অন্তর এবং বোরন সার ১০০ গ্রাম করে প্রতি বছর ২ বার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
রোগ ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা
বাড রট-কুঁড়ি পচা : রোগের প্রাথমিক অবস্থায় প্রতি লিটার পানিতে ৪ থেকে ৫ গ্রাম প্রপিনেব ও ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক সিকিউর মিশিয়ে কুঁড়ির গোড়ায় স্প্রে করতে হবে ২১ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার।
ফল পচা রোগ : প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে ম্যানকোজেব জাতীয় রোগনাশক মিশিয়ে আক্রান্ত ফলে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
পাতার ব্লাইট : পরিমিত সার প্রয়োগ করলেও যথা সময়ে সেচ এবং নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে রোগের আক্রমণ কম হয়। আক্রমণ বেশি হলে প্রোপিকেনাজল জাতীয় রোগনাশক ১৫ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
গণ্ডার পোকা : আক্রান্ত গাছের ছিদ্র পথে লোহার শিক ঢুকিয়ে সহজেই পোকা বের করা যায় বা মারা যায়। ছিদ্র পথে সিরিঞ্জ দিয়ে অরগানো ফসফরাস জাতীয় কীটনাশক প্রবেশ করালে পোকা মারা যাবে।
নারিকেলের মাইট : গাছ পরিষ্কার করে ভার্টিমেক-ওমাইট ৪.৫ মিলি থেকে ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
এ জাতের নারিকেল হাইব্রিড বিধায় এর বীজ দ্বারা চারা উৎপাদন করা যাবে না।
মাঠের অভিজ্ঞতা ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা নির্দিষ্ট সময়ে ফলন পেতে নিয়মিত পরিচর্যার বিকল্প নাই। তাই খাটো জাতের নারিকেল আবাদের আগে পরিচর্যা করার মানসিক প্রস্তুতিসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ অবশ্যই নিশ্চিত করে তবেই বাণিজ্যিকভিত্তিতে বাগান করা উচিত।
সংকলন ও তথ্য সংগ্রহে: কৃষিবিদ মোহাইমিন।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৮মে২০