থাইল্যান্ড থেকে প্রথমবার ২০০২ সালে এবং ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আরও কয়েকটি জাত এনে দেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সর্বশেষ থাই পেয়ারা-৭ জাতটির মধ্যে উৎকর্ষতা পাওয়া যায়। জাতটি দেশের মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী। এ ও সি ভিটামিন সমৃদ্ধ বহুবিধ গুণের জন্য বর্তমানে পেয়ারাকে বলা হয় “বাংলার আপেল”।
জাত পরিচিতিঃ
এ পেয়ারার আকার গোলাকার, রঙ হলদে সবুজ, প্রতিটি পেয়ারার ওজন গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম। গাছের উচ্চতা ১২ থেকে ১৮ ফুট। ফুল ফোটা থেকে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত প্রায় ১০০-১২০ দিন সময় লাগে। এ জাতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- বারো মাসই এ পেয়ারার ফলন পাওয়া যায়। বীজ কম ও নরম, অন্যান্য পেয়ারার চেয়ে বেশি মিষ্টি ও কচকচা। বসতবাড়ির আঙিনায়, বাড়ির ছাদে অথবা মাঠে বাণিজ্যিকভাবে এ পেয়ারা চাষ করা যায়।
চাষ পদ্ধতিঃ
অন্যান্য জাতের পেয়ারার মতই মধ্য জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য আশ্বিন মাসে থাই পেয়ারা-৭ এর চারা রোপণ করতে হয়। এ পেয়ারা চাষের জন্য নিকাশযুক্ত বেলে দো-অাঁশ মাটিই উত্তম। এ পেয়ারার বংশবৃদ্ধির জন্য বীজ থেকে চারা বা গুটি কলম ব্যবহার করা উচিত। চার বাই চার বা তিন বাই তিন মিটার দূরত্বে এ জাতের পেয়ারার চারা রোপণ করা যায়। রোপণের কয়েক সপ্তাহ আগে ৫০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য, ৫০ সেন্টিমিটার প্রস্থ ও ৫০ সেন্টিমিটার চওড়া গর্ত খনন করতে হবে। চারা রোপণের ২০ থেকে ৩০ দিন আগে প্রতিটি গর্তে মাটির সঙ্গে ৪ থেকে ৫ কেজি পচা গোবর সার, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১৫০ গ্রাম এমওপি সার মিশিয়ে দিতে হবে। তার পর সারমিশ্রিত মাটি দ্বারা গর্ত ভরাট করে গর্তের মাঝখানে চারাটি রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর গর্তের চারদিকে মাটি দ্বারা উঁচু করে বেঁধে দিতে হবে, যাতে বাইরের পানি এসে গাছের গোড়ায় না জমে।
পরিচর্যাঃ
গাছটি যাতে বাতাসে হেলে না পড়ে সেজন্য বাঁশের খুঁটির সঙ্গে হালকাভাবে বেঁধে দিতে হবে। রসের অভাব হলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। পেয়ারা গাছ থেকে অধিক ফলন পেতে পাঁচ বছরের নিচের বয়সের একটি গাছে বছরে পচা গোবর ১০ থেকে ১৫ কেজি, ইউরিয়া ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম, টিএসপি ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম ও এমওপি ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম এবং পাঁচ বছরের ওপর একটি গাছে প্রতি বছর পচা গোবর ১৫ থেকে ২০ কেজি, ইউরিয়া ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম, টিএসপি ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম, এমওপি ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম সার সমান দুইভাগে ভাগ করে বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পর প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে।
পেয়ারা সংগ্রহের পর ভাঙা, রোগাক্রান্ত ও মরা শাখা-প্রশাখা ছাঁটাই করে ফেলতে হবে। পেয়ারা গাছের পক্ষে প্রচুরসংখ্যক ফলের সব ধারণ করা সম্ভব হয় না। তাই মার্বেল আকৃতির হলেই ঘন সন্নিবিষ্ট্য ফল ছাঁটাই করতে হয়। গাছের চারপাশ ঘাস ও আগাছামুক্ত রাখা। ছাতরা পোকা, সাদা মাছি পোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা ও মাছি পোকাসহ বিভিন্ন রকমের পোকা দ্বারা পেয়ারা গাছ আক্রান্ত হয়। এসব পোকা-মাকড় দমনের জন্য সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে। যেমন-মাটিতে পড়ে থাকা আক্রান্ত ফল ও পাতা কুড়িয়ে ধ্বংস করা। ফেরোমোন ফাঁদ ও বিষ টোপ ব্যবহার করা। সাদা মাছি দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে পাঁচ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার মিশিয়ে গাছে স্প্রে করা ইত্যাদি।
অসময়ে ফলধারণের পদ্ধতিঃ
বর্তমানে পেয়ারা গাছে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের জন্য কৃষি বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন।
ক. শিকড় উন্মুক্তকরণ পদ্ধতি
পেয়ারা গাছের গোড়ার মাটি তুলে গাছের শিকড়গুলো বের করে নাড়াচাড়া দিতে হবে। গাছের গোড়া থেকে ০১ থেকে ১.৫ মিটার পর্যন্ত মাটি কোদাল, শাবল বা নিড়ানি দ্বারা খুব ভালোভাবে সাবধানতার সাথে মাটি উন্মুক্ত করে দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, গাছের কোনো শিকড় কেটে না যায়। সাধারণত যে কোনো বয়সের পেয়ারা গাছে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়। গোড়ার মাটি উন্মুক্ত করার কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ দিন পর পরিমাণমতো সার ও সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে এপ্রিল-মে মাসে পেয়ারা গাছে শিকড় উন্মুক্ত করতে হয়। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করলে পেয়ারা গাছে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে প্রচুর ফলধারণ করে।
খ. হরমোন জাতীয় পদার্থ প্রয়োগ পদ্ধতি
সাধারণত ২ থেকে ৫ বছর বিশিষ্ট পেয়ারা গাছে জৈব হরমোন প্রয়োগ করতে হয়। এপ্রিল-মে মাসে জৈব হরমোন প্রয়োগ করার উৎকৃষ্ট সময়। স্প্রে মেশিন বা ফুটপাম্প দিয়ে খুব ভালো করে পেয়ারা গাছের পাতা ভিজিয়ে দিতে হবে। কয়েক দিনের মধ্যেই গাছের পাতা লালচে হয়ে ঝড়ে যেতে পারে। পরবর্তীতে গাছে সঠিক পরিচর্যা নিলে নতুন পাতা জন্মাবে এবং অসময়ে ফলধারণ হবে।
গ. শাখা-প্রশাখা বাঁকানো পদ্ধতি
শাখা-প্রশাখা বাঁকানো পদ্ধতি সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তি। পেঁয়ারার ডাল বাঁকালেই প্রায় দশগুণ বেশি ফলন হয়। তাছাড়া একই প্রযুক্তিতে বছরের বার মাসই ফল ধরানো সম্ভব হয়। ফলের মৌসুমে গাছের ফুল ছিঁড়ে দিয়ে এ প্রক্রিয়াকে আরও প্রভাবিত করা যায়, যার ফলে সারা বছরই ফলের মৌসুমের তুলনায় কমপক্ষে আট থেকে দশগুণ ফল ধরবে গাছে। এ লক্ষ্যে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গবেষণার মাধ্যমে ‘গাছের ডাল বাঁকানো’ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বছরে দুইবার অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে এবং হেমন্তকালে শাখা-প্রশাখার নিয়ন্ত্রিত বিন্যাসের মাধ্যমে সারা বছর পেয়ারার ফুল ও ফলধারণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গাছের বয়স দেড় থেকে দুইবছর হলেই এ পদ্ধতি শুরু করা যাবে এবং পাঁচ থেকে ছয় বছর পর্যন্ত এ পদ্ধতিতে ফলন বাড়ানো সম্ভব। ডাল বাঁকানোর ১০ থেকে ১৫ দিন আগে গাছের গোড়ায় সার ও পানি দিতে হয়। ডাল বাঁকানোর সময় প্রতিটি শাখার অগ্রভাগের প্রায় এক থেকে দেড়ফুট অঞ্চলের পাতা ও ফুল-ফল রেখে বাকি অংশ ছেটে দিতে হয়। এরপর ডালগুলোকে সুতা দিয়ে বেঁধে তা বাঁকিয়ে মাটির কাছাকাছি করে সাথে অথবা খুঁটির মাধ্যমে মাটিতে বেঁধে দিতে হয় । গ্রীষ্মকালে মাত্র ১০ থেকে ১২ দিন পরেই নতুন ডাল গজানো শুরু হয়। নতুন ডাল ১ সেমি. লম্বা হলে বাঁধন খুলে দেয়া হয়। আর হেমন্তকালে নতুন ডাল গজাতে ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগে। ডাল বাঁকানোর ৪৫ থেকে ৬০ দিন পরে ফুল ধরা শুরু হয়। এভাবে গজানো প্রায় প্রতি পাতার কোলেই ফুল আসে। এ পদ্ধতিতে সারা বছরই ফলন পাওয়া যায়।
অঙ্গ ছাঁটাইঃ
গাছের মরা, শুকনা, চিকন, লিকলিকে, রোগাক্রান্ত ও প্রয়োজনহীন ডালপালা ছাঁটাই করাকে অঙ্গ ছাঁটাই বলা হয়। রোপণকৃত চারা বা কলমের আকার, আকৃতি ও কাঠামো সুন্দর করার উদ্দেশ্যে মাটি থেকে ১.০ থেকে ১.৫ মিটার ওপরে বিভিন্ন দিকে ছড়ানো ৪ থেকে ৫টি ডাল রেখে গোড়ার দিকের সব ডাল ছাঁটাই করে দিতে হবে। বয়স্ক গাছের ফল সংগ্রহের পর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে অঙ্গ ছাঁটাই করা হয়। এতে গাছে নতুর ডালপালা গজায়, প্রচুর ফুল হয় এবং গুণমানের উৎকৃষ্ট ফলধারণ করে।
ফ্রুট ব্যাগিং বা ফল ঢেকে দেয়াঃ
পেয়ারা ছোট অবস্থাতেই ব্যাগিং করলে রোগ, পোকামাকড়, পাখি, বাদুড়, কাঠবিড়ালি এসব থেকে সহজেই রক্ষা করা যায়। ছোট ছিদ্রযুক্ত পলি ব্যাগিং করা ফল অপেক্ষাকৃত বড় আকারের এবং আকর্ষণীয় রঙের হয়। ব্যাগিং করার আগে পেয়ারায় অবশ্যই ভালো মানের জৈব ছত্রাকনাশক স্প্রে করে নিতে হবে।
সঠিক নিয়ম মেনে ভালোভাবে যত্ন নিলে একটি পূর্ণবয়স্ক গাছে গ্রীষ্মকালে ৪০ থেকে ৫০ কেজি এবং হেমন্তকালে ৩০ থেকে ৪০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।
কৃষিবিদ এস.এম ইসমাইল হোসেন
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৩জুন২০