শিক্ষিত যুবকরা মাছ, হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল চাষে জড়িত হলে শুধু যে বেকার সমস্যার সমাধান হয় তা নয়, চাষাবাদ পদ্ধতিরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। মাছচাষে অনেকেই শুরু করেছেন শামুকের ব্যবহার। নিজ খামারেই তারা শামুক থেকে হাঁস বা মাছের খাদ্য তৈরি করছেন। এতে তার বাজারজাত পোল্ট্রি ও মৎস্য খাদ্য ব্যবহারের পরিমাণ কমেছে। ফলে পোল্ট্রি ও মাছচাষের ব্যয়ও কমে এসেছে। এ ছাড়া শামুকের তৈরি খাবার খাওয়ালে পোল্ট্রি ও মাছের স্বাদও ভালো হয়।
অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা পোল্ট্রি ও মাছচাষে শামুকের ব্যবহার সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। এ ছাড়া পোল্ট্রি ও মাছচাষে শামুকের তৈরি খাবার ব্যবহার বাড়লে দেশে ‘মিট অ্যান্ড বোন’-এর আমদানি অনেকাংশে কমে যাবে, যা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একজন মাছচাষি তার ক্ষুদ্র প্রযুক্তির ব্যবহার করে শামুক থেকে মাছের অন্যতম উপকরণ প্রোটিন উৎপাদন করতে পারে। মাছচাষির উৎপাদিত প্রোটিনে কোনো রাসায়নিক প্রভাব থাকার সুযোগ নেই। আমাদের দেশে মাছচাষে প্রোটিনের উৎস হিসেবে যে শুঁটকি ব্যবহার করা হয়, তা সংরক্ষণের জন্য প্রচুর পরিমাণে নিষিদ্ধ ও ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়, যা মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তবে শামুকে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে না। ‘সুস্বাস্থ্যের জন্য’ শামুকচাষে গুরুত্ব দেয়া দরকার।
কুড়া, খৈল, শামুকের গুঁড়ো, ভিটামিন, লবণ শ্রমিক ও মেশিন চার্জ মিলিয়ে শামুক দিয়ে তৈরি এক কেজি মাছের খাবারের মূল্য সাড়ে ১১ টাকার মতো। অথচ বাজারে মাছের খাবারের মূল্য প্রতি কেজি ১৮ থেকে ২০ টাকা। ৪০-৪৫ দিনে ১২০ শতাংশ পুকুর থেকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় দুই হাজার কেজি শামুক আহরণ সম্ভব। প্রতি কেজি শামুকের গড় উৎপাদন ব্যয় হয় মাত্র পাঁচ টাকা মতো। বাংলাদেশে ছোট দেশীয় শামুক চাষ সম্প্রসারণ ও সঠিক বাজারজাতকরণের মধ্যদিয়ে মাছ সম্পদের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। এতে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মিট অ্যান্ড বোনের ওপর চাপ কমবে।
মৎস্য বিজ্ঞানীরা যা বলেন শামুক চাষ এবং এর থেকে মাছের খাবার তৈরির পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত আছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহফুজুল হক রিপন। তিনি বলেন, পুকুরে শামুকচাষ এবং তা থেকে খাবার তৈরি করে অনেকেই সাফল্য পেয়েছেন। তারা দেখেছেন শামুক থেকে খাদ্য তৈরি করলে মাছের খাবার বাবদ ব্যয় অর্ধেকে নেমে আসে। তিনি বলেন, যদি মাছচাষে ব্যাপকভাবে শামুকের তৈরি খাবার ব্যবহার করা হয়, তাহলে বিদেশ থেকে মাছের খাদ্য ‘মিট অ্যান্ড বোন’ আমদানি অনেকাংশে কমে যাবে। এতে দেশের লাভ, চাষির লাভ। ড. মাহফুজুল হক রিপন বলেন, তার ধারণা, শামুক থেকে উৎপাদিত খাদ্য মাছ বেশি খায়। কারণ এ খাবার অনেকটাই প্রাকৃতিক।
শামুক চাষ কৌশল: ১২০ শতাংশের পুকুরে প্রতি শতাংশ হিসেবে এক কেজি গোবর, এক কেজি খৈল ও ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া পানিতে ভালোভাবে মেশাতে হবে। এ মিশ্রণ সমান চার ভাগে ভাগ করে তিন দিন অন্তর পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। এতে পুকুরের পানির রং যখন গাঢ় সবুজ হবে, তখন বুঝতে হবে পুকুরটি শামুক চাষের উপযোগী হয়েছে। এরপর খালবিল বা পুকুর থেকে শামুক সংগ্রহ করে প্রতি শতাংশ হিসেবে ২৫০ গ্রাম শামুক পুকুরের চারদিকে ছিটিয়ে দিতে হবে। পরে ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে শামুক ব্যাপকভাবে বংশবিস্তার করবে।
এরপর ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ শামুক পাওয়া যাবে। অর্থাৎ ১২০ শতাংশ পুকুর থেকে ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে প্রায় দুই হাজার কেজি ছোট শামুক উৎপাদন সম্ভব। শামুকের খাবার হিসেবে প্রতি শতাংশ হিসেবে ২৫০ গ্রাম গোবর, ২৫০ গ্রাম খৈল এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া মেশানো কম্পোস্ট তিন দিন পরপর পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুর থেকে শামুক তুলে চালের কুড়ার সঙ্গে মিশিয়ে তাজা শামুককে প্রথমে খাদ্য ভাঙানোর পিলেট মেশিনের মাধ্যমে গুঁড়ো করা হয়। এগুলো পরে রোদে শুকানোর পর খৈল ভাঙানোর মেশিনের মাধ্যমে ভাঙিয়ে মাছের খাবার প্রস্তুত করা হয়।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৩জুলাই২০