বাংলাদেশে প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থার আলোকে ভোজ্য তেলের (সয়াবিন, সরিষা, তিল, তিসি, সূর্যমুখী, ইত্যাদির) অভ্যন্তরীণ ঘাটতি মেটানো অত্যন্ত দুষ্কর। কেননা, ভোজ্যতেলের উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। এ জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। ধরা যাক, যদি বর্তমানে ভোজ্য তেল উৎপাদনের পরিমাণ ৩ গুণ পর্যন্তও বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়, তাহলেও দেশে উৎপাদিত খাবার তেল দ্বারা মোট চাহিদার মাত্র ৪৫ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব। অন্যদিকে প্রচলিত তৈলবীজ চাষাবাদের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের বাৎসরিক চাহিদা পূরণ করার জন্য যে পরিমাণ কৃষি জমির প্রয়োজন তা আমাদের পক্ষে জোগান দেয়া অসম্ভব। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্প-কারখানা স্থাপন এবং নদী ভাঙনের মতো নানাবিধ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে প্রতিদিন ২২২ হেক্টর আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে। দেশে জনসংখ্যা বিচারে জনপ্রতি চাষযোগ্য জমির পরিমাণ মাত্র ০.১ হেক্টর। ফলে বছরে ৬৫ হাজার হেক্টর কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। কার্যত খাদ্য শস্য ঘাটতি মেটানোর জন্য বেশিরভাগ কৃষি জমি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ অবস্থায় তৈল ফসলের জন্য আবাদী জমির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়।
পাম চাষের গুরুত্ব/উপযোগিতা
এ প্রেক্ষাপটে খাবার তেল চাহিদা পূরণে পামঅয়েল চাষ বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থায় আনতে পারে যুগান্তকারী পরিবর্তন। কেননা, পামচাষ খুব লাভজনক। নিম্নে পাম চাষের উপযোগিতা উল্লেখ করা হলো-
অল্প জায়গা প্রয়োজন: অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী ফসলের তুলনায় পাম চাষের জন্য খুব অল্প জায়গা প্রয়োজন। বছরে ১ হেক্টর জমিতে ৫ টন থেকে ৮ টন বা তার বেশি পরিমাণ পাম তেল উৎপন্ন হয়- যা অন্যান্য যে কোনো তেল উৎপাদনকারী ফসলের চেয়ে বেশি লাভজনক।
অকৃষি জমিতে পামচাষ: পামচাষ দেশের অকৃষি জমিতেই করা সম্ভব। উঁচু জমির আইল, শিক্ষাঙ্গনের পতিত জমি, ক্যান্টনমেন্ট, রাস্তার দু’ধারে পাহাড়ি অঞ্চলের পাদভূমির বিশাল এলাকা, অন্যান্য অব্যবহৃত জমি এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পতিত জমি এ চাষের আওতায় আনা সম্ভব। পাম চাষের মাধ্যমে দেশে অভ্যন্তরীণ খাবার তেলের চাহিদা পূরণের জন্য ২ লাখ ৬০ হাজার অকৃষি জমি পাওয়া একটি সহজ লভ্য বিষয়।
উপযোগী আবহাওয়া: বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মাটি ও আবহাওয়ার সঙ্গে যথেষ্ট সামঞ্জস্য রয়েছে বিধায় বাংলাদেশে পাম চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বের ৮০ ভাগ পামঅয়েল মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় উৎপাদিত হয়। গ্রীষ্মমন্ডলীয় গরম ও আদ্র আবহাওয়া পাম চাষের উপযোগী। পাম চাষের জন্য সাধারণত ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সর্বোত্তম। গাছের পরিপূর্ণ বৃদ্ধি তথা ভালো চাষাবাদের জন্য দিনে অন্তত ৫-৭ ঘণ্টা আলো প্রয়োজন। মালয়েশিয়ায় সর্বাধিক পরিমাণ পাম উৎপাদনকারী অঞ্চলের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৮৫০ মি.মি এবং খরা মৌসুমে অন্তত মাসিক ১০০ মি.মি। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার আবহাওয়ার মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাশ ও দক্ষিণ পূর্বাংশের গড় বাৎসরিক বৃষ্টিপাত ৩০০০ মি.মির বেশি। বর্ষাকালে সর্বাধিক পরিমাণে বৃষ্টি হয় এবং বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ৮০ শতাংশের বেশি থাকে। শীতকালে দেশের তাপমাত্রা সাধারণত ১৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গ্রীষ্মকালে ২৮-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে যা পাম চাষের জন্য খুবই উপযোগী।
সারা বছর কর্মসৃজন: রোপণের ৩য় বছর থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত লাভজনক ফল দেয়। যে কোনো দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য একটি আয় বর্ধক ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পামঅয়েল সারা বছরই ফল দেয় বিধায় এর উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের সারা বছরই কর্মে জড়িত থাকার সুযোগ থাকে। অয়েল পামের তুলনামূলক পুষ্টিমান: বিভিন্ন রকমের উদ্ভিজ্জ ভোজ্যতেলের মতো পাম কোলেস্টরেল মুক্ত। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ভোজ্যতেলের মধ্যে ৫০ পি.পি.এম পর্যন্ত কোলেস্টরেল থাকলে তা কোলেস্টরেল মুক্ত তেল হিসেবে বিবেচিত হয়। পাম তেলের মধ্যে ১৩-১৯ পি.পি.এম পর্যন্ত কোলেস্টরেল থাকে। অপরদিকে সয়াবিন তেলে ২০-৩৫ পি.পি.এম, সূর্যমুখী তেলে ০৮-৪৪ পি.পি.এম এবং সরিষার তেলে ২৫-৮০ পি.পি.এম পর্যন্ত কোলেস্টরেল বিদ্যমান। এই বিবেচনায় পাম তেল অন্যান্য উদ্ভিজ্জ তেলের চেয়ে অতিউত্তম। চীনে পাম তেল, সয়াবিন তেল, পিনাট তেল এবং শুকরের চর্বি নিয়ে তুলনামূলক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এদের মধ্যে পাম তেল দেহে উপকারী এইচ ডি এল কোলেস্টরেলের মাত্রা বাড়ায় এবং ক্ষতিকর এল ডি এল কোলেস্টরেলের মাত্রা কমায়। লাল পাম তেলে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন এবং ভিটামিন ই থাকে। যা গাজরের চেয়ে ১৫ গুণ এবং টমটোর চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি।
আবাদ করার উপায়: সুনিষ্কাশিত সমতল, ভারী মাটি, পানি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন পলিমাটি পাম চাষের জন্য আদর্শ জমি। বাংলাদেশের কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিলেট, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ ৩০টি কৃষি জলবায়ু অঞ্চলের মধ্যে ২৭টি কৃষি জলবায়ু অঞ্চলে পাম আবাদ করা যায়। প্রথমে বীজ থেকে চারা তৈরি করে নিতে হয়। বীজ থেকে চারা তৈরি করে নিতে প্রায় ১ বছর সময় লাগে। চারা তৈরির পর মূল জমিতে ৯.৫ মিটার দূরে দূরে প্রতি হেক্টর জমিতে ১২৮টি চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পূর্বে ৯.৫ মিটার দূরে দূরে ২ ফুট ২ ফুট আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে। মূল গর্তে চারা রোপণের পূর্বে প্রায় ১০ কেজি জৈব সার দিয়ে ভালো করে উলট-পালট করে পচিয়ে নিতে হবে। তারপর প্রতি গর্তে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১ কেজি টিএসপি এবং ৫০০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। এসব সার মাটিতে দিয়ে চারা রোপণ করতে হবে। পরে প্রয়োজন মতো সেচ দিতে হবে।
বালাই ব্যবস্থাপনা: পাম গাছে ইঁদুরের আক্রমণ হতে পারে সে জন্য শতকরা ২ ভাগ জিংক ফসফাইট বিষটোপ ব্যবহার করা যেতে পারে। গন্ডার পোকার আক্রমণে গাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়। গোঁড়া পচা রোগের কারণে শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত ফলন কমে যেতে পারে। এ ছাড়া বাগওয়ার্ম ও ক্যাটারপিলারের আক্রমণ রোধ করার জন্য জৈব বালাইনাশক ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে।
ফসল সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ: সারা বছরই পাম গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা যায়। তবে লাগানোর ২৬-৩০ মাসের মধ্যেই ফসল তোলা যায়। এক হেক্টর জমির পূর্ণ বয়স্ক গাছে গড়ে বছরে কাঁদিসহ প্রায় ১৯ টন ফল পাওয়া যায়। মাসে ৩ বার বা ১০ দিন পরপর ফল সংগ্রহ করা যায়। এরপর ফলগুলোকে পাত্রের মধ্যে পানিসহ ফুটাতে হবে। এতে ফলগুলো নরম হবে। এ নরম ফলগুলোকে চেপে রস বের করে একটি পাত্রে রেখে চুলায় কিছুক্ষণ জ্বাল দিলে রসে বিদ্যমান পানি বাষ্পাকারে বের হয়ে যাবে এবং পাত্রে তেল জমা থাকবে। এভাবে তেল ছেঁকে বোতলে সংগ্রহ করে ছয় মাস পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৩জুলাই২০