একটি ধাঁধা দিয়ে যদি শুরু করি, বলুনতো দেখি যার হাত নাই, পা নাই এমনকি মুখও নাই কিন্তু ঠিকই খায়; অনেকেই চিন্তার মধ্যে থাকলেও উত্তর কিন্তু খুবই সহজ যার নাম পরিবেশ বন্ধু গাছ। এবার প্রশ্ন হলো, গাছ তাহলে কিভাবে খায়; মূলত গাছের মূল বা শিকড় দিয়ে গাছ তার প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান পানির সাথে টেনে শরীরে প্রবেশ করায়। তাছাড়া গাছের পাতায় ছোট ছোট ছিদ্র রয়েছে তা দিয়েও বাতাস থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান গ্রহণ করতে পারে। জীবনধারণ ও শরীরে পুষ্টির জন্য গাছের খাদ্যের দরকার। গাছের জীবনচক্র সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে কমপক্ষে ১৭ টি খাদ্যোপাদান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোকে গাছের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদান বলে। গাছ এসব খাদ্যোপাদানগুলো বাতাস ও মাটি থেকে সংগ্রহ করে পাতায় খাদ্য তৈরী করে। মাটিতে বিদ্যমান খনিজ পদার্থ ও জৈব পদার্থ খাদ্য উপাদানের প্রাথমিক উৎস। তাছাড়া সার প্রয়োগ করেও এসব খাবারের যোগান দেয়া হয়। আশানুরূপ ফসল পেতে সার সরবরাহ করে মাটিকে উৎপাদনক্ষম রাখতে হচ্ছে। তাই দিন দিন আমরা রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার তা হলো রাসায়নিক সারের অপরিকল্পিত ও বেশি ব্যবহার কৃষিতে খরচ বৃদ্ধি করে, মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট করে এমনকি পরিবেশ তথা জীববৈচিত্র্যকেও বিপন্ন করে। এর প্রেক্ষিতে কৃষিতে সার ব্যবহারের সঠিক ব্যবস্থাপনা সময়ের দাবি।
সার প্রয়োগের কিছু সাধারণত নীতিমালা
বীজ, নতুন শিকড় ও গুল্ম জাতীয় গাছের কান্ডের অতি সন্নিকটে বা কোন ভেজা কচি পাতার ওপর রাসায়নিক সার ব্যবহার করা মোটেই উচিত নয়। রাসায়নিক সারগুলো এক ধরনের ঘনীভূত লবণ বিধায় এগুলো গাছের নাজুক সকল বাড়ন্ত অংশকে পুড়িয়ে দিতে পারে। সার যতদূর সম্ভব ভালভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সার জমিতে দাড়িয়ে থাকা গভীর পানিতে প্রয়োগ করা উচিত নয়। মনে রাখবেন, জিঙ্ক ও ফসফেট সার একত্রে মিশিয়ে প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। কেননা, এসব সারের উপাদানগুলো একে অপরের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং ফসল তা গ্রহণ করতে পারে না। জৈব সার ফসল বপন/রোপনের কমপক্ষে ৭-১০ দিন পরে জমিতে ধানের চারা রোপন করতে হবে। সবুজ সার হিসেবে ধৈঞ্চা মাটিতে মিশানোর কমপক্ষে ৭ দিন পর ধানের চারা রোপণ করতে হবে। গৌণ উপাদানের (গাছের জন্য যে খাদ্যোপাদান কম প্রয়োজন যেমন জিংক, বোরণ, ম্যাঙ্গানিজ এসব) দ্রবণ পাতায় ছিটিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে (বিশেষ করে উদ্যান ফসলের ক্ষেত্রে)। সাধারণ ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে শতকরা ১৫-২০ ভাগ বেশী ফসল পাওয়া যায় এবং পরিমাণে শতকরা ৩০ ভাগ কম লাগে। তাছাড়া গুটি ইউরিয়া মৌসুমে একবার ব্যবহার করতে হয়।
জমিতে তিন পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করা হয়। হাতে ছিটানো, স্থানীয় প্রয়োগ এবং পাতায় বা পল্লব গুচ্ছে সিঞ্চন/ছিটিয়ে দেয়া। হাতে ছিটানো পদ্ধতি সাধারণত মাঠ ফসলে এবং স্থানীয় প্রয়োগ সাধারণত ফল বাগান ও সবজিতে করা হয়। রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলপ্রসূতা বাড়ানোর জন্য ফসল ও মৌসুমের ওপর ভিত্তি করে সার ব্যবহারের সাধারণ নির্দেশাবলী অনুসরণ করা উচিত।
ধানচাষের বেলায় ইউরিয়া ০৩ অংশে ভাগ করে প্রয়োগ করা উচিত। প্রথম অংশ শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। ফসলের দ্রুত আঙ্গিক বৃদ্ধির সময় (রোপণের ১৫-২০দিন পরে) দ্বিতীয় বার এবং কাঁইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে তৃতীয় ও শেষবার ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। শাক সবজি চাষের বেলায় ফসলের বৃদ্ধির পর্যায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ইউরিয়া ২-৩ ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করা যায়। স্বল্প মেয়াদি ফসলের ক্ষেত্রে ইউরিয়া সারের পুরোমাত্রা শেষ চাষের সময়েই প্রয়োগ করা যায়। অধিকাংশ মশলার ক্ষেত্রে ইউরিয়া সার ২-৩ ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে। ভেজা মাটি অথবা জো আসা মাটিতে পড়ন্ত বিকেলে ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করে উত্তমরূপে মিশিয়ে দিলে সর্বাধিক সুফল পাওয়া যায়।
ফসফেট সার জমি তৈরির সময় শেষ চাষের ২/১ দিন পূর্বে প্রয়োগ করা উচিত এবং দস্তা সারও শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষে পটাশ ও গন্ধক জাতীয় সারগুলো একবারে প্রয়োগ করা চলে। তবে, মোটা বুনটযুক্ত মাটিতে পটাশ সার দু’ভাগে ভাগ করে ব্যবহার করা যায়। প্রথম ভাগ, জমি তৈরির শেষ সময় এবং দ্বিতীয় ভাগ, দ্রুত কুশি বের হওয়ার সময় প্রয়োগ করতে হবে। রসুন ফসলে এমওপি সার ব্যবহারের পরিবর্তে পটাসিয়াম সালফেট সার ব্যবহার করতে হবে। সালফার এবং জিংক সারের সুপারিশকৃত মাত্রা শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করা না হলে প্রয়োজনবোধে এগুলো উপরিপ্রয়োগ করে ব্যবহার করা যেতে পারে। সময়মতো ইউরিয়া প্রয়োগের পরেও পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করলে তা সালফারের ঘাটতি বলে ধরে নিতে হবে। এক্ষেত্রে যত শীঘ্রই সম্ভব সুপারিশকৃত সালফার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। কচি পাতা সাদা হয়ে গেলে এবং সে সঙ্গে পাতায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাদামী রংয়ের ছিট দেখা দিলে, তা জিঙ্ক সারের ঘাটতির ইঙ্গিত করে। এরূপ লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষনিকভাবে অনুমোদিত পুরো মাত্রায় জিঙ্ক সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
সুবিবেচক হিসেবে সার প্রয়োগ
ফসলের জমিতে সার প্রয়োগ করতে হলে, মাটি পরীক্ষা করে সার দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া অনলাইন ফার্টিলাইজার সুপারিশ নির্দেশনা মেনেও সার প্রদান করা যায়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ফসল নাইট্রোজেন বেশি মাত্রায় খায়, বেশি লস হয় এবং মাটিতে কম থাকায় প্রতি বছর প্রতি মৌসুমেই ইউরিয়া সার নাইট্রোজেনের জন্য পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করতে হয়। রবি মৌসুমে পূর্ণমাত্রায় ফসফরাসের জন্য টিএসপি প্রয়োগ করলে জমির মাটিতে কিছুটা ফসফরাস অবশিষ্ট থাকে বিধায় পরবর্তী মৌসুমে ধান, পাট ফসলে মোট মাত্রার ৪০-৫০% কম লাগে। সবজি ফসলের জন্যও ৩০-৫০% কম লাগে। রবি মৌসুমে পটাসিয়াম সমৃদ্ধ এমওপি সার পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করলে পরবর্তী ফসলে ফসলভেদে ৩০-৪০% সার কম লাগে। সালফার সারের ক্ষেত্রে রবি ফসলে পূর্ণমাত্রা দেওয়ার পর পরবর্তী ফসলের জন্য ভিজা জমিতে সবসময় পূর্ণমাত্রায় সার দিতে হবে এবং শুকনা মাটি হলে অর্ধেক পরিমাণ সার দিলেই চলবে। জিংক সারের ক্ষেত্রে অর্ধেক পরিমাণ দিলেই চলে। তাছাড়া বোরণ সার ফসলের জমিতে বছরে একবার দিলেই চলে।
পাতার সার প্রয়োগ
নির্দিষ্ট পরিমান রাসায়নিক সার পরিমিত পানির সাথে মিশিয়ে দ্রবণ তৈরী করে বর্ধনশীল গাছের পাতায় স্প্রে করা যায়। পাতায় স্প্রে করার সময় সারের মাত্রা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরিমিত মাত্রার চেয়ে বেশি সার ব্যবহার করলে অনেক সময় পাতার কিনারা পুড়ে যেতে পারে বা দগ্ধ হয়ে ঝলসে যেতে পারে।
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ অধিকতর ফসল উৎপাদন, শস্য বহুমুখীকরণ, মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাধ্যমে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য পরিমিত মাত্রায় জমিতে সার ব্যবহার করা উচিত।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১২আগস্ট২০