ছোটবেলার আকর্ষণ থেকেই ড. মনোয়ার প্রজাপতির ওপর নিয়েছেন উচ্চতর ডিগ্রি। গড়ে তুলেছেন প্রজাপতির বাগান। জাবির ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে তার প্রজাপতির বাগান। ক্যাম্পাসে আগমনকারীদের দৃষ্টি কেড়েছে প্রজাপতি বাগান। রঙিন পাখার ছোট্ট এ প্রাণীটি শুধু দৃষ্টিনন্দন বা গবেষণার বিষয় নয়, অর্থনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে এর। বিস্তারিত জানাচ্ছেন শফিক বাশার
রঙিন পাখা মেলে লতায়-পাতায় ঘুরে বেড়ানো ছোট্ট প্রাণীটির প্রতি ছিল এক অজানা আকর্ষণ। অবাক হয়ে দেখেছি তার পাখার রঙের বাহার। বিদ্যালয় শেষে রাস্তার পাশের ঝোপ-ঝাড়ে ছুটে যেতাম তার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। ইচ্ছে হতো ওর মতো উড়ে বেড়ানোর। প্রজাপতির প্রতি ছোটবেলার আকর্ষণের কথা বলছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও প্রজাপতি গবেষক ড. মনোয়ার হোসেন।
আজও ফুরিয়ে যায়নি এ প্রাণীটির প্রতি তার আকর্ষণ। ছোটবেলার সে আকর্ষণ থেকেই তিনি প্রজাপতির ওপর নিয়েছেন উচ্চতর ডিগ্রি। গড়ে তুলেছেন প্রজাপতির বাগান। জাবির ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে তার প্রজাপতির বাগান। সবুজ গাছপালা-ঘাসের ওপর চলে এদের দৃষ্টিনন্দন ওড়াউড়ি। ক্যাম্পাসে আগতদের দৃষ্টি কেড়েছে ড. মনোয়ারের দৃষ্টিনন্দন প্রজাপতি বাগান।
রঙিন পাখার ছোট্ট এ প্রাণীটি শুধু দৃষ্টিনন্দন বা গবেষণার বিষয় নয়, অর্থনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে এর। ড. মনোয়ার বলেন, প্রজাপতি আমদানি ও রফতানি করে প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা সম্ভব। বিশ্বে প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলারের প্রজাপতি কেনা-বেচা হয়। ইংল্যান্ড, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রজাপতি রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। তাই দেশে অর্থনীতির পাল্লা ভারি করতে বাণিজ্যিকভাবে প্রজাপতির চাষ করা যেতে পারে।
তাছাড়া জিন গবেষণা ও ফসলের ফলন বাড়াতে এবং শস্যের পরাগায়নে এর অবদান অনেক। চীন ও জাপানের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, প্রজাপতির পাখায় ডিএনএ’র আনুক্রমিক বিন্যাস প্রতিলেপন করে আলোক সক্রিয় কোষ তৈরি করা যায়। এগুলো সৌরশক্তি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এর মাধ্যমে ১০ গুণ বেশি সৌরশক্তি উৎপাদন করা সম্ভব।
অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেনের ১৯ বছরের সাধনায় ৩ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে প্রজাপতির বাগান। এখানে রয়েছে প্রজাপতির উপযোগী গাছ-গাছালি, ফুলের বাগান ও প্রজাতির ঘর। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাদে ও সামনের বাগানে তৈরি করা হয়েছে ‘প্রজাপতি ঘর’। এখানে কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে অবমুক্ত করা হচ্ছে প্রজাপতি। এ পর্যন্ত দুটি প্রজাতির শতাধিক প্রজাপতির জন্ম হয়েছে এ প্রজনন কেন্দ্রে। প্রজাপতির বাগানে ১১৫ প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে সাড়ে ৫ হাজারের মতো। আর এর মধ্যে ৬১টি প্রজাতি বাংলাদেশে নতুন।
ড. মনোয়ার হোসেন ২০০১ সালে জাপানের ইয়োকোহামা ইউনিভার্সিটি থেকে কালার ভিশন অব বাটারফ্লাইয়ের ওপর ফেলোশিপ করেন। ২০০৭ সালে জাপানের কানাজাওয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ইনসেকটস অব মলিকিউলার বায়োলজি’র ওপরে পিএইচডি সম্পন্ন করেন তিনি। ড. মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভাগের কীটতত্ত্ব শাখার অধীনে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পেইন (Plain) টাইগার প্রজাতির প্রায় ৩০০ প্রজাপতি ক্যাম্পাসে অবমুক্ত করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ইসমাইল হোসেন ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরীর সঙ্গে যৌথভাবে ও তার একক গবেষণায় এ পর্যন্ত ১০২টি প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে। সব মিলে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৩০০ প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করা হয়েছে। তবে প্রাণিবিজ্ঞানীদের ধারণা বাংলাদেশে কমপক্ষে ৫০০ প্রজাতির প্রজাপতি আছে ।
বাংলাদেশে প্রজাপতি নিয়ে প্রথম গবেষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মাহমুদুল আমিন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শফিক হায়দার চৌধুরী। ১৯৬৮ সালে তাদের যৌথ গবেষণার প্রতিবেদনে ২৭ প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্তের কথা উল্লেখ আছে। এম ওয়াহেদ এবং জেএইচ চৌধুরী ১৯৮৩-৮৫ সালে আরেক যৌথ গবেষণায় ৩৩ প্রজাতির প্রজাপতির সন্ধান পান। ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএস আলম এবং জিএম উল্লাহ ২১ প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করেন।
১৯৯৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মনোয়ার হোসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ইসমাইল হোসেন আরেক যৌথ গবেষণায় ৪৪ প্রজাতির প্রজাপতির সন্ধান পান। ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমএ বাশার ১৬৭ প্রজাতির প্রজাপতির তালিকা প্রকাশ করেন। সর্বশেষ ২০০৯ এর জুন থেকে ২০১৪ এর মে পর্যন্ত গবেষণায় ৮ প্রজাতির সন্ধান পান ড. মনোয়ার হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, বিভিন্ন হল, বিভাগ ও অনুষদের বাগান, প্রশাসনিক ভবন, র্যাগ উদ্যানসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় গবেষণা চালিয়ে এ নতুন প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করা হয়েছে।
২০০৩ সালে প্রাপ্ত ৩৬ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে-ক্লাব সিলভার লাইন, কমন ও ডার্ক সিরুপলিন (Cerulean), অ্যাপে ফ্লাই, ম্যানগ্রোভ সানবিম, ফরগেট মি নট, পিব্নু (Pea Blue), এ্যাংগেল্ট পিরোটসহ লাইকেনেডি পরিবারের ১৩ প্রজাতি। হেসপারিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত পরিবারের ১৪ প্রজাতি। লিম্ফালিড (Nymphalid) পরিবারের কমান্ডার ও কমন সার্জেন্ট এবং পাইরিডি পরিবারের ওয়ান্ডারার ও ইন্ডিয়ান ক্যাবেজ। সম্প্রতি পাঁচটি নতুন জাতের প্রজাপতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলো হলো- ট্যারাকাস ন্যারা, র্যাথিন্ড্রা এ্যামর, জুনোনিয়া ওরিথিয়া, ভেনিসা কারডুই ও জঙ্গল গ্লোরি (Jungle Glory)।
ড. মনোয়ার হোসেন জানান, বাংলাদেশে শনাক্ত প্রজাপতির ৩০০টি প্রজাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-প্লেইন (Plain) টাইগার, কমন ক্রো, প্লাম (Palm) জুডি, ডিঙ্গি বুশব্রাউন, কমন ডাফার, এপফ্লাই, পি বস্নু (Blue), টাইনি গ্রাস বস্নু, ওক বস্নু, কমন সেইলর, কমন রোজ, বস্নু (Blue) মরমন, স্ট্রাইপড অ্যালবাট্রস, মটিলড ইমিগ্রান্ট, কমন গ্রাস ইয়েলো, স্ট্রাইপড পাইরট, মানকি পাজল, বস্নু (Blue) প্যানসি ও পেইন্টেড লেডি।
এসবের মধ্যে স্ট্রাইপড পাইরট, মানকি পাজল, বস্নু প্যানসি ও পেইন্টেড লেডি ও জঙ্গল গ্লোরি (Glory) নামের পাঁচটি প্রজাতি অতি সম্প্রতি শনাক্ত করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, প্রজাপতির গড়আয়ু দুই থেকে পাঁচ সপ্তাহ। তবে দু’একটি প্রজাতি এর বেশিও বাঁচে। পরিবেশের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও দিনের দৈঘ্র্যের ওপর এর আয়ু নির্ভর করে। প্লেন (Plain) টাইগার প্রজাপতি গড়ে ২৮ দিন বাঁচে।
‘বাটারফ্লাই কালার ভিশন’ সম্পর্কে বললেন, ‘মানুষের কোনো কিছু দেখার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে রঙ। চোখ দিয়ে দেখার পর মস্তিষ্ক কীভাবে বিশ্লেষণ করে তা আজও অজানা। প্রজাপতির ক্ষেত্রে এ রহস্য অনেকখানি উন্মোচিত হয়েছে। মানুষের চোখ মৌলিক তিনটি রঙ লাল, সবুজ ও নীল শনাক্ত করতে পারে। অন্যদিকে ‘ওমাটিডিয়াম’ নামের প্রজাপতির যৌগিক চোখ ধরতে পারে সাতটি রঙ।
তাই প্রজাপতির দৃষ্টি রহস্য পুরোটা ভেদ করতে বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগেছেন। কারণ প্রজাপতির মস্তিষ্কের লেমিনার মনোপোলার অংশের সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কের বাইপোলার সেলের সাদৃশ্য আছে। প্রজাপতি কীভাবে দেখে তা জানা গেলে সে বিজ্ঞান মানুষের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। তখন সহজেই ধরা যাবে চোখের নানা রোগ। জানা যাবে মানুষের রঙ পছন্দ-অপছন্দের কারণও।
প্রজাপতি সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য ড. মনোয়ার শিক্ষার্থীদের নিয়ে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশের নানা প্রান্তে। কোন প্রজাতির প্রজাপতি কোন গাছে বাস করে, কোন গাছের পাতা কিংবা কোন ফুলের মধু বেশি খায়, তা নিশ্চিত করতে খাটছেন নিরলসভাবে। ড. মনোয়ার বলেন, ‘ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে মাঝে মাঝেই প্রজাপতির পিছু নেই। ডোবা বা পুকুরে কোমর জলে নেমেও ছবি তুলেছি। কারণ প্রজাপতির গবেষণার জন্য ফটোগ্রাফি খুবই জরুরি। এতে প্রজাপতির পছন্দের গাছেরও ছবি পাওয়া যায়।
প্রজাপতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত গাছগুলো শনাক্ত করতে পারলে তাদের সংরক্ষণের পথটা অনেকটাই সহজ হয়ে আসবে।’ প্রজাপতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার জন্য ড. মনোয়ার হোসেন নিজ বিভাগে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘অ্যান্টোমলজি ল্যাব’। প্রজাপতি নিয়ে গবেষণার জন্য ইনকিউবেটর থেকে শুরু করে শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ, হাই সেন্সেটিভ রেফ্রিজারেটর, সেন্ট্রিফিউজ মেশিন, রিয়ার-ইন কেইজ, ইনসেক্ট সুইপিং নেট, কিলিং জার; সবই আছে সেই গবেষণাগারে। বংশবৃদ্ধির লক্ষ্যে আগামীতে প্রজাপতির একটি খামার গড়ে তোলার আশা রয়েছে ড. মনোয়ারের।
‘উড়লে আকাশে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি’ এ সস্নোগান নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জহির রায়হান অডিটরিয়ামের সামনে ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে জাল দিয়ে ঘেরা ‘প্রজাপতি ঘরে’ ২০১০ থেকে প্রতি বছর ডিসেম্বরের প্রথম শুক্রবার প্রজাপতির মেলার আয়োজন করা হয়। ‘পরিবেশের জন্য প্রজাপতির উপকারিতা তুলে ধরা এবং তা সংরক্ষণে জনগণকে সচেতন করতেই এ মেলার আয়োজন’, জানালেন ড. মনোয়ার হোসেন।
প্রজাপতির প্রধান কাজ পরাগায়নে সহায়তা করা। এর মাধ্যমেই উদ্ভিদ বংশবিস্তারে সক্ষম হয়। এছাড়াও প্রজাপতির রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব। তাই প্রজাপতি সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন এ গবেষক।
সূত্র : আলোকিত বাংলাদেশ
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৩আগস্ট২০