অনেক জনপ্রিয় একটি নাম নাগা মরিচ বা বোম্বাই মরিচ। সখ করে অনেকেই এটা নিজ ছাঁদের উপর অথবা বারান্দার টবে চাষ করেন। বর্তমানে অনেকই আবার বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করছেন এই মরিচের।নাগা মরিচ শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। মরিচের প্রতি আমাদের অনেকেরই দুর্বলতা রয়েছে। ইচ্ছা ও একটু চেষ্টা করলেই আমরা নিজেরাই ১ মাসে ফলাতে পারি নাগা/বোম্বাই মরিচ। এছাড়াও পতিত বা অন্যান্য জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে পারেন বোম্বাই মরিচ। ছাদে টবেও নাগা মরিচের ভালো ফলন হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল ছাড়াও ভারতের মণিপুর, নাগাল্যান্ড, আসাম, নেপাল, থাইল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কায় বিভিন্ন গ্রামঞ্চলে এ মরিচের ব্যাপক চাষ হয়।
নাগা মরিচের অন্যান্য প্রচলিত নামঃ মরিচেরই একটি প্রজাতি হলো বোম্বাই মরিচ, যা প্রচণ্ড ঝালের কারণে সর্বাধিক পরিচিত। ঐতিহ্যবাহী এই মরিচ কোথাও কোথাও নাগা মরিচ, বোম্বাই মরিচ, কামরাঙা মরিচ, রাজা মরিচ, নাগাহরি, সাপের বিষ কিংবা ভুত মরিচ নামেও পরিচিত। পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে এর প্রচন্ড ঝালের কারণে একে অনেক সময়ই হয়তো ভুল করে, ভূত মরিচ বলা হয়ে থাকে। তবে মূলত সুগন্ধ আর স্বাদের জন্যই এর এত কদর।
বীজ/চারা প্রাপ্তির স্থানঃ ঢাকার সিদ্দিকবাজারে ( গুলিস্থানের পাশে ) বীজ কিনতে পাওয়া যায়। তবে নতুনদের ক্ষেত্রে চারা কেনাই উত্তম। যে কোনো নার্সারি, হর্টিকালচার সেন্টার বা গ্রামের হাট বাজার থেকেও কেনা যায় বোম্বাই মরিচের চারা। তবে বিশ্বস্ত উৎস হতে চারা ক্রয় করলে জাত ও চারার মান সম্পর্কে নিশ্চিত থাকা যায়। বীজ থেকেও চারা উৎপাদন করে রোপণ করা যায় সে ক্ষেত্রে ভালোমানের প্যাকেটজাত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
পুষ্টিমূল্য ও ভেষজ গুণঃ শুকনো মরিচে আমিষ, প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘সি’ থাকে। এছাড়াও নিয়মিতভাবে কাঁচা মরিচ খেলে মুখে ‘ঘা’ হয় না।
ব্যবহারঃ রান্না-বান্না ও মুখরোচক খাবার তৈরি ছাড়াও মরিচ বিভিন্ন ধরনের আচার তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনেকে মরিচের আচারও করে থাকেন।
জলবায়ুঃ এ মরিচ শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ যায়। ফসলের প্রাথমিক অবস্থায় অল্প বৃষ্টিপাত এবং ফসলের বাড়বাড়তির সময় পরিমিত বৃষ্টিপাত হলে মরিচ খুব ভালো হয়। অতিরিক্ত ও পরিমাণের কম বৃষ্টিপাত মরিচের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে ফুল ও ফল ধরা কমে যায় এবং অধিক আর্দ্রতায় ফল পচে যায়। ফলের পরিপক্বতার সময় শুকনো আবহাওয়া থাকলে এর গুণগতমান ও রং অক্ষুণ্ণ থাকে। বেশি বৃষ্টিপাত ও মেঘলা আকাশে ফুল ধারণে সমস্যা হয়।
জমি নির্বাচনঃ জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ উর্বর দো-আঁশ মাটি নাগা মরিচ চাষাবাদের জন্য উপযোগী। অম্লমাটিতে মরিচের চাষ করা হলেও ক্ষারীয় মাটিতে ফলন ভালো হয় না অর্থাৎ মাটির পিএইচ ৫.৫-৭.০ এর মধ্যে থাকতে হবে। ছায়ামুক্ত ও বৃষ্টির সময় পানি দাঁড়ায় না এমন উঁচু জমি মরিচ চাষের উপযোগী।
বন্যাবিধৌত পলি এলাকায় মাঝারি ও উঁচুভিটা যেখানে বর্ষার পর ভাদ্র অর্থাৎ আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে যখন জো অবস্থা আসে সেখানে মরিচ ভালো হয়। বিশেষ করে সেচ এলাকায় অথবা নদী, নালা, খাল বা দীঘির আশপাশে, বাগানের রাস্তা, পানের বরজ, লেবু কমলা, পেঁপে, কলাসহ অন্যান্য দ্রুতবর্ধনশীল ফল বাগান, সবজি বাগানের পাশে, ঘরের কাছে, উঁচু ভিটায়, বোম্বাই মরিচ চাষ করা যায় অনায়াসে।
চারা রোপণঃ উঁচু করে মাটি তুলে প্লট বানিয়ে বোম্বাই মরিচের চারা রোপণ করতে হয়। আগেই বীজতলায় পলিথিনে চারা তৈরি করে নিতে হবে। সরাসরি বপন করেও আবাদ করা যায় কিন্তু এতে বীজ বেশি লাগে, সময় বেশি লাগে এবং আর্থিক ক্ষতি হয়। ৩ ফুট চওড়া বেডে ২ লাইন বোম্বাই মরিচের চারা লাগাতে হয়। শীতকালের জন্য ভাদ্র-আশ্বিণ ( আগস্ট-সেপ্টেম্বর ) মাসে ও বর্ষা মৌসুমের জন্য ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বীজতলায় বীজ বপন করা হয়।
রোপণ দূরত্বঃ চারা রোপণে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০-৭০ সেমি ও চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩০-৪০ সেমি রাখা হয়। চারা বিকেলে লাগাতে হবে এবং ২-৩ দিন সকাল বিকাল পানি দিতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনাঃ মরিচের জমিতে প্রতি হেক্টরে গোবর ১০ টন, ইউরিয়া ২৫০ কেজি, টিএসপি ২০০ কেজি এবং এমওপি সার ১৫০ কেজি প্রয়োগ করা হয়। জমি তৈরির সময় সমুদয় গোবর, টিএসপি ও ৫০ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করা হয়। চারা রোপণের ২৫ দিন পর ৮৪ কেজি ইউরিয়া ও ৩৪ কেজি এমওপি সার প্রথম উপরি প্রয়োগ করা হয়। লাগানোর ৫০ দিন পর ২য় ও ৭০ দিন পর তৃতীয় কিস্তির উপরি সার প্রয়োগ করা হয়। ২য় ও ৩য় কিস্তির প্রতিবারে ৮৩ কেজি ইউরিয়া ও ৩৩ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করা হয়।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনাঃ জমিতে রসের অভাব হলে সেচ দিতে হবে ও পানি নিকাশের ব্যবস্থা রাখতে হবে। আগাছা দেখা দিলে তা পরিষ্কার করতে হবে এবং উপরি সার প্রয়োগের সময় কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আলগা করে দিতে হবে।
ফুল ও ফল ধারণঃ চারা লাগানোর দেড় ২ মাস পর থেকেই ফুল ধরে এবং ফুল আসার ১ মাসের মধ্যে খাবার উপযোগী হয়। কাঁচামরিচ যেমন বেশি কাঁচা অবস্থায় ঝাল থাকে না কিন্তু বোম্বাই মরিচ ছোট অবস্থায়ও ঝাল থাকে এবং সুগন্ধিতে মাতোয়ারা করে ফল ধরার শুরু থেকেই।
রোগবালাইঃ বোম্বাই মরিচের অল্প কিছু পোকামাকড় সমস্যা। এর মধ্যে পাতা কোঁকড়ানো, থ্রিপস পোকা, অতিক্ষুদ্র গাঢ় বাদামি মাকড়সা, জাবপোকা, ফলছিদ্রকারী পোকা অন্যতম। আর রোগের মধ্যে কা- পচা, ঢলেপড়া রোগ, মরিচপচা, ডগা শুকিয়ে যাওয়া ও ফল পচা বা অ্যানথ্রাকনোজ উল্লেখযোগ্য। আবাদের শুরু থেকে সুস্থ সবল চারা রোপণ, সুষম সার প্রয়োগ, সেচ নিকাশ, আগাছা দমন, পানি সেচ, আক্রান্ত পাতা বা ডাল ছিঁড়ে ফেলা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে অর্থাৎ ক্লিন আবাদের ফলে বোম্বাই মরিচ উৎপাদন ফলন আশাতীত ভালো হবে।
ফসল সংগ্রহঃ ফুল আসার পর ১৫-২০ দিনের মধ্যে কাঁচা মরিচ তোলা হয়। তবে মরিচের রং লাল হলে তুলে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। হেক্টর প্রতি ফলন কাঁচা ১০-১১ টন ও শুকনো ১.৫-২.০ টন।
নাগা মরিচ রপ্তানিঃ সিলেট অঞ্চলে উৎপাদিত ঐতিহ্যবাহী নাগা মরিচ ইউরোপ, আমেরিকা মধ্যপ্রচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে গত ২/৩ বছর থেকে। ২০১১ সনের জুলাই মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ মরিচ রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাজ্যে।
বিঃদ্রঃ এখানে ১ মাসে ফলনের ব্যাপারটা বলা হয়েছে চারা লাগানোর ক্ষেত্রে। বীজ থেকে ফলন পেতে আড়াই থেকে তিন মাস সময় লাগতে পারে।
তথ্যসূত্রঃ আগ্রিকালচার লারনিং
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৪আগস্ট২০