বর্তমানে মাছ চাষ একটি লাভজনক প্রকল্পে প্ররিনত হয়েছে। অনেক শিক্ষিত যুবক অথবা বিদেশ ফেরত অনেকই বাড়িতে পুকুরে গড়ে তুলেছেন মাছের খামার। কিন্তু যাদের জায়গা নেই বা পুকুর নেই তারা কি করবেন? শাকসবজি, ফলমূলের মতো চৌবাচ্চায় মাছ চাষ করা যায়।
চৌবাচ্চায় মাছ চাষে যেমন বাড়তি কোনো ঝামেলা নেই, তেমনি ঘরে বসে টাটকা মাছ তো খাওয়া যাবেই,পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হবে। গবেষণার মাধ্যমে ইতিমধ্যে দেশী স্ত্রী- মাগুর ও আফ্রিকান পুরুষ- মাগুরের সংকরায়ণের মাধ্যমে অধিক ফলনশীল সংকর মাগুর উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ মাছের অনেক বেশি গুণ- তিন মাসেই পূর্ণাঙ্গ দেশী মাগুরের আকার, প্রায় ২০০-২৫০ গ্রাম ওজন হয়।
এই সংকর জাতের মাগুর দেখতে দেশী মাগুরের মতো এবং খেতে সুস্বাদু। মাত্র ২ বর্গমিটারের ২.৫থেকে ৩ ফুট গভীর চৌবাচ্চায় প্রতি বর্গমিটারে ৫-৬ ইঞ্চি সাইজের ৪০ টি মাগুরের পোনা ছাড়তে পারেন। ফিশমিল, ব্লাডমিল, খৈল, চালের কুঁড়া, আটা মিশ্রিত খাবার দৈনিক পাঁচ ভাগ হারে দিলে প্রতি বর্গমিটারে তিন মাসে প্রায় ৫০ কেজি মাগুর উৎপাদিত হতে পারে। মাছের সঠিক বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত আলো-বাতাস দরকার, তাই রোদের তাপে চৌবাচ্চার পানি যাতে গরম না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এ ছাড়া প্রতিদিন চৌবাচ্চার পানি নেড়েচেড়ে দিতে হবে। যাদের জায়গা আছে তারা বাড়ির আশপাশে হাইব্রিড মাগুরের চাষ করতে পারেন। আর শহরে যাদের জায়গাস্বল্পতা তারা চাইলে বাসার ছাদে বা বাসার পাশের জায়গায় ৩ ফুট উঁচু চৌবাচ্চা তৈরি করে তাতে মাগুর মাছ অল্প পানিতে এবং বছরে তিনবার এ মাছের চাষ করা যায়। শহরঞ্চলে এসব মাছ কেজি হিসেবে বিক্রি হয়।
প্রতি কেজি ৭০- ১৮০ টাকা। হাইব্রিড মাগুর পোনা দেশের সর্বত্র পোনা বিক্রয় কেন্দ্রে পাওয়া যায়। আকৃতির ওপর এর দাম নির্ভর করে, যেমন-এক থেকে দুই ইঞ্চি আকৃতির মাছের পোনা ২-৬ টাকা করে। আবার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি নয়। যার ফলে চার মাস পালন করলে লাভ পাওয়া যাবে।
মাগুর মাছের পোনা উৎপাদন এ ছাড়া এ কাজে যখন অভিজ্ঞ হবেন, তখন নিজেই পোনা উৎপাদন করতে পারবেন। আর পোনা উৎপাদন করলে দুভাবেই লাভবান হবেন। প্রথমত, পোনা বিক্র করে;দ্বিতীয়ত, মাছ বিক্রি করে। সাধররণত মে থেকে আগস্ট মাস মাগুর মাছের প্রজননকাল।
এ প্রজনন ঋতুতে ইনজেকশন দেওয়ার ৬ ঘন্টা আগে পরিপক্ক স্ত্রী দেশী মাগুর ও পুরুষ আফ্রিকান মাগুর পুকুর থেকে ঘরতে হবে। স্ত্রী দেশী মাগুরের পেট ডিমে ভর্তি ও ফোলা থাকে। জননেন্দ্রিয় গোল, লালচে ও ফোলা হয়ে থাকে। পেটে চাপ দিলে দু-একটি ডিম বের হয়ে আসে। আফ্রিকান পুরুষ মাছের জননেন্দ্রিয় লম্বাটে ও সূচালো হয়ে থাকে।
মাগুর মাছে দুই ধরনের হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। যেমন পিটুইটারি গ্লান্ড (পিজি) ও হিউম্যান করিয়নিক গোলাড্রোটপিন (এইচসিজি)। ইনজেকশন দ্রবণ তৈরি করার জন্য পতিত পানি ব্যবহার করা হয়। মাগুর মাছের দেহে সাধারণত ০.৫ মিলির রেশি ইনজেকশন দ্রবণ প্রবেশ না করা ভালো।
হাইব্রিড মাগুর উৎপাদনের জন্য শুধু স্ত্রী- মাগুরকে ইনজেকশন দেওয়া হয়। মাছের পৃষ্ঠদেশের পেছনের দিক থেকে ৪৫ ডিগ্রি কোণে ইনজেকশন দেওয়া হয়। ইনজেকশন দেওয়ার ১৪-১৮ ঘন্টার মধ্যে স্ত্রী মাছের পেটে চাপ দিয়ে পরিষ্কার ট্রে বা থালায় ডিম বের করে নেওয়া হয়। এ সময় পুরুষ মাছের পেট কেটে অণ্ডকোষ বের করে কুচি কুচি কেটে লবণ পানিতে দ্রবণ তৈরি করা হয়। সংগৃহিত ডিমের ওপর অণ্ডকোষ দ্রবণ ঢেলে পাখির পালক দিয়ে ডিম নিষিক্তকরণ করা হয়।
পরবর্তী সময়ে রেণু পোনা বের হয়। রেণু পোনাকে তিন-চার দিন যন্ত নিলে হয় ধানী পোনা, আস্তে আস্তে তা পোনায় রূপান্তর হয়।প্রথম দিকে চৌবাচ্চা তৈরি ও অন্যান্য কারণে খরচ বেড়ে যাবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অভিজ্ঞতার কারণে লাভ বেশি হবে। নিজের উদ্যোগে চৌবাচ্চায় মাছ চাষ পরিবারের মাছের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিক্রি করে কমবেশি আয় ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। চৌবাচ্চায় মাছ চাষে বাড়তি কোন শ্রমের প্রয়োজন হয় না। একই সাথে পরিবারের সবাই এ বিষয়াদি হাতে কলমে শিখতে আগ্রহী হয়। এতে পরিবারের পুষ্টির অভাব অর্থাৎ মাছের চাহিদা ও পূরণ হয়।
চৌবাচ্চার প্রস্তুতি
চৌবাচ্চাটি ভালো করে পরিস্কার করতে হবে। জীবাণুমুক্ত করতে চৌবাচ্চায় ১০০ গ্রাম চুন গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। চুন দেয়ার পর পানি সরবরাহ করে পরদিন ১-২ কেজি পঁচা গোবর, ১-২ কেজি মুরগির বিষ্ঠা ছিটিয়ে দিতে হবে। দু’একদিন পর পানি ভালোভাবে নেড়ে ১৫০ গ্রাম খৈল, ১০০ গ্রাম চালের কুঁড়া, ৫০ গ্রাম শুঁটকি মাছ ও ২৫ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি দেয়া উচিত। দু’তিন দিনের মধ্যে পানির বর্ণ সবুজ হয়ে যাবে। এ সময়ই মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত।
পোনা প্রাপ্তি ও মজুদ
যে কোনো সরকারি, বেসরকারি হ্যাচারি, পোনা বিক্রেতা ও সরকারি কৃষি খামারে পোনা পাওয়া যায়। ১ ইঞ্চি মাপের ১০০টি পোনা একটি চৌবাচ্চায় মজুদ করা যেতে পারে। ব্যাঙ ও অন্যান্য প্রাণী থেকে পোনাকে সাবধানে রাখতে হবে। প্রয়োজনে ৫-৭ ইঞ্চি পোনা ব্যবহার করা যেতে পারে।
মাছের খাবার
এ পদ্ধতির জন্য সম্পূরক খাবার অপরিহার্য। পোনা মজুদের পর দিন থেকে সয়াবিন, তিল, সরিষার খৈল ৪০ শতাংশ, আতপ চালের কুঁড়া ৪০ শতাংশ, শুঁটকির গুঁড়া ২০ শতাংশ করে মাছের খাবার দিতে হবে। এর সঙ্গে জবাইকৃত প্রাণীর জমা রক্ত, নাড়িভুঁড়ি, ঝিনুক বা শামুকের মাংস এবং সামান্য পরিমাণ লবণ, আটা ও ভিটামিন মিশ্রিত খাবার দেয়া যেতে পারে।
মাছের রোগ থেকে রক্ষা পেতে খাবার উপাদানে বিশুদ্ধতা বজায় রাখা উচিত। মাছের বৃদ্ধি বাড়াতে প্রতি সপ্তাহে ৩০ গ্রাম ইউরিয়া ও টিএসপি দেয়া যেতে পারে। সঠিক পরিমাণে মাছের খাবারের জন্য ১১টি ধাপ অনুসরণ করতে হবে। প্রতিটি ধাপে সময় থাকবে পাঁচদিন করে।
প্রথম থেকে একাদশ ধাপে যথাক্রমে ২৫০০, ৪০০, ৫০০, ৬০০, ৭০০, ৮০০, ৯০০, ১০০০, ১১০০, ১১০০ ও ১২৫০ গ্রাম হারে খাবার দিতে হবে। পানির রঙ গাঢ় সবুজ বা পানির ওপরে সবুজ আবরণ পড়লে খাবার বন্ধ রাখতে হবে।
পানি পরিবর্তন
২৫-২৮ দিন পরপর চৌবাচ্চার সব পানি ফেলে, নতুন পানি সরবরাহ করতে হবে। এরপর ১৫ গ্রাম চুন গুলিয়ে পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।
মাছ আহরণ
মাছের ওজন ২০০-২৫০ গ্রাম হলেই বিক্রি করে দেয়া ভালো। কারণ এ রকম মাছের চাহিদা বেশি এবং অল্প সময়ে আবার মাছ ছাড়া যাবে।
উৎপাদন
৬৭-৭৫ দিনের এক চাষে পরিপূর্ণ পরিচর্যা করলে ১০০টি পোনার প্রায় ৯৫টি বেঁচে থাকবে। যার ওজন হবে প্রায় ১৭৫ কেজি।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৪আগস্ট২০