ফিউমিগেশন হচ্ছে খামার জীবাণুমুক্ত করার অধিকতর কার্যকরি পদ্ধতি। অনেক খামারি রয়েছেন, যারা খামার ঘর বা সেড জীবাণুমুক্ত করার ব্যাপারে বেশ উদাসীন। আবার অনেকেই আছেন। যারা শুধুমাত্র পানি দিয়ে সেডের মেঝে পরিষ্কার করেই ভাবেন যে খামারের সেড বুঝি জীবাণুমুক্ত হয়ে গেল। কিন্তু আপনাদের বুঝতে হবে যে, সেড পানি দিয়ে পরিষ্কার করা আর জীবাণুমুক্ত করা দুটি এক বিষয় নয়। শুধু পানি দিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে জীবাণুমুক্ত করার একটি প্রাথমিক ধাপ মাত্র। তাই পানির সাথে বিভিন্ন জীবাণুনাশক দিয়ে সেড পরিষ্কার করার
পাশাপাশি সেডের চিপায় চাপায় লুকিয়ে থাকা জীবাণু কে ধ্বংস করতে এমন কিছু করা দরকার যেখানে জীবাণুনাশক সেডের সকল জায়গায় লুকিয়ে থাকা জীবাণুকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। হ্যা ! আর সেই পদ্ধতি –টিই হচ্ছে ফিউমিগেশন।
ফিউমিগেশন কি?
ফিউমিগেশন হচ্ছে সেড জীবাণুমুক্ত করার একটি আধুনিক পদ্ধতি। যেখানে একটা সম্পূর্ণ আবদ্ধ সেডে বা ঘরের মধ্যে পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট (পটাশ)
এবং ফরমালডিহাইড (ফরমালিন) এর একটা নির্দিষ্ট অনুপাতের মিশ্রন তৈরির ফলে প্রচুর ধোঁয়া তৈরি হয়। এবং এই ধোঁয়া সেড বা ঘরের প্রতিটি চিপায় চাপায় পৌছে যায় এবং লুকিয়া থাকা রোগ জীবাণুকে ধ্বংস করে খামারের ঘর বা সেড কে করে জীবাণুমুক্ত।
ব্রয়লার মুরগির সেড
ফিউমিগেশনের উপকরণঃ
১। পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট (পটাশ)।
২। ফরমালডিহাইড (ফরমালিন)।
৩। মাটির পাত্র।
৪। মুখের মাস্ক।
৫। চোখের চশমা।
পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট (পটাশ) ও ফরমালিনের অনুপাতঃ ১:২
১:২ মানে যত টুকু পটাশ লাগবে তার দ্বিগুণ পরিমাণ ফরমালিন লাগবে।
সেডের সাইজ অনু্যায়ী পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট (পটাশ) ও ফরমালিনের পরিমাণঃ
প্রতি ১০০ ঘনফুট জায়গার জন্য ৬০ গ্রাম পটাশ এবং ১২০ মিলি ফরমালিন লাগবে।
এখানে ঘন ফুট হচ্ছে সেডের দৈর্ঘ,প্রস্থ এবং উচ্চতার গুনফল।
উদাহরনঃ ধরুন আপনার সেডের দৈর্ঘ ৫০ ফুট আর প্রস্থ ২০ ফুট এবং সেডের উচ্চতা ৮ ফুট ।
তাহলে আপনার সেডের আয়তন হবে = ( দৈর্ঘ্য*প্রস্থ*উচ্চতা ) ঘনফুট। = ৫০*২০*৮ = ৮,০০০ ঘন ফুট।
এখন ১০০ ঘনফুট জায়গার জন্য লাগবেঃ ৬০ গ্রাম পটাশ এবং ১২০ মিলি ফরমালিন।
তাহলে ৮,০০০ ঘনফুট জায়গার জন্য লাগবেঃ (৮০০০*৬০)/১০০ =৪৮০ গ্রাম পটাশ এবং (৮০০০*১২০)/১০০ = ৯৬০ মিলি ফরমালিন।
ফিউমিগেশনের পদ্ধতিঃ
প্রথমেই আপনার সেডের মেঝে, দেয়াল, পর্দা সহ সকল জিনিসপত্র জীবানুনাশক মিশ্রিত পানি দিয়ে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিয়ে। তার ১-২ দিন পরেই ফিউমিগেশনের প্রস্তুতি নিতে হবে।
ফিউমিগেশনের ধাপগুলো নিচে দেয়া হলঃ
শুরুতেই সেডের চারিদিকের পর্দা ভালভাবে বন্ধ করে দিতে হবে যেন ভিতর থেকে বাইরে কোনো বাতাস না বের হতে পারে। পর্দা আটকানোর পরেও কোন ফাঁক থাকলে সেগুলো বন্ধ করতে হবে।
এরপরে ফিউমিগেশনের জন্য প্রয়োজনীয় পটাশ, ফরমালিন এবং এই গুলোর মিশ্রন রাখার জন্য মাটির পাত্র নিয়ে সেডে প্রবেশ করুন।
সেডে ফিউমিগেশন করার সময় অবশ্যই মুখে মাস্ক এবং চোখে চশমা পড়ে নিতে হবে। সেডে প্রবেশ করে সেডের দরজা, জানালা বন্ধ করে দিন।
এখন সেডের সাইজ অনুযায়ী নির্দিষ্ট দূরত্বে দূরত্বে মাটির পাত্র গুলো সাজিয়ে দিন।
ধরুন, আপনার সেড লম্বা ৫০ ফুট। কিন্তু আপনি যদি এই ৫০ ফুটের সেডে মাত্র একটা পাত্রেই পরিমাপ করা সকল পটাশ আর ফরমালিন ঢেলে দেন তাহলে কিন্তু ধোঁয়া টা সেডের সকল প্রান্তে ছড়াবে না। তাই ১৫-২০ ফুট দূরত্বে একাধিক পাত্র বসিয়ে সেগুলোতে সমভাগে ভাগ করে উক্ত পটাশ ও ফরমালিন ঢালতে হবে।
ফিউমিগেশনের জন্য মাটির পাত্র ব্যবহার করতে হবে। কেননা; অন্য কোনো ধাতব পাত্র নিলে তাতে দাগ পড়ে নষ্ট হয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যাবে।
ফিউমিগেশনের জন্য মাটির পাত্রে প্রথমে পটাশ রাখতে হবে এবং এর উপরে ধীরে ধীরে উপর থেকে ফরমালিন ঢালতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, কখোনোই পাত্রে আগে ফরমালিন দিয়ে তার উপরে পটাশ ঢালা যাবে না। ফরমালিন ঢালার সাথে সাথে ধোঁয়া উৎপন্ন হওয়া শুরু হয়ে যাবে এক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে যেন চোখে মূখে ধোঁয়া না প্রবেশ করে।
সেডের দরজা থেকে দূরের প্রান্ত থেকে ফিউমিগেশন করতে করতে দরজার দিকে আসতে হবে। কারণ, খুব দ্রুত পটাশ ও ফরমালিন ঢেলে সেড থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নতুবা, ধোঁয়া তৈরি হয়ে তার আপনার চোখে মুখে চলে যেতে পারে।
যত দ্রুত সম্ভব সেড থেকে বের হয়ে এসে সেডের দরজা বন্ধ করে দিতে হবে।
এভাবে আবদ্ধ অবস্থায় সেড টি ১ দিন রেখে দিতে হবে এবং একদিন পরে সেডের পর্দা, দরজা, জানালা সব খুলে দিয়ে ভিতরের সকল ধোঁয়া বের করে দিতে হবে।
ধোঁয়া বের হয়ে গেলে বাচ্চা না আসার আগ পর্যন্ত আবারো সেডের পর্দা নামিয়ে সেড টি বন্ধ করে রাখতে হবে।
ফিউমিগেশন বিশেষ সতর্কতাঃ
১। ফিউমিগেশন করার জন্য অবশ্যই যিনি ভিতরে থাকবেন তাকে মাস্ক ও চশমা পড়ে নিতে হবে।
২। ফিউমিগেশন করার জন্য মাটির পাত্র ব্যবহার করতে হবে।
৩। ফিউমিগেশন শুরু হয়ে ধোঁয়া উৎপন্ন হওয়ার সাথে সাথে যত দ্রুত সম্ভব সেড থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট (পটাশ) ও ফরমালিন কোথায় পাবেন?
পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট (পটাশ) ও ফরমালিন ঢাকার টিকাটুলির কেমিক্যালের দোকান গুলোতে পাওয়া যাবে। তবে পটাশ ও ফরমালিন দেশের অন্যান্য জায়গায় ও পাওয়া যাবে। সেটা আপনাকে নিজ দায়িত্বে খুঁজে নিতে হবে।
তবে আপনি চাইলে যেকোনো জায়গায় যেকোনো অবস্থাতে পটাশ কিনে নিতে পারবেন। কিন্তু আপনি চাইলেই ফরমালিন কিনতে পারবেন না। কেননা; ফরমালিন বিভিন্ন কারণে জনসাধারণের কাছে বিক্রি নিষিদ্ধ। তাই খামার জীবাণুমুক্ত করার জন্য আপনি ফরমালিন কিনতে চাইলে আপনার অনুমতি থাকতে হবে।
For example, যেমন, একজন রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি ডাক্তার যদি তার প্রেসক্রিপশন প্যাডে প্রেসস্ক্রাইব করে দেন। তাহলে আপনি সেটা ডকুমেন্টস হিসেবে দেখালে আপনি ডাঃ এর লিখে দেয়া পরিমাণ অনুযায়ী ফরমালিন পেতে পারেন।
এছাড়াও আপনি সে সত্যি সত্যি প্রকৃতপক্ষে একজন খামারি এবং আপনি আপনার খামার জীবাণুমুক্ত করার জন্য ফরমালিন নিতে চাচ্ছেন, সেটা প্রমাণ করার জন্য আপনার খামারের ট্রেড লাইসেন্সের ফটোকপি দেখাতে পারেন।
তবে, তিতা হলেও সত্য এই যে, এসব কিছু না থাকলেও আপনি দোকান থেকে পটাশ এবং ফরমালিন কিনতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে একটু অতিরিক্ত দামে কিনতে হতে পারে। তবে যেহেতু আমরা লিগ্যাল কাজে ব্যবহার করব, তাই আমরা চেষ্টা করব সকল ডকুমেন্টস দেখিয়ে লিগ্যাল্ভাবে ক্রয় করতে।
পটাশ ও ফরমালিনের দাম কত?
বাজারে সাধারণত প্রতি কেজি পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট বা পটাশের দাম ৫৫০ – ৬৫০ টাকা।
এবং প্রতি লিটার ফরমালিনের দাম ১৫০০ – ১৬০০ টাকা।
সারকথাঃ
পুরো লেখা টা পড়ে ফিউমিগেশন করা টা একজন খামারির কাছে অনেক জটিল এবং ব্যয়বহুল মনে হতে পারে। কিন্তু, বাস্তবে এই কাজগুলো কয়েকবার করলে তখন আর কঠিন মনে হবে না। শুধু সাদা পানি দিয়ে সেড পরিষ্কার করার মতই সহজ হয়ে যাবে। তবে, প্রশ্ন উঠতে পারে খরচ নিয়ে। হ্যা খরচ একটু বেশিই ।
কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, আল্লাহ না করুকঃ এই অল্প কিছু টাকা বাঁচানোর জন্য যদি আপনার সেডে পূর্ববর্তী ব্যাচের রেখে যাওয়া কোনো রোগজীবাণু আপনার বর্তমান ব্যাচে হয়ে যায়।
তবে তো ঔষুধের টাকাই চলে যাবে ফিউমিগেশনের চেয়ে ঢেড় বেশি। আর পুরো ব্যাচে হাই মর্টালিটি হলে তো আম-ছালা দুই যাবে। তাই কৃপণের ধন পিপড়াকে না খাইয়ে বিজ্ঞান সম্মতভাবে ফার্মিং করুন; লাভবান হোন।যেকোনো প্রয়োজনে অবশ্যই নিকটস্থ ভেটেরিনারি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। মনে রাখবেন; ডাক্তার আপনার শত্রু নয়; ডাক্তার আপনার বন্ধু। আপনার ফার্মের কল্যাণের জন্য আপনি যেমন চিন্তিত, ডাক্তার ও ঠিক তার চাইতে কম চিন্তিত নয়। তাই ভয় না পেয়ে যেকোনো সমস্যার শুরুতেই কোয়াক বা হাতুড়ের কাছে না গিয়ে একজন ভেটেরিনারি ডাঃ এর স্মরণাপন্ন হোন।
লেখকঃ ডাঃ শ্রাবণ হাসান সজল
সিইও, সোনালি কৃষি ডটকম
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৩সেপ্টেম্বর২০