বাংলা, হিন্দি, উর্দু, মারাঠি, তেলেগু, তামিল সব ভাষাতেই এর এক নাম পুদিনা। এটা সুগন্ধিগাছগুলোর মধ্যে অন্যতম। ছড়ার মধ্যেও বাজার থেকে পুদিনাপাতা কেনার ফরমায়েশ পাওয়া যায় ‘পুদিনা আনিও, পান আনিও’। খাদ্যকে সুরেচক করতে পুদিনাপাতার কোনো জুড়ি নেই। শহরাঞ্চলে দিন দিন এর চাহিদা বাড়ছে। সুদূর অতীত থেকে এ দেশে পুদিনাপাতার চাষ হয়ে আসছে। কিন্তু সেটা বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ নয়, কোনোভাবে বাড়ির আঙিনায় দু-চারটা গাছ লাগিয়ে পারিবারিকভাবে ব্যবহার করা। আজকাল বাজারে আঁটি আঁটি পুদিনাপাতা সারা বছর বিক্রি হচ্ছে। তাই পুদিনাকে শুধু বাড়ির আঙিনায় আটকে রাখা ঠিক হবে না। চাইলে অন্য ফসলের মতো বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে লাভবান হওয়া যাবে। বিদেশেও পুদিনাপাতার চাহিদা আছে। রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও সুযোগ হতে পারে। পুদিনাপাতার ওপর ভিত্তি করে স্থাপিত হতে পারে পিপারমেন্ট অয়েল উৎপাদন শিল্প।
গাছ পরিচিতি: পুদিনা একটি সাধারণ আগাছা ধরনের গাছ। কান্ড ও পাতা বেশ নরম। কান্ডের রঙ বেগুনি, পাতার রঙ সবুজ। পাতা ডিম্বাকার, পাতার কিনারা খাঁজকাটা। পাতা কিছুটা রোমশ ও মিন্টের তীব্র গল্ডধযুক্ত। গাছের নিচের অংশ থেকে অনেক ধাবক বের হয়। পুদিনাপাতার গাছ লেবিয়েটিসি পরিবারের মেন্থা গনের অন্তর্গত। এ গনের তিনটি প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে এ দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশে ভালো জন্মে। জাপানি জাত চাষের জন্য ভালো।
ব্যবহার: পুদিনাপাতার গাছ থেকে পিপারমেন্ট তেল তৈরি হয়। তেল বেশ মূল্যবান। বিভিন্ন প্রসাধনসামগ্রী বিশেষ করে টুথপেস্ট, মিন্ট চকোলেট ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়। ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১০ টন পিপারমেন্ট তেলের শিল্প চাহিদা রয়েছে বলে জানা যায়। এই পরিমাণ তেল উৎপাদনের জন্য ১০ হাজার একর জমিতে পুদিনা উৎপাদন করতে হয়। কিন্তু উৎপাদন অনেক কম হওয়ায় প্রতি বছর প্রায় কোটি টাকার পিপারমেন্ট অয়েল তাদের বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের বাজারে মূলত কাঁচা পুদিনাপাতার চাহিদাই বেশি। প্রতি বছর আমাদের দেশে প্রায় ১৮ হাজার মেট্রিক টন কাঁচা পুদিনাপাতার চাহিদা রয়েছে। পুদিনা এ দেশে চাষ হয় মূলত চাটনি, সালাদ আর বোরহানি বানানোর জন্য। এর যে আরো অনেক ব্যবহার আছে সেটাই হয়তো আমরা জানি না। কাঁচা পুদিনাপাতার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় চাটনি ও সালাদে। ইদানীং বিভিন্ন পার্টিতে টক দইয়ের বোরহানি তৈরির জন্য পুদিনা পাতার ব্যবহার বেড়েছে। এ ছাড়া মাছ, গোশত, সস, স্যুপ, চা, তামাক, শরবত ইত্যাদি সুগল্ডিধ করতে পুদিনাপাতা ব্যবহার করা হয়। ইউরোপের দেশগুলোতে ভেড়ার গোশতের রোস্ট ও মিন্ট জেলি তৈরি করতে পুদিনাপাতা ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন দেশে পুদিনার বেশি ব্যবহার তেল তৈরিতে। গাছে যখন ফল আসে তখনই পাতায় তেলের মাত্রা বাড়ে। ওই সময় গাছ তুলে পাতন প্রক্রিয়ায় তেল নিষ্কাশন করা হয়। গাছের নিচের পাতা হলদে হওয়া শুরু করলেই কাটিং নিয়ে তেল নিষ্কাশন করা হয়। মৌসুমে একই গাছ থেকে দু’বার কাটিং সংগ্রহ করা যায়। কাটিংগুলোকে ছোট ছোট আঁটি বেঁধে ঝুলিয়ে শুকানো করতে হয়। কাঁচা পাতার চেয়ে শুকনো পাতা থেকে তেল নিষ্কাশন সহজ ও সস্তা।
চাষাবাদ: কাটিং বা তেউড় লাগিয়ে চারা তৈরি করা হয়। পুরনো ক্ষেত থেকে কাটিং নিয়ে হাপরে বসিয়ে চারা তৈরি করে নিতে হবে। কাটিংয়ের দৈর্ঘ্য হবে ১০ সেন্টিমিটার। জমিতে চারা রোপণের সপ্তাহখানেক আগে চারা তৈরি করতে হবে। প্রতি হেক্টর জমি চাষের সময় মাটির সাথে ১০ থেকে ১৫ টন গোবর বা জৈবসার মিশিয়ে দিতে হয়। জমি ভালোভাবে চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করার পর চারা রোপণের আগে ৪৫-৫০ সেন্টিমিটার চওড়া করে বেড তৈরি করতে হয়। বেডের উচ্চতা হবে ১৫-২০ সেন্টিমিটার। প্রতি বেডের মাঝে নালা থাকবে। বেডের দৈর্ঘ্য জমির আয়তন অনুসারে কম-বেশি হতে পারে। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য বেডের আকার একটু অন্য রকম হবে। এক্ষেত্রে বেড ১ মিটার চওড়া ও ৪৫ মিটার লম্বা হবে। এ পরিমাণ জমির জন্য গোবর বা কম্পোস্ট সার লাগবে ২০ ঝুড়ি (২০০ কেজি), হাড়ের গুঁড়া ৫ কেজি, টিএসপি সার ১-১.৫ কৈজি, কাঠের ছাই ৫ কেজি অথবা এমওপি সার ১ কেজি।
এসব সার বেড তৈরির সময় বেডের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বর্ষার আগে ও পরে চারা রোপণের নিয়ম। সে অনুযায়ী জুন অথবা অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পুদিনার চারা রোপণ করা যেতে পারে। বেডে ৩০ সেন্টিমিটার পরপর চারা রোপণ করা যেতে পারে। চারা রোপণের পর সেচ দিতে হবে। প্রতি দুই মাস পরপর প্রতি বর্গমিটারে ২০ গ্রাম করে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। গাছ লম্বা হতে শুরু করলে ১০ সেন্টিমিটার মাপের কাটিং বা ডাল কেটে ১০-১৫টি ডাল একটি আঁটিতে বেঁধে বাজারে বিক্রির জন্য পাঠাতে হবে। প্রতি দু’বার কাটার পর একই নিয়মে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার দেয়ার পর সেচ দিতে হবে। বাণিজ্যিক জমিতে চারা রোপণের ১০-১২ সপ্তাহ পর থেকে প্রতি মাসে একবার করে প্রতি বর্গমিটারে ২০ গ্রাম করে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করে যেতে হবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৪সেপ্টেম্বর২০