খুব রসালো এবং মিষ্টি একটি ফল লংগান। লংগান বর্তমানে গ্রীষ্মমন্ডলীয় বিভিন্ন দেশে জন্মে থাকে। চলুন লংগান ফলের পরিচয়, মৌসুম, চাষ পদ্ধতি, উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
লংগান ফলের পরিচিতি:
লংগান ফলটি মূলত এশিয়া মহাদেশে বাস করা উষ্ণ অঞ্চলের গ্রষ্মমন্ডলীও একটি ফল। এটি সোপবেরি পরিবারের (লিচু ও রামবুটান) একটি সদস্য। লংগান ফলের মধ্যে সাদা রঙের মাংসটি খাওয়া হয়ে থাকে। এই ফলটি লিচুর ফলের সাথে অনেকটা মিল লক্ষ করা যায়।
লংগান ফলটির উপরের ছাল বাদামী রঙের। ভিতরের ভোজ্য অংশটি সাদা নরম এবং সাদা অংশের মাঝখানে একটি কালো রঙের বীজ থাকে। লংগান ফলগুলি অনেক রসালো। এই ফলগুলো গাছে গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠে।
লংগান ফলটি মূলত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের একটি ফল। এই ফলটি চীন, বার্মার কিছু অঞ্চল, ও ভারতে উৎপত্তি বলে মনে করেন অনেকে। আর এখন বর্তমানে লংগান বাংলাদেশসহ অনেক দেশে জন্মে থাকে। লংগান গাছটি চিরসবুজ গাছ। এই গাছের উচ্চতা ১৫ ফুটের কিছু বেশি হয়ে থাকে।
লংগান ফলটির উপরের খোসা ছাড়ালে চোখের বলের মত দেখা যায়। আর এজন্যই চীন ভাষায় একে “ড্রাগনের চোখ” বলা হয়ে থাকে।
লংগান ফলের মৌসুম:
লংগান ফলের মৌসুম দেশ ভেদে বিভিন্ন সময় হয়ে থাকে। কিছু দেশে ফেব্রুয়ারি, মার্চ থেকে মে মাসের প্রথম দিকে ফুল ফোটে। আবার অনেক দেশে ডিসেম্বর মাসের শেষের থেকে ও ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ফুল শুরু হয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে এপ্রিলের শুরুতে ফুল ফোটে। দক্ষিণ গোলার্ধে অক্টোম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে ফুল ফোটে।
লংগান ফুল ফোটা থেকে শুরু করে ফল পাকতে সময় লাগে প্রায় ৫ মাসের মতো।
লংগান ফলের বিবরণ-মৌসুম-চাষ-উপকারিতা-পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
লংগান চাষের পদ্ধতি:
লংগান ফলের একটি গাছ বৃদ্ধি করতে মাটি, জল, কীটপতঙ্গ, বিভিন্ন রোগ, কীটনাশক ইত্যাদির প্রতি নজর রাখা বিশেষ প্রয়োজন।
লংগান গাছটি স্টেম কাটিং, এয়ার লেয়ারিং, গ্রাফটিং ও বীজ থেকেও জন্মে থাকে। লংগান বীজ থেকে গাছ জন্মাতে চাইলে বীজটি তাজা অবস্থায় রোপন করতে হয়। তবে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন পেতে কলমযুক্ত গাছ জন্মানোই সবচেয়ে উত্তম।
পুষ্ট বীজগুলিকে ৩-৪ দিনের জন্য ছায়াযুক্ত স্থানে শুকিয়ে নিতে হবে। তারপর তাদের সঙ্গে সঙ্গে রোপন করতে হবে, তানা হলে বীজগুলি তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে।
বীজটি ২ সেন্টিমিটারের মতো গভীরতায় বপন করতে হবে। বেশি গভীরে বপন করলে অনেকগুলি অঙ্কুরোদ হতে পারে। লংগান বীজের অঙ্কুরোদগম ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই হয়ে থাকে। আর সময় লংগান গাছের চারা ছায়াযুক্ত স্থানে রোপন করতে হবে। ২ থেকে ৩ বছর বয়সের চারা লাগানোই উত্তম।
লংগান গাছের চারাটি যেখানে লাগাবেন, সেই স্থানটি শুষ্ক ও উষ্ণ হতে হবে এবং দীর্ষক্ষণ ভেজা থাকলে হবে না। কারন অত্যাধিক ভিজা মাটির কারণে গাছটি মারা যেতে পারে।
লংগান গাছটি মূলত চুনামাটি, বেলে দোআঁশ মাটি, বালি মাটি ও পাথুরে মাটি পছন্দ করে থাকে। ছোট লংগান গাছে নিয়মিত জল দিতে হবে। গাছে ফল না আসা পর্যন্ত নিয়মিত জল দিতে হবে। বেশি বৃষ্টি পাতের ফলে অনেক সময় লংগান ফুল আসতে নাও পারে বা ফুলের পরিমাণ কম হতে পারে।
ছোট লংগান গাছগুলিতে জৈব সার ভালো কাজ করে থাকে। জৈব সার হিসেবে গবর সার ৯ থেকে ১০ কেজি প্রতিটি গাছে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং বছরে প্রায় ২ থেকে ৩ বার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
লংগান চারা রোপনের প্রথম বছর প্রতি ১.৫ মাস পর পর ১০৯ গ্রাম এনপি সার দেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয় বছর ৩.৫ মাস পর পর ২২৫ গ্রাম সার দিন। তৃতীয় বছর প্রতি ৩.৫ মাসে ৪৪৫ গ্রাম সার দিন।
পরিপক্ক গাছে ফুল ফুটার আগে ১.৫ – ২.১৫ কেজি সারের প্রয়োজন। উষ্ণ অঞ্চলে ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম, মলিবডেনম এবং দস্তার তরল স্প্রে করতে হবে।
বীজ থেকে জন্মানো লংগান গাছে ফল আসতে সাধারণত ৬ থেকে ৭ বছর সময় লেগে থাকে। লেয়ারিং ভাবে জন্মানো গাছগুলিতে ফল আসতে ২ থেকে ৩ বছর সময় লাগে এবং গ্রাফটেড ভাবে জন্মানো গাছে ফল আসতে সময় লাগে কয়েক মাস।
লংগান গাছটি বসতবাড়ি থেকে একটু দুরে লাগানোই ভালো কারণ এর শিকড়গুলি অনেক দুর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে।
লংগান ফলের বিবরণ-মৌসুম-চাষ-উপকারিতা-পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
লংগান ফলের উপকারিতা:
লংগান ফলটি বিভিন্ন ধরণের ঔষধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। স্বাস্থ্যকর ত্বক, মন ও শরীরকে প্রফুল্ল দিতে এই ফলের জুড়ি নেই। লংগান ফলটি পটাশিয়ামে ভরপুর হওয়ায় এটি মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়াকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করে।
লংগান ফলে ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। আর এগুলো ত্বকের ক্ষয়রোধে বাধা প্রদান করে থাকে। লংগান ফলটি ত্বককে উজ্জল, ত্বকের পুষ্টি, চুলকানি ও বার্ধক্যজনীত সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।
লংগান ফলে রয়েছে প্রচুর আয়রন। যা শরীরের ক্লান্তি দুর করতে সহায়তা করে। এই ফলটি সেবনের ফলে শরীরে শক্তি সরবরাহিত হয়, ফলে ক্লান্তি ভাব কেটে যায়।
লংগান ফলে প্রচুর পরিমাণে ফসফরাস বিদ্যমান। এটি শরীরের বিভিন্ন হাড়, পেশী ও জয়েন্টের ব্যথা দুর করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। লংগান ফলের বীজের গুড়া পাউডার ফুলে যাওয়া, ক্ষত, পাকা ক্ষত এই রোগগুলির মহোঔষধ। বীজটি মূত্রনালীর বিভিন্ন ধরণের সমস্যাও সমাধান করে থাকে।
লংগান চীন দেশে বিভিন্ন মেডিসিনে হজম, ব্যথা, জ্বর এবং সাপের বিষের প্রতিষেধক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। লংগান ফল, বীজ ও ফুল বিভিন্ন রোগের প্রতিকার হিসেবে ঔষধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। লংগান বীজের গুড়া ফোলাভাব, রক্তপাত, একজিমা ও ব্যথার পথ্য হিসেবেও ব্যহহৃত হয়ে থাকে।
লংগান ফলের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া:
বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষার কমতি থাকার কারণে লংগান ফলের খুব বেশি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না। লংগান ফলের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া খুব বেশি নেইও।
লংগান ফল অধিক পরিমাণে সেবনের ফলে দীর্ষকালীন অ্যালার্জি হতে পারে। ডায়াবেটিস রোগিদের বেশি লংগান খাওয়া উচিত নয়। লংগান সংবেদনশীল ব্যক্তিদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে।
উপসংহার:
লংগান ফলটি বিভিন্নভাবে খাওয়া হয়ে থাকে। লংগান ফলের জুস, বিভিন্ন ধরণের রান্নায় লংগান, লংগান ফলের জেলি, লংগান ফলের ক্যাপো ইত্যাদি। লংগান ফলটি ছোট বড় সবার কাছে অনেক মিষ্টি এবং রসালো একটি ফল। আর অতিরিক্ত সব কিছুই স্বাস্থ্যের জন্য কিছুটা হলেও সমস্যা সৃষ্টি করে। সুতরাং নিয়ম মাফিক ফলটি গ্রহণের ফলে অনেক সমস্যার সমাধান ও পুষ্টির অভাব থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৮সেপ্টেম্বর২০