অতিবৃষ্টি, বন্যাসহ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সবজিচাষি তথা কৃষকদের সুবিধার্থে সুনামগঞ্জে গ্রিনহাউস পদ্ধতিতে মাটিবিহীন উচ্চফলনশীল নানা জাতের সবজি চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে উচ্চফলনশীল সবজির চারা উৎপাদন করছে ‘গ্রিনহিল সিডলিং ফার্ম’নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সিলেট বিভাগের হাওরাঞ্চলে এই পদ্ধতিতে বারো মাস উচ্চফলনশীল সবজির চারা উৎপাদন এটিই প্রথম। এতে স্থানীয় কৃষকরা বাড়ির কাছে উন্নতমানের চারা পাচ্ছেন।
শনিবার (১৭ অক্টোবর) বিকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জাহাঙ্গীররগর ইউনিয়নের সীমান্তের গ্রাম আমপাড়ায় দেড় একর জমি ভাড়া নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘গ্রিনহিল সিডলিং ফার্ম। এই ফার্মে একসাথে ৫০ হাজার চারা উৎপাদনের সমক্ষমতা রয়েছে।
মাটিবিহীন পদ্ধতিতে শূন্য মৃত্যুহার ও পোকা-মাকড়ের বিরুদ্ধে শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন চারা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে আগাম উচ্চফলনশীল কয়েক প্রজাতির টমেটো, লাউ, ফুলকপি ও মরিচের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে।
মাটির বদলে প্লাস্টিকের তৈরি বিশেষ ট্রেতে কোকোপিট ব্যবহার করে শতভাগ শিকড়যুক্ত চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। এখানে প্রতিটি চারা দুই থেকে তিন টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। পলিহাউসের ভেতরে উৎপাদিত চারা ২০ দিন পরে রোপণযোগ্য হয়ে ওঠে। চারাগুলো শতভাগ শিকড়যুক্ত থাকায় রোপণের পর মৃত্যুহার প্রায় শূন্য এবং মাটিবাহিত রোগজীবাণু মুক্ত।
আধুনিক এই পলিহাউসে প্লাস্টিক ট্রেতে মাটির বদলে নারকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি কোকোপিট প্রক্রিয়াজাত ও জীবাণুমুক্ত করে বীজ বপন করা হয়। রোদের তাপ থেকে চারার সুরক্ষার জন্য ওপরে শেডনেট জুড়ে দিয়ে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয় কৃত্রিম উপায়ে। তা ছাড়া গ্রিনহাউসের ভেতরে রয়েছে কৃত্রিম দাঁড়কাক। কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে পোকা ঢুকলে তা ওই দাঁড়কাক শুষে নেয় সহজে। আধুনিক পলিহাউসে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সবজির চারা উৎপাদন হওয়ায় এখানের চারা নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা।
সবজিচাষিরা বাড়ির কাছে উন্নতমানের চারা পাওয়ায় সময়মত চাষাবাদের সুযোগ পাচ্ছেন। এখানে নিয়মিত চারা উৎপাদন হলে এলাকায় কৃষি বিপ্লব ঘটবে বলে দাবি স্থানীয় কৃষক, কৃষি বিভাগ ও উদ্যোক্তাদের।
উদ্যোক্তাদের দাবি, হাওরাঞ্চলে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যার অবস্থা বিবেচনা করে কৃষকদের বারো মাস সবজি চাষে উৎসাহিত করে চারার উৎপাদন বাড়ানোর তাদের লক্ষ্য। গ্রিনহিল সিডলিং ফার্মের উদ্যোক্তা হাসান আহমদ জানান, মেঘালয়ের পাশে হওয়ার এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব বেশি। যে কারণে এই অঞ্চলের কৃষকরা বীজতলা তৈরি করতে নানা রকমের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। আগাম বীজতলা তৈরি করতে অনেক কষ্ট হয়।
অনেক সময় বৃষ্টিপাতের কারণে বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়, কৃষকরা সময় মত চারা উৎপাদন করতে পারেন না এবং আগামী সবজি উৎপাদনে ব্যর্থ হয়। যে কারণে কৃষকরা তাদের পরশ্রিমের ন্যায্যমূল্য পায় না। আমাদের লক্ষ্য কৃষকদের আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নত সবজির চারা প্রদান করা। সেটাকে চিন্তা করেই এখানে আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করে গ্রিনাহাউসের সংস্করণে উন্নতমাণের পলিহাউসের ভেতরে পাইলট প্রকল্প শুরু করেছি। কৃষকদের কাছে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।
কৃষকদের উন্নয়নের জন্য প্রকল্প বৃদ্ধি করব। ভবিষ্যতে ৫ থেকে ১০ লাখ চারা উৎপাদনের সক্ষমতার বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছি। গ্রিনহিল সিডলিং ফার্ম, সুনামগঞ্জের পরিচালক গাজী নুরুল ইসলাম জানান,কৃষকদের উচ্চ ফলনশীল চারা সরবরাহ করতে এই চারার খামার তৈরি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় কৃষকসহ পুরো সিলেট বিভাগের সকলকে আমরা চারা দিয়ে সহযোগিতা করতে চাই। অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
এরমধ্যেই ব্যাপক সাড়া ফেলেছ। আমরা সহজমূল্যে কৃষকদের চারা দিচ্ছি। আমরা অনেক চারা বিক্রি করেছি। আরও অনেকেই অগ্রিম টাকা দিচ্ছেন চারা নেওয়ার জন্য। আশা করি সরকার আমাদের এই উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে আমাদের সহযোগিতা করবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোস্তফা ইকবাল আজাদ জানান, গ্রিনহাউস পদ্ধতিতে উচ্চফলনশীল সবজি চারা উৎপাদন খামার ‘গ্রিনহিল সিডলিং ফার্ম’ সিলেট অঞ্চলে সুনামগঞ্জে প্রথম। এই ফার্ম থেকে ইতোমধ্যে চারা উৎপাদন শুরু হয়েছে। চাষিরা এখান থেকে চারা নিচ্ছেন এবং উপকৃত হচ্ছেন। এই ফার্মের উপকারিতা হলো এখানে সারা বছরই চারা উৎপাদন করা যায়।
বেশি গরম, অতি বৃষ্টি, অতি রোদ থেকে চারা রক্ষা করার জন্য এই ফার্ম সুনামগঞ্জে প্রথম চালু হয়েছে। পর পর চারবারের বন্যার কৃষকদের শাক সবজির অনেক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি পূষিয়ে নেয়ার জন্য এখান বিভিন্ন জাতের সবজি চারা নেওয়া শুরু হয়েছে। এখানে নিয়মিত চারা উৎপাদন করতে পারলে শাক-সবজি উৎপাদনে সুনামগঞ্জে বিশাল পরিবর্তন আনবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২২অক্টোবর২০