হটাৎ পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ডিম-মাংসের দাম অস্বাভাবিক ভাবে কমে যাওয়ায় যাওয়ায় হতাশ হাজার হাজার পোল্ট্রি খামারি। রাজশাহী সহ উত্তরাঞ্চলের ডিম উৎপাদনকারী খামারিরা পড়েছেন চরম বিপাকে।
একদিকে কমছে ডিমের দাম অপরদিকে খাদ্য ও ভ্যাকসিনের দাম যেন আকাশ ছোঁয়া। প্রতিনিয়ত খাদ্য কোম্পানিগুলো খাদ্যের দাম বস্তা প্রতি ৬০ থেকে ৮০ টাকা বাড়িয়ে চলেছে। প্রান্তিক খামরিরা প্রতি কেজি খাদ্যে ১ থেকে দেড় টাকা বৃদ্ধি যেন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট আর অদৃশ্য হাতেই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প। এ খাতকে কুক্ষীগত করে প্রান্তিক খামারিদের ধ্বংশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে বড় বড় কোম্পানি।
চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই কমেছে ডিমের দাম। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারিতে প্রতি এক’শ লাল বাদামি ডিমে গড়ে কমেছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা, সাদা ডিমে কমেছে ৯০ থেকে ১২০ টাকা। এছাড়াও অঞ্চলভেদে এ দাম আরোও কমেছে বলে জানা গেছে। খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমে নাই হয়ে গেছে প্রায় দেড় থেকে ২ টাকা। তবে, এ দামে লাভ না হলেও লোকসান হবে না। এর বেশি দাম কমলে অবস্থা বেগতিক হবে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
অপরদিকে খাদ্যের দামে নাভিশ্বাস উঠছে খামারিদের। শুধু ডিমপাড়া লেয়ার নয় বিপাকে পড়েছে মাংস উৎপাদনকারী ব্রয়লার মুরগি খামারিরাও। একদিনের ব্রয়লার বাচ্চা ৩০-৩৫ টাকায় কিনে বিক্রির উপযোগী করতে প্রায় ৭০-৭৫ টাকা খরচ হয়। অথচ বাজারে প্রতিকেজি ব্রয়লার ৮৮-৯০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। ক্রমাগত বাড়ছে বাচ্চার দাম, অপরদিকে কমছে মাংসের দাম। অস্বাভাবিক হারে ডিম, মাংসের দাম কমার কারণে আগ্রহ হারাচ্ছেন তারা। আবার খাদ্যের দাম বস্তাপ্রতি ৬০-৮০ টাকা বৃদ্ধি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না খামারিরা।
খুচরা ও পাইকারি ডিম-মাংস বিক্রেতা, পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা, খাত সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, করোনা কালে ডিম-মাংসের বাজারে বড় ধরণের গ্যাপ তৈরি হয়েছিল। এখন উৎপাদন বাড়ায় সে গ্যাপ পূরণ হতে শুরু করেছে। বাজারে ক্রমাগত বাড়ছে ডিম ও মুরগির মাংস। এ কারণেই দাম কমছে বলে জানান তারা। এছাড়া শীত মৌসুমের শুরুতে ডিমের উৎপাদন অনেকটাই বেড়ে যায়। উৎপাদন বাড়ার কারনে দাম কমতে শুরু করে। শীতে বিভিন্ন রোগের আক্রমণে মুরগি মারা যায়, তখন দাম বাড়তে শুরু করে। এছাড়া মুরগি বিক্রি হয়ে গেলে শীতের শেষে ডিমের দাম খামারিদের অনুকূলে চলে আসে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
এ বিষয়ে কথা হয় রাজশাহী পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হকের সাথে। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, খুচরা পর্যায়ে ও উৎপাদক খামারি পর্যায়ে সম্প্রতি ডিমের দাম কমে গেছে। প্রতিটি ডিমের বিপরীতে প্রায় দেড় থেকে ২ টাকা হারে কমেছে। অপরদিকে খাদ্যের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৪০-৬০ টাকা। উভয়সঙ্কটে পড়েছে খামারি ও উদ্যোক্তারা। তারা পারছে না উৎপাদন বন্ধ করে দিতে। কারণ ডিমপাড়া লেয়ার মুরগি পালন দীর্ঘমেয়াদি প্রজেক্ট। করোনায় একবার মার খেয়ে উঠে দাঁড়াতেই আবারো দাম কমে গেছে।
তবে, প্রতি বছর শীতের শুরুতে ডিমের দাম কমে যায়, আবার বাড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের প্রণোদনা ঋণ সহজ করা, খাদ্যের দাম কমানো, তুলনামূলক ভ্যকসিনের দাম কমালে খামারিদের রক্ষা হতে পারে। সরকারের সু-দৃষ্টি ছাড়া এ খাম রক্ষা করা মোটেও সম্ভব হবে না বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
জয়পুরহাট, বগুড়া–, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ ও গাইবান্ধা জেলার পোল্ট্রি সেক্টরের সাথে জড়িতদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে একটি ডিমের উৎপাদন ও তা’ পাইকারী পর্যায়ে বিক্রি পর্যন্ত খামারীদের খরচ পড়ে ৬ টাকা, অথচ এই মুহূর্তে পাইকারী পর্যায়ে উৎপাদক খামারিরা একটি ডিমের দাম পাচ্ছে মাত্র ৬.৬০ থেকে ৬.৭০ টাকা। লোকসান না হলেও এভাবে চলতে থাকলে খামারে কর্মরত শ্রমিক, মুরগির ভ্যাকসিন, খাদ্যেও দাম বৃদ্ধি সব মিলিয়ে ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে। কয়েকমাসে তা মূলধনে আঘাত হানবে বলে জানান তারা। ইতোমধ্যে কিছু প্রান্তিক খামরি ব্যবসা ধরে রাখতে জমি বিক্রি করেছেন বলে জানা গেছে।
তারা আরো জানিয়েছে, ডিমের উৎপাদন উৎপাদক খামারিদের হাতে নিয়ন্ত্রণের কোন সুযোগ নাই। প্রতিদিনের ডিম পাড়া বা উৎপাদনের বিষয়টি নির্ভর করে ডিম পাড়া মুরগির উপর। খাবার কম দিলে মুরগির গ্রোথ কমে যায়, অসুস্থ হয়ে পড়ে। অপরদিকে হটাৎ ডিমের দাম বাড়লেও মুরগির অসুস্থতার কারণে কমপক্ষে দু-সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয় উৎপাদনে ফিরতে।
একাধিক খামারি জানিয়েছেন, ডিমের পাইকারি বাজারে সিন্ডিকেট আছে। ব্রয়লার এর বাচ্চা উৎপাদকদের সিন্ডিকেট আছে। পোল্ট্রি ফিডের ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে খাদ্যের দাম এভাবে বৃদ্ধি পায়। তাদের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ আছে এবং সংখায়ও তারা কম। ফলে তারা তাদের পক্ষে সিন্ডিকেট করা সহজ হয়। বড়বড় কোম্পানি ডিম ও মাংস উৎপাদনে নামার কারণে ও সিন্ডিকেটের কবলে প্রান্তিক খামরিরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।
এর আগে করোনায় লোকসান গুণতে গুণতে হতাশ খামারিরা বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় ডিম ভেঙ্গে এবং সড়ক অবরোধের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেও দীর্ঘসময় পর্যন্ত লোকসানে পড়েন তারা। পরে করোনা ভীতি কমলে বাড়ে ডিম ও মাংসের দাম। বর্তমানে আবারো কমতে শুরু করায় আতঙ্কিত তারা।
ডিম-মাংসের দামে হতাশ হাজার হাজার পোল্ট্রি খামারি। এসব খামারিদের আর্থিক সহযোগিতার বিষয়ে এগ্রিকেয়ার২৪.কমের কথা হয় রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক ডাঃ মোঃ রুহুল আমিন আল ফারুক এর সাথে।
তিনি বলেন, করোনা শুরুর দিকে ডিমের, মাংসের দাম কমে যাওয়ায় খামারিরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। পরবর্তীতে সরকারি প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে প্রোটিন জাতীয় খাবারের প্রতি আগ্রহী করতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমানে ডিমের দাম কমার কারণ হলো- করোনাকালে যেসব খামারে উৎপাদন বন্ধ ছিল সেসব খামার আবারো উৎপাদনে ফিরেছে।
সরকারি প্রণোদনা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের আর্থিক সহযোগিতা করা হবে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে একটি তালিকা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। প্রণোদনার টাকা আসলে খামারিরা পাবেন। এছাড়া খামারিরা ব্যাংক থেকে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ নিতে পারেন।
সূত্র: এগ্রিকেয়ার
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৫নভেম্বর২০২০