লেবু গাছের গুরুত্বপূর্ণ রোগ ও তার প্রতিকার

857

রােগের নামঃ
(১) আগা মরা বা এনগ্রাকনােজ (Die back or Anthracnose) রোগঃ
কোলেটোট্রিকাম গ্লোওস্পােরােয়ডিস (Colletotrichum gloeosporioldes) নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রােগ হয়ে থাকে।
এ রােগের ছত্রাক মাটিতে ও গাছের পরিত্যক্ত অংশে বেঁচে থাকে। বসন্তকালে বৃষ্টি পড়ার সাথে সাথে কালাে বিন্দুগুলো ফেটে কনিডিয়াম বের হয়। বৃষ্টির ছিটা ও বাতাসের সাহয্যে আক্রান্ত গাছ থেকে কনিডিয়াম ছড়িয়ে পড়ে এবং অন্য গাছকে আক্রমণ করে।

‌রােগের লক্ষণঃ
পুরাতন পাতায় ঈষৎ সবুজ রংগের দাগ পড়ে।
ক্রমে দাগ বাদামী হয়ে যায়। রােগ পাতার আগায় ও কিনারায় বেশী হয়। ডালও আক্রান্ত হয়ে আগা থেকে শুরু করে নীচের দিকে ধীরে ধীরে শুকাতে থাকে। ডাল শুকানোর সাথে সাথে পাতা ঝরে পড়ে।
এ জন্য গাছে অনেক পত্রবিহীন মৃত, অর্ধমৃত অথবা রােগাটে ডাল দেখতে পাওয়া যায়। মরা ডালে অসংখ্য কালাে কালো বিন্দুর ন্যায় এসারভূলাস উৎপন্ন হয়। এ সময় গাছে ফল থাকলে রােগ বোঁটাতেও সংক্রমিত হয়। আক্রান্ত বোঁটা দূর্বল হয়ে ফল ঝরে পড়ে।
আক্রান্ত ফলের খােসায় শক্ত কুঁচকানাে বাদামী দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করলে তাতে পঁচন দেখা যায়।

‌রােগের প্রতিকারঃ
• সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত লেবুর কলম/ চারা রোপণ করতে হবে।
• গাছের মরা ডালপালা, ফলের বােটা, রােগ বা পােকা আক্রান্ত ডাল পালা ও অতি ঘন ডাল পালা ছাঁটাই করে পরিস্কার করে দিতে হবে।
• আক্রান্ত অংশ ছাটার সময় দাগের নীচেও কিছুটা সুস্থ অংশ কেটে ফেলতে হবে এবং কাটা অংশে বোর্দোপেষ্ট (প্রতি লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম পুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন) লাগাতে হবে।
গাছের নিচে ঝড়ে পড়া পাতা ও ফল সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে।
• গাছকে সতেজ রাখার জন্য প্রয়ােজনীয় সুষম সার শিকড়ের চারপাশে দিয়ে পানি সেচ দিতে হবে।
প্রােপিকোনাজোল গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-টিল্ট ২৫০ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে গাছে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার গাছে স্প্রে করতে হবে।
(২) ক্যাঙ্কার (Canker) রােগঃ
জ্যানথােমােনাস সাইট্রি (Xanthomons citri) নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ ব্যাকটেরিয়া রােগাক্রান্ত গাছের
পরিত্যক্ত অংশে বেঁচে থাকে এবং নতুনভাবে অন্য গাছকে আক্রমণ করে। বাতাস ও পানির দ্বারা ব্যাকটেরিয়া এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়ায়। ব্যাকটেরিয়া স্টোমাটা ও যে কোন ক্ষতের মাধ্যমে গাছের মধ্যে প্রবেশ করে।

‌রােগের লক্ষণঃ
এ রােগে পাতা, আগা ও ফল আক্রান্ত হয়।
প্রথমে কচি পাতায় ছােট ছােট তেলের ফোটার ন্যায় দাগ উৎপন্ন হয়। কয়েক দিনের মধ্যে আক্রান্ত স্থান মােটা হয়ে মাঝখানের টিস্যু সাদাটে হয় এবং ফোস্কার মত উচু হয়ে বের হয়ে আসে। ক্রমে দাগের রং বাদামী ও খসখসে হয়ে যায়। তবে তার কেন্দ্রস্থল একটু নীচু থাকে। দাগের চারিদিকে হলুদ আদা দ্বারা ঘেরা থাকে।
দাগ পাতার উভয় পৃষ্ঠায় দেখা যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাতার উল্টা পৃষ্ঠে বেশী হয় এবং উপরিভাগ খসখসে মনে হয়।
দাগের মধ্যস্থিত টিস্যু খসে পড়ে এবং এর জন্য পাতায় ছােট ছােট ছিদ্রের সৃষ্টি হয়।
ফলের দাগের মুখগহ্বর বেশ পরিস্কার। দাগের চারিপাশে হলুদ আভা থাকে না।
রােগটি কেবল ফলের খােসায় সীমাবদ্ধ থাকে এবং ভিতরের রসালাে অংশের বিশেষ কোন ক্ষতি করে না। ফলের ফলন তেমন কমে না, তবে বাজার মূল্য কমে যায়।

রােগের প্রতিকারঃ
• সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত লেবুর কলম/ চারা রোপণ করতে হবে।
• গাছের মরা ডালপালা, ফলের বােটা, রােগ বা পােকা আক্রান্ত ডাল পালা ও অতি ঘন ডাল পালা ছাটাই করে পরিস্কার করে দিতে হবে।
• গাছের নিচে ঝরে পড়া পাতা ও ফল সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে।
• প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে চিলিটেড জিংক স্প্রে করলে রােগের তীব্রতা কমে যায়।
• ট্রাই ব্যাসিক কপার সালফেট গ্রুপের ঔষধ (যেমন-কিউপ্রােক্সট ৩৪৫ এসসি) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার গাছে স্প্রে করতে হবে।
• মিউপিরােসিন গ্রুপের ব্যাকটেরিয়ানাশক (যেমন-ব্যাকট্রোবান) ১ লিটার পানিতে ৪ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার গাছে স্প্রকরতে হবে।

বি:দ্র: ব্যাকট্রোবান ও কিউপ্রােক্সাট ৩৪৫ এসসি ঔষধ দুইটি পর্যায়ক্রমে একটা ব্যবহার করার পর আরেকটি ব্যবহার করতে হবে।
(৩) দাদ বা স্ক্যাব (Scab) রােগঃ
এলসিনােই ফসেটি (Elsinoe fawcetti) নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রােগ হয়ে থাকে।
লেবুগাছের মৃত অংশে এস্কোস্পাের থাকে। উপযুক্ত আবহাওয়ায় (তাপমাত্রা ১৬-২৩ ডিগ্রি সেঃ ও ৬৬-১০০% আর্দ্রতা) এস্কোম্পাের অংকুরােদগমের মাধ্যমে কনিডিয়া উৎপন্ন করে। বৃষ্টির ঝাপটায় কনিডিয়া গাছের পাতা, ডাল ও ফলে ছড়িয়ে পড়ে এবং আর্দ্র স্থানে আক্রমণ করে। আক্রমণের জন্য উপযােগী তাপমাত্রা ১৬-২৩ ডিগ্রি সেঃ। অতিরিক্ত শিশির, কুয়াশা এবং আর্দ্রতা রােগ বিস্তারের জন্য খুবই অনুকূল।

‌রােগের লক্ষণঃ
পাতায়, কচি ডালে ও ফলে এ রােগ হয়।
কচি পাতার উপর ছােট ছােট ফিকে কমলা রংগের দাগ পড়ে। রােগ বৃদ্ধির সাথে সাথে দাগ
আঁচিলের ন্যায় উঁচু হয়ে উঠে।
আঁচিলের নীচে পাতার উল্টো দিকে কিছুটা ডেবে যায়। আঁচিলের উপর ফিকে হলদে কমলা রঙের মামড়ি পড়তে দেখা যায় এবং ক্রমে তার রং ধূসর হয়ে যায়।
অতিশয় রােগাক্রান্ত পাতা অত্যধিক মাত্রায় কুঁচকে যায় ও বিকৃত হয়ে যায়।
রােগের ব্যাপক প্রসার ঘটলে ফলে কর্কের ন্যায় খসখসে হয়ে বিশ্রী দেখায়। রােগের শেষের দিকে আঁচিল ফেটে যেতে পারে।
মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ফল শক্ত হয় ও পরিপক্ক হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে।

‌রােগের প্রতিকারঃ
• সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত লেবুর কলম/ চারা রোপণ করতে হবে।
• গাছ থেকে পাতা, ডালপালা ও ফল সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে।
• গাছে রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে কপার অক্সিক্লোরাইড গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-কুপ্রাভিট ৫০ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে অথবা কার্বেন্ডাজিম + মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-কমপেনিয়ন ৭৫ ডব্লিউপি) ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩-৪ বার গাছে স্প্রে করতে হবে।
(৪) রস ক্ষরণ বা আঠা ঝরা (Gummosis) রোগঃ
ফাইটোফথােরা পালমিভােরা (Phytophthora palmivora) PC PORTTI সাইট্রোফথােরা (Phytophthoracitrophthora) ও ফাইটোফথােরা প্যারাসাইটিকা (Phytophthora parsitica)নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রােগ হয়ে থাকে।
ছত্রাক মাটিতে বেঁচে থাকে এবং গাছের গােড়ায় আক্রমণ করে। ছত্রাক আক্রান্ত অংশে জুওম্পাের উৎপন্ন করে। এ সমস্ত জুওম্পাের সেচের পানি দ্বারা এক গাছ থেকে অন্য গাছে বিস্তার লাভ করে। যদি গাছের কান্ড বেশী দিন পানির সংস্পর্শে থাকে তবে এ রােগ হতে দেখা যায়।

রােগের লক্ষণঃ
প্রথমে কান্ডের গােড়ার দিকে বড় বড় পানি ভেজা দাগ পড়ে। দাগ কান্ডের উপরের ও নীচের দিকে বিস্তৃত হয়। ক্রমে দাগগুলি গাঢ় বাদামী রংগের হয়ে কান্ডের বাকলে লম্বালম্বি ফাটল সৃষ্টি করে। আক্রান্ত ফাটল থেকে আঠা ঝরতে থাকে।
রােগ আরও বিস্তৃত হলে উপরের ডালপালায় আঠা জমতে দেখা যায়। আক্রান্ত গাছের ফল আকারে ছােট হয়। আক্রান্ত গাছের পাতা ধীরে ধীরে হলুদ হয়ে যায় ও গাছ মারা যায়।

রােগের প্রতিকারঃ
• সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত লেবুর কলম/ চারা রোপণ করতে হবে।
• মাটি উঁচু বেড করে গাছ লাগাতে হবে যেন পানি না দাঁড়ায়।
• গুটি কলম/ জোর কলম পদ্ধতিতে চারা তৈরী করে লাগাতে হবে।
• গাছের মুল ও গোড়ায় যেন কোন ক্ষত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
• গাছের গোড়া থেকে ১ মিটার দূরত্বে একটি গােলাকার গর্ত তৈরী করে তাতে এক সপ্তাহ পর পর কার্বেন্ডাজিম (যেমন-অটোস্টিন) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে প্রয়ােগ করতে হবে।
• আক্রান্ত অংশ ভালভাবে চেঁছে ফেলে সেই স্থানে বর্দোপেষ্ট (প্রতি লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম ভুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন) লাগাতে হবে।
• গাছে রােগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে মেটালেক্সিল + মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-রিডােমিল গােন্ড) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর গাছে স্প্রে করতে হবে।
(৫) সাইট্রাস গ্রিনিং (Citrus greening) রােগঃ
মাইকোপ্লাজমা সাইট্রি (Mycoplasma citri) নামক মাইকোপ্লাজমার আক্রমণে এ রােগ হয়ে থাকে। Psyllid bug দ্বারা এ রােগ বিস্তার লাভ করে।

রােগের লক্ষণঃ
সব ধরণের লেবু জাতীয় ফসলেই হয়ে থাকে।
পাতা হলুদ হয়ে যায়।
শিরা ও উপশিরাগুলাে ক্রমশঃ গাঢ় সবুজ হতে থাকে, যার জন্য রােগের নাম সাইট্রাস গ্রিনিং হয়েছে। শিরা দূর্বল ও পাতা কুঁকড়িয়ে ডাইব্যাক-এর সৃষ্টি করে। পাতা ও গাছ খর্বকৃতির হয়। ফলেও রােগ দেখা যায়। আক্রান্ত গাছের ফল ছােট হয়। ফলে রসের পরিমাণ কমে যায়।

‌রােগের প্রতিকারঃ
• সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত লেবুর কলম/ চারা রোপণ করতে হবে।
• বাগান পরিস্কার পরিচছন্ন রাখতে হবে।
• আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়ে ফেলতে হবে।
• Psyllid bug দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক (যেমন- অ্যাডমায়ার বা ইমিটাফ) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত লেবুর কলম/ চারা রোপণ করুন।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৩নভেম্বর২০২০