আবহমানকাল ধরে মানুষের বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টির চাহিদা পূরণ এবং নারীর ক্ষমতায়নে প্রাণিসম্পদ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
হাঁস, মুরগি, কবুতর, গরু, ছাগল, ভেড়া পালন বর্তমানে আরও রূপান্তরিত ও পরিণত হয়ে আধুনিক খামারশিল্প হিসেবে বিস্তৃতি পেয়েছে।
গত ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশের জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ছিল প্রায় ১.৫৩ শতাংশ। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে অন্যান্য খাতের মতো এ শিল্পটিও কিছুটা হোঁচট খেয়েছে।
বিশেষত প্রাণিজাত পণ্য যেমন- মাংস, দুধ, ডিম, প্রসেস্ড ফুড, দুগ্ধজাত পণ্য ইত্যাদির বাজারজাতকরণ ব্যাহত হয়েছে। ফলে অনেক খামারি ও বাণিজ্যিক উদ্যোক্তা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ অনুসারে দেশে বেকারত্বের হার ৪.১৯ শতাংশ। করোনাকালীন দেশে বহু মানুষ বেকার হয়েছেন, যাদের প্রতিদিনের আয় মাত্র ১৬০ টাকা বা ১.৯ ডলার। গত মার্চ থেকে মে পর্যন্ত গড় পারিবারিক আয় কমেছে ৭৪ শতাংশ।
এ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, টারকি পালন বেকার জনসম্পদকে আলোর পথ দেখাতে পারে। বর্তমান বাজারে উন্নত জাতের মাংস বা দুধ উৎপাদনকারী বাছুরের দাম সর্বোচ্চ ৩৫-৩৮ হাজার টাকা। যদি মাংস উৎপাদনকারী ৬ মাস বয়সী বাছুর ৩ মাস লালন-পালন করা হয় তাহলে পাঁচটি বাছুরের জন্য ৩ মাসে খাদ্য ও অন্যান্য খরচ বাবদ সর্বোচ্চ খরচ হতে পারে ২০-২৫ হাজার টাকা। ৩ মাস লালন-পালনের পর এ গরুগুলোর প্রতিটির দাম হবে ৮০-৯০ হাজার টাকা।
অর্থাৎ পাঁচটি বাছুরের মোট ক্রয় ১ লাখ ৭৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। লালন-পালন খরচ ২০-২৫ হাজার টাকাসহ পাঁচটি গরুর মোট খরচ দাঁড়ায় ২ লাখ থেকে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। পক্ষান্তরে পাঁচটি গরুর বর্তমান বাজারে বিক্রয় মূল্য ৪ লাখ থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ৩ মাসে নিট লাভ হচ্ছে ২ লাখ থেকে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে প্রতি মাসে আয় দাঁড়ায় ৭২ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা। দেশের বেকার সম্প্রদায় এ বিষয়টির প্রতি নজর দিলে তাদের বেকারত্বের হতাশা যেমন কমবে, তেমনি সমৃদ্ধ হবে দেশের প্রাণিপুষ্টি ও অর্থনীতি।
দুধ উৎপাদনে মহিষ বা গরুর খামার সম্ভাবনাময় একটি খাত। পাশাপাশি মাংস ও ডিমের উৎপাদন বাড়িয়ে রফতানির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যুবনীতি-২০১৯ অনুযায়ী দেশে যুব সম্প্রদায় ধরা হয় ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের তরুণ-তরুণীকে।
বর্তমানে দেশে ৫.৫ কোটি যুবক-যুবতী রয়েছে। তাদের একটি অংশকে উৎসাহ, প্রণোদনা ও সামান্য কিছু মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে যদি বিপুল সম্ভাবনাময় প্রাণিসম্পদ খাতে সম্পৃক্ত করা যায় তাহলে মাংস, ডিম, দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
বহির্বিশ্বে প্রসেস্ড ফুড যেমন- লিকুইড মিল্ক, দই, পনির, আইসক্রিম, মাখন, ছানা, চিকেন, বিফ, মাটন ইত্যাদির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভিশন-২০২১ ও ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে বিপুল সম্ভাবনাময় প্রাণিসম্পদ খাতকে অবশ্যই রপ্তানিমুখী খাতে রূপান্তরিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগ।
বর্তমানে দেশে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হয় ৫৫০ টাকায় এবং খাসির মাংস ৭৫০ টাকায়। উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে একদিকে যেমন মাংসের দাম কমিয়ে সাধারণ মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব, তেমনি রপ্তানি করাও সম্ভব হবে। একটি সুস্থ ও মেধাবী জাতি গঠনে প্রাণিজ পুষ্টির কোনো বিকল্প নেই। উন্নত ও আধুনিক দেশ গড়তে যে দক্ষ ও মেধাবী জনশক্তি দরকার, তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ করতে হবে।
ডা. এসএম জিয়াউল হক রাহাত : প্রকল্প পরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৬জানুয়ারি২০২১