আম উৎপাদনে অর্থাৎ গুণগত মানসম্পন্ন, নিরাপদ ও বিষমুক্ত ফল উৎপাদনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে উদ্ভাবনকৃত ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি বাংলাদেশে একটি নতুন ও সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি হিসেবে মাঠপর্যায়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।
এই প্রযুক্তিটি শুধু সাশ্রয়ীই নয় পরিবেশ বান্ধবও বটে। প্রকৃতপক্ষে মাঠ পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদন করতে গিয়ে চাষিদের বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রোগ, পোকামাকড় ও প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট সমস্যা। ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজেই সকল সমস্যাগুলোকে সমাধান করে ভালোমানের আম উৎপাদন করা সম্ভব।
ফ্রুট ব্যাগিংঃ
ফ্রুট ব্যাগিং বলতে ফল গাছে থাকা অবস্থায় বিশেষ ধরনের কাগজের তৈরি ব্যাগ দ্বারা ফলকে আবৃত করাকে বুঝায় এবং এর পর থেকে ফল সংগ্রহ করা পর্যন্ত গাছেই লাগানো থাকবে ব্যাগটি।
ব্যাগের আকার ও রংঃ
এই ব্যাগ বিভিন্ন ফলের জন্য বিভিন্ন রং এবং আকারের হয়ে থাকে। তবে আমের জন্য দুই ধরণের ব্যাগ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রঙিন আমের জন্য সাদা রঙের ব্যাগ এবং অন্য সকল আমের জন্য দুই আস্তরের বাদামি ব্যাগ।
বর্তমানে আম চাষিরা দুই স্তরের বাদামি ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করছেন এবং লাভবান হয়েছেন। তবে আগাম জাতসমূহে এক স্তরের সাদা রঙের ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত ফলসমূহ নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও রপ্তানি উপযোগী।
ব্যাগিং করার উপযুক্ত সময়:
আমের প্রাকৃতিকভাবে ঝরা বন্ধ হলেই ব্যাগিং শুরু করতে হবে। বারি আম-১, গোপালভোগ, খিরসাপাত, ল্যাংড়া, বারি আম-২, বারি আম-৬ এবং বারি আম-৭ জাতের ক্ষেত্রে ব্যাগিং করা হয় ৪০-৫৫ দিন বয়সে। এই সময়ে আম জাতভেদে মার্বেল আকারের বা এর চেয়ে বড় হয়ে থাকে। তবে বারি আম-৩, ৪, ৮, ফজলি, হাড়িভাঙ্গা, আশ্বিনা এবং গৌড়মতি আমের ক্ষেত্রে গুটির বয়স ৬৫ দিন হলেও ব্যাগিং করা যাবে। ব্যাগিং করার পূর্বে অবশ্যই কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক নির্দেশিত মাত্রায় ভালোভাবে মিশিয়ে শুধুমাত্র ফলে স্প্রে করতে হবে। ফল ভেজা অবস্থায় ব্যাগিং করা ঠিক নয়।
আমের ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিনটি স্প্রে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন প্রথমবার আম গাছে মুকুল আসার আনুমানিক ১৫-২০ দিন পূর্বে, দ্বিতীয়বার মুকুল আসার পর অর্থাৎ আমের মুকুল যখন ১০-১৫ সেমি লম্বা হবে কিন্তু ফুল ফুটবেনা এবং আম যখন মটর দানারমতো হবে তখন তৃতীয়বার। সুতরাং এর পরপরই আমে স্প্রে করে ব্যাগিং করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ব্যাগিং করার পূর্বেই মরা মুকুল বা পুষ্মমুঞ্জুরীর অংশবিশেষ, পত্র, উপপত্র অথবা এমন কিছু যা ফলের ক্ষতি করতে পারে সেগুলো ছিড়ে ফেলতে হবে।
যেসব এলাকায় আম বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয় না বা শুধুমাত্র পারিবারিক চাহিদা পূরণে আম গাছ লাগানো হয়েছে এবং এই সমস্ত গাছে সময়মত স্প্রে করা হয় না বা সেই ধরনের প্রচলন এখনও এলাকায় চালু হয়নি ফলে প্রতি বছরই তাদের গাছে আম ধরে কিন্তু পোকা ও রোগের কারণে অধিকাংশ আম নষ্ট হয়ে যায়। এসব আমগাছে এই প্রযুক্তিটি সবচেয়ে কার্যকর। এছাড়াও যে সকল এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হয় এবং আম দেরিতে পাকে সেসব আমের জাতগুলো বিবর্ণ বা কারো রং ধারণ করতে দেখা যায় এবং মাছি পোকার আক্রমণ দেখা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় নাবীজাত আশ্বিনাতে ১০০ ভাগ আমের মাছি পোকার আক্রমণে নষ্ট হয়ে যায়।
পোকামাকড় দমনে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিঃ
যেসব বাগানে ঘন করে আম লাগানো হয়েছে এবং বর্তমানে গাছের ভিতরে সূর্যের আলো পৌছায় না সেসব গাছে আমের মাছি পোকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মাছি পোকা দমনের জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বা প্রচলিত আছে কোনটিতেই এই মাছি পোকাকে শতভাগ দমন করা সম্ভব নয় বরং আক্রমণের হার কিছুটা কমিয়ে রাখা যায়।
ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির মাধ্যমে শতভাগ রোগ ও পোকামাকড় দমন করা যায়। আম রপ্তানির জন্য ভালো মানসম্পন্ন, রঙিন ও রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ মুক্ত আম প্রয়োজন। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে এই তিন বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটানো সম্ভব নয়। বিভিন্ন আম রপ্তানিকারক দেশে বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি দ্বারা সবচেয়ে কম পরিমাণে বালাইনাশক ব্যবহার করে ১০০% রোগ ও পোকামাকড় মুক্ত আম উৎপাদন করা সম্ভব। এছাড়াও ব্যাগিং করা আম সংগ্রহের পর ১০-১৪ দিন পর্যন্ত ঘরে রেখে খাওয়া যায়। সেই সাথে রঙিন, ভালো মানসম্পন্ন নিরাপদ আমও পাওয়া যায়।
ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়ঃ ব্যাগিং প্রযুক্তি হতে ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য নিম্নে উল্লিখিত কয়েকটি বিষয়ের প্রতি অবশ্যই নজর দিতে হবে-
# নির্দিষ্ট সময়ে ফ্রুট ব্যাগিং করতে হবে।
# ব্যাগিং করার পূর্বে আমগুলিকে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক একত্রে মিশিয়ে শুধুমাত্র ফলে স্প্রে করতে হবে।
# ব্যাগিং করার কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা পূর্বে স্প্রে করতে হবে । তবে স্প্রে করার পরের দিনও ব্যাগিং করা যাবে যদি বৃষ্টিপাত না হয়।
ফল ভেজা অবস্থায় ব্যাগিং করা উচিৎ নয়।
# সঠিক নিয়মকানুন ও পদ্ধতি অনুসরণ করে যেসব চাষি ফ্রুট ব্যাগিং করছেন তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছেন। নিরাপদ, বিষমুক্ত, স্বাস্থ্যসম্মত ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি একটি সহজ, সাশ্রয়ী ও লাভজনক প্রযুক্তি হিসেবে মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৬জানুয়ারি২০২১