চীন আগে থেকেই মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনায় অন্যান্য দেশ থেকে এগিয়ে। বিগত ২ দশকে চীন মাছ চাষের ক্ষেত্রে এক ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। এই সাফল্যের স্বাদ এখন শুধু চীন একা ভোগ করছে না, সবাই ভোগ করছে। বিশ্বের উৎপাদিত মোট মাছের শতকরা ৭০ ভাগই উৎপাদন করে চীন এবং মাছ রফতানি বাবদ চীনের বাৎসরিক মোট আয় ৯.৭৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার।
আমাদের দেশে হ্যাচারিতে মাছের পোনা উৎপাদনের কৌশল ষাটের দশকে প্রথম চীন থেকে আসে। হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি ছাড়াও পর্যায়ক্রমে চীন থেকে দ্রুত বর্ধনশীল মাছের প্রজাতি যেমন, সিলাভার কার্প, গ্রাস কার্প, মিরর কার্প ইত্যাদি মাছ আমদানি করা হয়। এসব মাছ আমাদের দেশের জলবায়ুতেও দ্রুত বর্ধনশীল।
বর্তমানে চীন পুকুরে মাছের মিশ্রচাষ, অভ্যন-রীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে পেন ও খাঁচায় মাছ চাষ এবং লেক ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে। পুকুরে মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে আগের মত বছরব্যাপী এখন আর চাষ করছে না। পুকুরে এখন উচ্চ মজুত ঘনত্বে অপেক্ষাকৃত বড় সাইজের পোনা ছেড়ে বছরে ৩/৪ বার বাজারজাত যোগ্য মাছ ধরে ফেলে পুনরায় পোনা মজুদ করছে। এতে সারা বছরের জন্য ১টি মাত্র ফসলের জন্য অপেক্ষা করছে না। বার বার মাছ ধরার কারণে চাষিদের হাতে একটা রোলিং মূলধন থাকছে এবং তা দিয়ে চাষিরা মাছ চাষের ব্যয়ভার এবং জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে।
চীনে খাঁচায় মাছ চাষ শুরু হয় প্রায় ৮০০ বছর আগে। তখন মাছের পোনা লালন পালন কাজে খাঁচা মূলত ব্যবহার করা হত। ‘৯০ এর দশক থেকে চীনে ব্যাপকভাবে খাঁচায় রেইনবো ট্রাউট, তেলাপিয়া, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, চ্যানেল ক্যাট ফিস ইত্যাদি মাছ চাষ শুরু করা হয়। ছোট ছোট খাঁচা ১ থেকে ১০ বর্গ মিটার আকারের এবং বড় বড় খাঁচা ১৬-১৮ বর্গ মিটারের। খাঁচার উচ্চতা ১-৪ মিটার পর্যন- দেখা যায়। এক্ষেত্রে মাছ মজুদের সময় বড় বড় পোনা মজুদ করা হয়। চীনের বিভিন্ন লেক এবং রিজার্ভারে খাঁচায় মাছ চাষ করে চাষিরা এখন সহজেই লাভবান হচ্ছেন। উল্লেখ্য, আমাদের দেশেও বর্তমানে খাঁচায় মাছ চাষে অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছেন এবং খাঁচায় মাছ চাষের সম্ভাবনাও ভাল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা চীনের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি।
পরিবেশবান্ধব চিংড়ি চাষাবাদের ক্ষেত্রেও চীনের সাফল্য আশাব্যঞ্জক। আমাদের দেশের মত গলদা ও বাগদা চিংড়ির পাশাপাশি ভ্যানামি চিংড়ি চাষাবাদ করা হচ্ছে। উচ্চ মজুদ ঘনত্বে চীনে হেক্টরপ্রতি ৪ হাজার কেজি পর্যন- চিংড়ি উৎপাদন করা হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন মাত্র ৩০০-৪০০ কেজি। চিংড়ির রোগবালাই দমনের ক্ষেত্রে প্রচলিত রাসায়নিক দ্রব্যাদির পাশাপাশি ভেষজ ঔষধ চীনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে তারা সুফলও পাচ্ছে। আমাদের দেশও ভেষজ ঔষধি গাছে সমৃদ্ধ। মাছের রোগবালাই দমনে এসব ঔষধি গাছ ব্যবহার করা যায় কি-না তা নিয়ে কার্যকর গবেষণা প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে আমরা বন্ধুপ্রতীম দেশ চীনের সহযোগিতা নিতে পারি।
মাছ চাষ ছাড়াও চীন ঝিনুকে মুক্তা উৎপাদন করে প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। জাপান ও চীনের মুক্তার কদর বিশ্বব্যাপী। অথচ আমাদেরও মুক্তা উৎপাদনের কৌশল জানা আছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চলতি দশকে গোড়ার দিকে চীন থেকে ১জন বিশেষজ্ঞ এনে মুক্তা উৎপাদনের কৌশল আয়ত্তে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তাই ইনস্টিটিউটের ২/৩ জন বিজ্ঞানীর মুক্তা উৎপাদনের কৌশল এখনও জানা আছে।
কিন্তু আমরা উৎপাদনে খুব একটা এগুতে পারিনি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বড় ধরনের ঝিনুকের অভাব। আমাদের দেশে ঝিনুকে উৎপাদিত মুক্তাও আকারে ছোট হয়। ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে খুব একটা লাভবান হওয়া যায় না। চীনে বড় আকারের ঝিনুক রয়েছে। সরকারিভাবে এসব ঝিনুক আনা গেলে বাংলাদেশে মুক্তা উৎপাদনের এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
লেখক : ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট
এগ্রোবাংলা
ফার্মসএন্ডফার্মার/০১ফেব্রুয়ারি২০২১