সফেদা চাষ করবেন যেভাবে

692

সফেদা বা চিকু অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল। এতে রয়েছে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং ভিটামিন এ ও ভিটামিন সি। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস হলো সফেদার চারা কলম রোপণের উপযুক্ত সময়। চারা লাগানোর পর গাছের গোড়ায় সেচ দিতে হবে। বর্ষার সময় যাতে পানি না জমে সেজন্য চারার গোড়ার মাটি একটু উঁচু করে দিতে হবে। লিখেছেন- কৃষিবিদ নিতাইচন্দ্র রায়

সফেদা একটি স্বল্প পরিচিত মিষ্টি, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। এটি দেখতেও বেশ আকর্ষণীয়। আকার ছোট ও গোলাকার। রঙ তামাটে ও খসখসে। শীতকালে যখন অন্যান্য দেশি ফল পাওয়া যায় না, তখন সফেদা পাওয়া যায়। কম-বেশি সারা দেশে উৎপন্ন হলেও খুলনা, বৃহত্তর বরিশাল, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম জেলায় বেশি সফেদার চাষ হয়।

পুষ্টিগুণ : সফেদা একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল। এতে রয়েছে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং ভিটামিন এ ও ভিটামিন সি। সফেদার প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্য উপযোগী অংশে রয়েছে ৭৩.৩ ভাগ জলীয় পদার্থ, ২১.৪ ভাগ শ্বেতসার, ০.৭ গ্রাম আমিষ, ১.১ গ্রাম স্নেহ, ২৮ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২৭ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ২ মিলিগ্রাম লৌহ, ৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ০.০২ মিলিগ্রাম থায়ামিন, ০.০৩ মিলিগ্রাম রিবোফ্লাবিন, ০.০২ মিলিগ্রাম নায়াসিন এবং ৯৭ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন। প্রতি কেজি ফলে ৭০০ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়।

জাত : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জার্মপ্লাজম সেন্টার ১৯৯১ সাল থেকে সফেদা নিয়ে গবেষণা করে আসছে। এ সেন্টার থেকে সফেদার তিনটি জাত অবমুক্ত করা হয়। জাতগুলো হলো-বাউ সফেদা-১, বাউ সফেদা-২, ও বাউ সফেদা-৩। এছাড়া বারি সফেদা-১ ও বারি সফেদা-৩ নামে দেশে আরও দুটি উন্নত জাতের সফেদার আবাদ হচ্ছে।

বাউ সফেদা-১ : জাতটি সারা বছরই কম-বেশি ফল দেয়। ফল ডিম্বাকার, কম বীজযুক্ত ও মিষ্টি। শাঁস চমৎকার গুণসম্পন্ন। ফল পাকতে ৬ থেকে ৮ মাস সময় লাগে। প্রচুর ফল ধরে। ফলের ওজন ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম। গাছ ঝোপালো ও বামন আকৃতির।

বাউ সফেদা-২ : এটি একটি নিয়মিত ফলধারণকারী জাত। এ জাতটি অনেকটা বাউ সফেদা-১-এর মতো। তবে এ জাতের শাখা-প্রশাখা ছাতার মতো নিচের দিকে ঝোলানো থাকে। ফল ছোট থেকে মাঝারি আকারের। থোকায় থোকায় ফল ধরে। ফল ডিম্বাকার। ফলের চামড়া অত্যন্ত পাতলা ও সুগন্ধযুক্ত। ফলের ওজন ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম। ফলের শাঁস লাল-বাদামি, কোমল এবং সুস্বাদু।

বাউ সফেদা-৩ : এ জাতের শাখাগুলো চারদিকে পাতার বলয় দ্বারা আবৃত থাকে। এ জাতের ফল মধ্যম থেকে বড়। ফল ডিম্বাকার ও নিচের দিকটা সূচালো। ফল অত্যন্ত মিষ্টি, শাঁস, সুগন্ধযুক্ত ও কোমল।

বারি সফেদা-১ : উচ্চফলনশীল এ জাতটি বাংলাদেশে চাষের জন্য ১৯৯৬ সালে অনুমোদন লাভ করে। জাতটিতে নিয়মিত ফল ধরে। ফল দেখতে অনেকটা চ্যাপ্টা ও আকারে বেশ বড়। প্রতিটি ফলের ওজন ৮০ থেকে ৯০ গ্রম। ফলের বর্ণ তামাটে ও আকার ডিম্বাকৃতি।
বারি সফেদা-৩ : জাতটি ২০০৯ সালে অবমুক্ত করা হয়। বছরে দু’বার ফলধারণকারী এটি একটি উচ্চফলনশীল জাত। ফল গোলাকার, মাঝারি। ওজন প্রায় ১০০ থেকে ১১৫ গ্রাম। ফল খেতে খুব মিষ্টি। খাদ্যোপযোগী অংশ শতকরা ৯১ ভাগ।

বংশবিস্তার : জোড় কলমের মাধ্যমেই এ ফলের বংশবিস্তার করা হয়। জোড় কলমের জন্য খিরনি-মহুয়ার চারাকে আদি জোড় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কলমের মাধ্যমে উৎপাদিত রোগমুক্ত এক থেকে দেড় বছর বয়সী চারাকে রোপণের জন্য নির্বাচন করা উচিত।

মাটি : সুনিকাশিত উর্বর, বেলে দো-অাঁশ ও দো-অাঁশ মাটি সফেদা চাষের জন্য বেশি উপযোগী। তবে অন্যান্য মাটিতেও এ ফলের চাষ করা যায়।

জমি নির্বাচন ও তৈরি : বর্ষায় পানি জমে না এ ধরনে উঁচু জমি সফেদা চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত। জমি ২ থেকে ৩ বার ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করতে হবে।

রোপণ পদ্ধতি : বর্গাকার বা ষঢ়ভুজ উভয় পদ্ধতিই অনুসরণ করা যেতে পারে। তবে পাহাড়ি এলাকায় কণ্টুর পদ্ধতিতে সফেদা গাছ রোপণ করতে হবে।

রোপণ সময় : মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস হলো সফেদার চারা কলম রোপণের উপযুক্ত সময়।
রোপণ দূরত্ব : জাত ও মাটি ভেদে ৫x ৫ মিটার থেকে ৬x ৬ মিটার দূরত্বে সফেদার চারা কলম রোপণ করা যেতে পারে।
গর্ত তৈরি : ৫০x ৫০x ৫০ সেন্টিমিটার আকারের গর্ত তৈরি করে প্রতি গর্তে ২০ থেকে ৩০ কেজি পচা গোবর সার প্রয়োগ করে গর্তের মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। তারপর গর্তের মাঝখানে কলমের চারাটি মাটির বলসহ সোজা করে লাগাতে হবে। প্রয়োজনে খুঁটি দিয়ে চারাটিকে বেঁধে দিতে হবে। চারা লাগানোর পর গাছের গোড়ায় সেচ দিতে হবে। বর্ষার সময় যাতে পানি না জমে সেজন্য চারার গোড়ার মাটি একটু উঁচু করে দিতে হবে।

সার প্রয়োগ : গাছ লাগানোর এক বছর পর প্রতি বর্ষার আগে গাছপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ কেজি পচা গোবর সার, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম টিএসপি, ১৫০ গ্রাম এমওপি, ৪০ গ্রাম বোরাঙ্, ৫০ গ্রাম জিঙ্ক সালফেট সার প্রয়োগ করতে হবে। এরপর গাছের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। উলি্লখিত পরিমাণ সার সমান তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি ফল আহরণের পর বর্ষার শুরুতে, দ্বিতীয় কিস্তি বর্ষা শেষে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে এবং শেষ কিস্তি গাছে ৮০ ভাগ ফুল আসার পর প্রয়োগ করতে হবে।
আগাছা দমন : সফেদা গাছের চারপাশ সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে।

পানি সেচ ও নিকাশ : চারা গাছের বৃদ্ধির জন্য শুকনো মৌসুমে ১০ থেকে ৫ দিন পর পর সেচ দিতে হবে। ফলন্ত গাছের বেলায় ফুল ফোটা থেকে ফল পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত গাছের গোড়ার মাটিতে রস রাখতে হবে এবং সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হবে। বর্ষার সময় যাতে গাছের গোড়ায় পানি জমে না থাকে তার জন্য পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।

পরিচর্যা : জোড় কলমের মাধ্যমে তৈরি করা কলম চারায় জোড়া লাগানোর নিচ অংশে অনেক ডাল গজায়, যা সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে দিতে হবে। গাছটিকে সুন্দর কাঠামো দেয়ার জন্য রোপণের ২ বছর পর গোড়ার দিকে ৩ ফুট পরিমাণ কান্ড রেখে ওপরের সব ডাল কেটে ফেলতে হবে।
রোগবালাই : সফেদাতে তেমন কোনো মারাত্মক রোগবালাই দেখা যায় না। তবে কখনও কখনও পাতার দাগ পড়া ও শুটিমোল্ড রোগ দেখা দিতে পারে।

পাতায় দাগপড়া রোগ : এ রোগের আক্রমণে পাতায় অসংখ্য হালকা ছোট ছোট গোলাপি বা লালচে বাদামি রঙের দাগ পড়ে। দাগগুলোর কেন্দ্রস্থল সাদাটে। এ রোগ সাধারণত জুলাই-সেপ্টেম্বরর মাসে দেখা যায়।

প্রতিকার : প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর দু’বার সব গাছে স্প্রে করতে হবে।
শুটিমোল্ড, সাদা মাছি পোকা ও মিলিবাগ সফেদা গাছের পাতার রস চুষে খায় এবং পাতার ওপর মধুর মতো আঠালো বিষ্ঠা ত্যাগ করে। এ বিষ্ঠার ওপর শুটিমোল্ড নামক কালো ছত্রাক জন্মে। ফলে আক্রান্ত পাতায় খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায় এবং পাতা ঝরে পড়ে।
প্রতিকার : সাদা মাছি ও মিলিবাগ দমন করতে হবে। এজন্য প্রতি লিটার পানিতে ৫ থেকে ১০ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ২ গ্রাম থিয়োভিট ৮০ ডবিস্নউজি মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
অনিষ্টকারী পোকামাকড় : সফেদার অনিষ্টকারী পোকামাকড়ের মধ্যে কান্ড ছিদ্রকারী পোকা অন্যতম।

কান্ড ছিদ্রকারী পোকা : পোকার কীড়া গাছের বাকল ছিদ্র করে ভেতরে ঢোকে এবং বাকলের নিচের নরম অংশ খেয়ে গাছের সতেজতা নষ্ট করে। আক্রান্ত গাছের কান্ডে গর্ত থাকে এবং গর্তের মুখে কীড়ার নষ্ট করা বাকলের গুড়া বা বিষ্ঠা ঝুলে থাকতে দেখা যায়।
প্রতিকার : লোহার শিক দিয়ে গর্তের ভেতর থেকে কীড়া বের করে মেরে ফেলতে হবে। গর্ত যদি গভীর হয় তবে সিরিঞ্জ দিয়ে গর্তের ভেতর কেরোসিন বা কীটনাশক ঢুকিয়ে গর্তের মুখ তুলা দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে পোকা মারতে হবে।

ফল সংগ্রহ : ফল শক্ত অবস্থাতেই সংগ্রহ করতে হবে। ফল সংগ্রহের উপযোগী সময় হলে খোসায় কিছুটা কমলা রঙের আভা আসবে। এ সময় ফল কাটলে শাঁসের রঙেও হলুদ আভা দেখা যাবে। ফলের বোঁটা থেকে পাতলা আঠা বের হবে।

ফলন : কলমের গাছ দ্বিতীয় বছর থেকেই ফল দেয়া শুরু করে। পাঁচ বছরের কলমের একটি সফেদা গাছে ৩৫০ থেকে ৫৫০টি পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১০ এপ্রিল ২০২১