বর্তমানে বিভিন্ন প্রকার ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফলের ফেটে যাওয়া একটি বড় সমস্যা। সাধারণত: ফল বড় হওয়ার পর অর্থাৎ ফল পুষ্ট হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ফাটা শুরু করে। ফল বড় হওয়ার পর কোন কারণে নষ্ট হলে কৃষকের জন্য ক্ষতিকর হয়ে পড়ে। প্রায় সব ফলকেই ফাটতে দেখা যায়। তবে আমাদের দেশের ফল গুলোর মধ্যে লিচু ও ডালিম বেশী ফাটে।
অন্যান্য ফলের মধ্যে কলা, আম, পেয়ারা, কাঁঠাল ইত্যাদি ফেটে যেতে পারে। ফল ফেটে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি খুব দ্রুত সম্পন্ন হয় এবং উক্ত ফাটা জায়গায় রোগ জীবানুর আক্রমণ ঘটতে পারে। ফলে গোটা ফল নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা দেখা দেয়। ফল ফেটে গেলে তার বাজার মূল্য কমে যায়। তাছাড়া কোন কোন সময় তা খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে যায় ফলে কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে।
ক্ষতির ধরণ বা প্রকৃতি:
লিচুর ফল ফাটা বিভিন্ন রকম হতে পারে। সামান্য ফাটা, কেবলমাত্র খোসা ফাটা, লম্বালিম্বভাবে গোটা ফল ফাটা ইত্যাদি। ফল ফেটে গেলে তার অপক্ক শাঁস অনাবৃত হয়ে পড়ে এবং সরাসরি বাতাসের সংস্পর্শে আসে ফলে শাঁস দ্রুত শুকায়ে যায়। পরবর্তীতে তা রোগ ও পোকার আক্রমণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। লিচুর ফাটা লম্বালম্বি বা আড়াআড়ি দু রকমই হতে পারে।
ফল ফাটার পদ্ধতিঃ
খরা বা অনাবৃষ্টির সময় ফলের জাইলেম ও ফ্লোয়েম কোষে অনাকাংখিত আবহাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু শক্তিশালী কোষের উৎপন্ন হয় যা বিভক্ত হওয়ার বা বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যদি শুস্ক আবহাওয়ার পর পানি/সেচ সরবরাহ বৃদ্ধি করা হয় তখন বর্ধনশীল কোষ (Merstematic tissuc) খুব দ্রুত বাড়া শুরু করে । কিন্তু , জাইলেম ও ফ্লোয়েমের শক্ত কোষগুলো সমভাবে বাড়তে পারে না। এমতাবস্থায়, কোষ বৃদ্ধির এই তারতম্যের কারণে ফলের আবরণের শক্তকোষগুলো ফেটে যায়।
ভারতের কানোয়ার ও তার সহযোগী বিজ্ঞানীবৃন্দ ব্যাখ্যা করেছেন যে, লিচুর ফল বৃদ্ধি দুটি পর্যায়ে ঘটে থাকে। প্রথম পর্যায়ে, ফল তার সম্ভাব্য দের্ঘ্য পর্যন্ত দ্রুত বাড়ে। বিশেষতঃ ফলের বীজ দ্রুত বাড়ার কারণে দ্বিতীয় পর্যায়ে ফলের শাঁস দ্রুত বাড়া শুরু করে যে সময় (মে মাসে) সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এবং আপেক্ষিক আদ্রতা কম থাকে।
এ সময় ফলের যে অংশে সরাসরি রোদ্র পায় সে দিকে ফলের খোসায় হালকা বাদামী দাগ পড়ে। দাগযুক্ত খোসার রং গাঢ় হয় এবং জায়গাটা শুকিয়ে যায়। একই সময় দ্রুত বর্ধনশীল শাঁসের চাপে দাগযুক্ত আক্রান্ত খোসার জায়গাটি ফেটে যায়। শাঁস বৃদ্ধির হার বেশী হলে ফাটল দ্রুত সম্পন্ন হয় এবং ফাটল সুস্পস্ট হয়ে উঠে।
ফল ফাটার কারণঃ
ফল ফাটার বিভিন্ন কারন রয়েছে। তবে, লিচু ফল ফেটে যাওয়ার নিম্নের এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে।
(ক) আবহাওয়া জনিতঃ আবহাওয়ার মুল উপাদান তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আদ্রতা এবং বৃষ্টিপাত। লিচুর ফল ফাটার সঙ্গে আবহাওয়ার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গোছ। কানোয়ার, সিংহ প্রভৃতি বিজ্ঞানীদের মতে গরম বাতাস/
আবহাওয়া লিচুর ফল ফাটার প্রধান কারণ। তারা বলেন ফল পাকার আগে গরম আবহাওয়া তৎসহ গরম বাতাস ফল ফাটাতে সহায়তা করে।
ফলের শাঁস দ্রুত বৃদ্ধির সময় তাপমাত্রা ৩৮০ সে. বা অধিক এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬০ % বা কম হলে ফল ফাটা তরান্বিত হয়। দিন ও রাতের তাপমাত্রার ব্যাপক তারতম্য, তৎসহ গরম আবহাওয়ার পর হঠাৎ পর্যাপ্ত সেচ প্রদান বা বৃষ্টিপাত ফল ফাটতে সহায়তা করে। ফল পাকার পূর্ব মুহূর্তে উচ্চ তাপমাত্রা, নিম্নমাত্রার আপেক্ষিক আর্দ্রতা তৎসহ দীর্ঘ বৃষ্টিপাত ফল ফাটার অন্যতম কারণ বলে বিজ্ঞানী মিশ্র মনে করেন।
(খ) হরমোনজনিতঃ সুস্থ্য ও ফাটা লিচুর রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সুস্থ্য লিচুর তুলনায় ফাটা লিচুর খোসা ও বীজে কম মাত্রায় এবং শাঁসে বেশী মাত্রায় অঙিন বিদ্যমান থাকে। জিবারেলিন এর মাত্রা খোসা, বীজ ও শাঁসে স্বাভাবিক ফলের তুলনায় বেশী থাকে। এছাড়া সাইটো কাইনিন ও এবসিসিক এসিড ফাটা ফলে বেশী লক্ষ্য করা গেছে।
(গ) জাতের বৈশিষ্ট্য জনিতঃ লিচুর সব জাতে একইরকম ফাটল দেখা যায় না। কোন কোন জাত বেশী সংবেদনশীল আবার কোন কোনটি ফাটা প্রতিরোধক। ভারতে বেশ কিছু জাতের উপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, জাতভেদে ফল ফাটার পরিমাণ ০.৩-৩৬.২% । এর মধ্যে সর্বোচ্চ ফাটল দেরাদুন জাতে এবং সর্বনিম্ন ফাটল সীডলেস নং-২ জাতে লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশের দিনাজপুর ও ঈশ্বরদী এলাকায় আবাদকৃত জাতগুলোর মধ্যে বোম্বাই ও স্থানীয জাতের ফল ফাটার পরিমান বেশী হয়ে থাকে। চায়না -৩ ও বেদানা জাতে ফল ফাটার পরিমাণ বেশ কম, নাই বললেই চলে। গবেষণায় দেখা গেছে, আগাম পাকে এমন জাতের ফল ফাটার পরিমাণ নাবী জাতের তুলনায় বেশী। ভারতেও একই রকম ফলাফল লক্ষ্য করা গেছে।
(ঘ) পুষ্টির অভাব জনিতঃ কিছু কিছু পুষ্টি উপাদান যেমন পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, দস্তা, বোরণ, তামা, মালিবডেনাম ও ম্যাঙ্গানিজ ফল বৃদ্ধির সময় শারীরতাত্বিক পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় এদের অভাবে ফল ফাটা ত্বরান্বিত হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে ফাটা লিচুতে স্বাভাবিক লিচুর তুলনায় বেশী পরিমাণে নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম থাকে। অপরদিকে ক্যালসিয়াম ও দস্তা কম পরিমাণে বিদ্যমান থাকে। স্বাভাবিক ও ফাটা ফলের অম্লতা (পিএইচ) এবং মিষ্টতার (টিএসএস) কোন তারতম্য ঘটে না । তবে, ফাটা ফলে পানির পরিমাণ বেশী থাকতে দেখা গেছে।
(ঙ) মাটির আর্দ্রতাজনিতঃ ত্রুটিপূর্ণ সেচ ব্যবস্থাপনার কারণে ফল ফাটা বেড়ে যেতে পারে। ফলের শাঁস বৃদ্ধির সময়ে মাটির আর্দ্রতা কমে যাওয়া এবং পরিমিত মাত্রায় সেচ প্রদান না করার কারণে মাটিতে রসের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় লিচুর ফল ফেটে যেতে পারে।
(চ) রোগ পোকার আক্রমণ ও আঘাত জনিতঃ কোন কোন সময় রোগ ও পোকার আক্রমণ বা শারীরিকভাবে ফল ফল আঘাত প্রাপ্ত হলে তা ফেটে যায় এবং পচনকারী জীবানুর আক্রমণ দেখা দিতে পারে । তবে, এসব কারণে ব্যাপক আকারে ফাটল দেখা যায় না।
প্রতিকার:
১। যে সব জাত ফাটল প্রতিরোধক/ সংবেদনশীল সে গুলোর চাষাবাদ করতে হবে।
২। বিভিন্ন প্রকার হরমোন সেপ্র করে ফলের পরিপক্কতা দীর্ঘায়িত করা এবং খোসার সমপ্রসারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে
ফলের ফাটা দমনের ক্ষেত্রে ভাল ফলাফল পাওয়া গেছে। ন্যাপথালিন এসিটিক এসিড ((NAA) ২৫ পিপিএম হারে এর সাথে জিবারেলিক এসিড ৫০ পিপিএম হারে ১০ দিন পর পর সেপ্র করে ফাটল রোধ করা সম্ভব।
৩। ফল বৃদ্ধির সময় জিংক সালফেট ( প্রতি লিটারে ৫ গ্রাম), রোবাঙ/ বরিক এসিড ( প্রতি লিটারে ৫ গ্রাম) একত্রে বা আলাদা আলাদা ভাবে সেপ্র করলে ফল ঝরে পড়া ও ফাটা উভয় সমস্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়।
৪। ফল বৃদ্ধির সময় গাছে নিয়মিত ও পরিমিত পরিমাণ সেচ প্রদান করলে মাটির আর্দ্রতা / রস বৃদ্ধি এবং বাতাসের তাপমাত্রা কমে যাবে। ফলে লিচুর ফাটল কমে যাবে।
৫। মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সার প্রয়োগে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বেড়ে যাবে। ফলে বিরুপ আবহায়ায় মাটির রস দ্রুত হ্রাস বৃদ্ধির হার কমে যাবে। উপরন্ত, জৈব সারে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান থাকায় মাটির অপুষ্টি জনিত সমস্যাও দুর হবে।
অনেক সময় চাষীরা ফল ফাটার প্রকৃত কারন নির্ণয় করতে পারেনা । সে জন্য একক ভাবে কোন চেষ্টার উপর নির্ভর না করে উপরের আলোচিত প্রতিকারগুলোর সমন্বিত ব্যবস্থা নিলে কার্যকর ভাবে লিচুর ফাটল রোধ করা সম্ভব হবে।
লেখক: ড. মোঃ গোলাম মোর্তুজা ও মোঃ মোশাররফ হোসেন
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ০৮ মে ২০২১