পশু রক্ত দিয়ে ‘ব্লাড মিল’ সার তৈরি

485

বন্ধুরা আমরা যারা ছাদে বা বারান্দায় বাগান করি, তাদের গাছকে সতেজ রাখতে তাকে দিতে হবে যথাযথ খাবার। “নাইট্রোজেন এবং ফসফরাস” এ দুটো পুষ্টি উপাদান সবজির জন্য অপরিহার্য। অনেকেই দ্রুত ফলনের আশায় মাটিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে থাকেন। কিন্তু রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে “ব্লাড মিল” কে পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার করেও নাইট্রোজেন এবং ফসফরাসের ঘাটতি মিটানো সম্ভব। তাতে একদিকে হবে অর্থ সাশ্রয়, অন্যদিকে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা যাবে।

ব্লাড মিল” এর উপকরন সংগ্রহ:

দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা কিংবা প্রচার না থাকায় গবাদি পশুর রক্ত, শত কোটি টাকার সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতার অভাবে যেখানে সেখানে ফেলে একদিকে হচ্ছে পরিবেশ দূষন অন্যদিকে হচ্ছে অর্থনৈতিক অপচয়।

কোরবানি উপলক্ষে বিভিন্ন শহরে লক্ষ লক্ষ গবাদি পশু জবেহ করা হয়। জবাইকৃত পশুর রক্ত তাজা থাকতেই তার উপর, সমপরিমান কাঠের মিহি গুড়ো/গমের ভুষি রক্তের উপর ছিটিয়ে দিন। কাঠের মিহি গুড়ো/গমের ভুষি এমন ভাবে ছিটাবেন যাতে সমস্ত রক্ত শুষে নিতে পারে। এতে করে “ব্লাড মিল” এর প্রাথমিক কাঁচামালা পেয়ে যাবেন। অন্যদিকে পরিবেশ দূষনের হাত থেকেও মুক্তি পাবেন।
***যে সমস্ত গবাদি পশু ঘাস, লতা পাতা খেয়ে বড় হয়েছে, যাদের উপর কোন রাসায়নিক ঔষধ প্রয়োগ করা হয় নাই, সর্বোপরি সুস্হ স্বাভাবিক পশুর রক্ত থেকে “ব্লাড মিল” তৈরী করা বান্চনিয়।

“ব্লাড মিল” তৈরির উপাদান: ১২ লিটারের প্লাস্টিকের বালতি, ১ লিটার পরিস্কার পানি, ১ টেবিল চামচ চিটা গুড়, ১ লিটার টক দই, ১ বস্তা কাঠের মিহি গুড়ো, ৫ লিটার পানির খালি বোতল।
***কোরবানী কৃত পশুর রক্ত না পাওয়া গেলে বাজারের কসাই এর দোকান থেকে আনুমানিক ৩-৫ লিটার তাজা রক্ত সংগ্রহ করতে হবে।
“ব্লাড মিল” জৈব সার প্রস্তুত করতে হলে প্রথমে রক্ত সঠিক নিয়মে পঁচিয়ে নিতে হবে। না হলে রক্তে মিশে থাকা ক্ষতিকারক জীবানু মাটির সাথে মিশে গাছের ক্ষতি সাধন করবে।

ব্লাড মিল কে পঁচানোর জন্য প্রথমে em-1 ব্যাকটেরিয়া তৈরী করে নিতে হবে। তার জন্য ১ লিটার টক দই এর সাথে ১ লিটার ফিল্টার পানি মিশিয়ে, তার সাথে এক টেবিল চামচ চিটাগুড় মিশিয়ে কিছুক্ষন নাড়তে হবে। এর পর তরল মিশ্রনটুকু কে একটি খালি ৫ লিটার বোতলে ঢেলে বোতলের কর্কটি ভাল করে টাইট করে লাগিয়ে ছায়াযুক্ত স্হানে রেখে দিতে হবে। দুদিন পর বোতলের উপরের অংশে বাষ্প জমা হয়ে ঘোলা হয়ে গেলে, বোতলের কর্কটি আস্তে করে ঢিলা করে বোতলের কিছুটা গ্যাস বের করে দিতে হবে। যদি গ্যাস বের হয় তবে বুঝতে হবে em1 ব্যাকটেরিয়া তৈরী হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। এভাবে আবার দুদিন পর অল্প করে গ্যাস বের করে বোতলের কর্কট টাইট করে দিতে হবে। এ প্রক্রিয়া চলবে ৭ দিন পর্যন্ত। ৭ দিন পর em1 ব্যাকটেরিয়া তৈরী হয়ে যাবে।

***যাদের এ প্রক্রিয়া জটিল মনে হবে তারা চাইলে প্রেসার কুকারে টক দই,পানি আর চিটা গুড় এর মিশ্রন ঢেলে em1 ব্যাকটেরিয়া তৈরী করে নিতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও ৭ দিন অপেক্ষা করতে হবে।

em1 ব্যাকটেরিয়ার তরল মিশ্রন বোতলে ভরে তিন মাস পর্যন্ত সংরক্ষন করা যাবে।

এবার কাঠের মিহি গুড়ো/গমের ভুষি মিশ্রিত পশুর রক্তের মিশ্রনকে em1ব্যাকটেরিয়ার তরল মিশ্রন দ্বারা ভাল ভাবে দুহাতে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে মিশিয়ে নিতে হবে। এ সময় মুখে মাস্ক পরে নিতে হবে, কেননা প্রচন্ড দুর্ঘন্ধ বের হবে। এবার মিশ্রনটিকে বাতাস ঢুকতে না পারে, এমন ১২ লিটারের প্লাস্টিকের বালতিতে ভরে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে ছায়া যুক্ত স্হানে রেখে দিতে হবে ১০ সপ্তাহ। বালতিটির নিচের দিকে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা অত্যাবষ্যক। কেননা মিশ্রনটি পঁচতে থাকলে কিছুটা তরল বের হতে চাইবে যা নিষ্কাশনের ব্যবস্হা না রাখলে ব্লাড মিল তৈরী হবে না। বালতির নিচে ছোট একটি বাটি রাখুন, তাতে যে রস বের হবে তা দেখতে যদিও ময়লাটে বা ঘোলা, সেটা সংরক্ষন করে রাখবেন। গাছের গ্রোথ কম মনে হলে বা কোন পোকায় আক্রান্ত হলে এই পানিটা প্রতি লিটারে ১০০ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করবেন। চমৎকার রেজাল্ট পাবেন ইনশাআল্লাহ।

১০ সপ্তাহ পর বালতির মুখ খুললে হালকা ঝাঝালো ঘ্রান বের হতে পারে। আর ব্লাড মিলের মিশ্রনে কিছুটা ভিজা ভাব থাকবে। এসময় মিশ্রনের Ph ৫-৫.৫ থকবে। এরপর ব্লাড মিলের মিশ্রনকে, সহজে বাতাস চলাচল করে এরুপ ছায়াযুক্ত স্হানে ২ সপ্তাহ মেলে দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে দেখতে হবে যেন দলা না থাকে। ১/২ সপ্তাহ পর ঝাঝালো গন্ধ সরে গিয়ে মাটির গন্ধের মত হলে ব্লাড মিলের মিশ্রনকে ১ কেজি প্লাস্টিকের ব্যাগে করে পেকেট জাত করতে পারেন। এই “ব্লাড মিল” ১ বছর সংরক্ষণ করতে পারেন!

ছাদ বাগানে নতুন গাছ রোপন করার পর, নতুন পাতা আসার লক্ষণ প্রকাশ পেলে প্রথমিক পর্যায়ে গাছের তিনটি খাদ্যের চাহিদা অত্যাবষ্যক হয়ে পড়ে, সেগুলো হলো নাইঠ্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম। আর এ চাহিদা পূরনে আমরা অনেকেই “ব্লাড মিল” ব্যবহার করে থাকি। যার npk অনুপাত ১৩.২৫- ১.৫- ০.৬। যা সবজি জাতীয় গাছের জন্য অত্যন্ত সহনশীল।।

প্রয়োগ বিধি:
এই সার প্রতি ৫ লিটার টবে ১ চা চামোচ করে, ১০ ইন্চি টবে ২ চা চামচ, ২০ লিটার টবে এক মুঠো করে দিতে হবে। যদি টবে গাছ লাগানো থাকে তো এক মগ পানিতে সব সার গুলে টবের গা ঘেষে দিতে হবে, কোন প্রকারে যাতে গাছের গোড়ায় না লাগে। ফসলি জমিতে হালকা করে এ সার মাটির উপর ছিটয়ে দিয়ে নিড়ানি দিয়ে তার উপর পানি স্প্রে করে ১ সপ্তাহ পর বীজ /চারা রোপন করা যায়।
যে সমস্ত সবজি চাষে “ব্লাড মিল” ব্যবহার করা যাবে:
মরিচ, ক্যাপসিকাম, লেটুস, টমেটো, ব্রুকলি, কেলে, পাতা কপি, মূলা, শাক জাতীয় যে কোন সবজি।

উপকারিতা:
সবজি জাতীয় উদ্ভিদের একটি বড় পরিমাণে নাইট্রোজেন প্রয়োজন কারণ, সবজির পাতা সবুজ রাখতে আর তার দ্রুত বৃদ্ধির জন্য “ব্লাড মিল” অপরিহার্য। এ সার ধীরে ধীরে মাটির সাথে মিশে ফলে, মাটিতে প্রয়োগে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় এবং গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হয়। পরিশেষে মাটির উর্বরাশক্তিও অক্ষুন্ন থাকে।

সতর্কতা:
প্রায় সব ধরনের সবজী গাছে “ব্লাড মিল” জৈব সার দেওয়া যায়…তবে সঠিক সময়ে পরিমান মত দিতে হবে…মাটিতে যদি “ব্লাড মিল/নাইট্রোজেন” সারের আধিক্য হয় তবে গাছের / পাতার স্বাভাবিক বৃদ্ধি বেড়ে যায়, গাছে পাতা আসবে প্রচুর কিন্তু ফল আসবে কম। শীতের শুরুতে প্রথমবার আর শীতের শেষে বসন্তের শুরুতে দ্বিতীয়বার এ সার প্রয়োগ করতে হয়।

বাড়ছে মানুষ কমছে কৃষিজ জমি। অতিরিক্ত জনসংখার খাদ্য চাহিদা পূরনে কৃষি জমিতে ব্যবহার বাড়ছে রাসায়নিক সার, ফলে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে কৃষিজ জমির উর্বরা শক্তি আর সেই সাথে বেড়ে যাচ্ছে স্বাস্হ্য ঝুকি। আর তাই ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুস্হ পরিবেশ উপহার দিতে আসুন “ব্লাড মিল/নাইট্রোজেন” সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করি।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ২৬ জুলাই ২০২১