খাদ্য ও পুষ্টি যোগানে পারিবারিক খামার

343

পারিবারিক খামার

পারিবারিক কৃষি প্রাচীনকাল থেকেই ঐতিহ্যভাবে বিশ্ব পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টি যোগান দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা পারিবারিক কৃষির উপর নির্ভরশীল। পারিবারিক কৃষি দরিদ্র ও প্রান্তিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর খাদ্য পুষ্টি সরবরাহের যোগান দেয়। বর্তমান বিশ্বের ৫৭০ মিলিয়ন কৃষি ফার্মের ৮৮% হচ্ছে পারিবারিক খামার। বিশ্বের মোট কৃষিজ উৎপাদনের ৫৬% উৎপন্ন করে থাকে এই পারিবারিক খামার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সময়ের কৃষিতে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৯৮% খামারই হল পারিবারিক খামার এবং মোট উৎপাদনের ৮৬% উৎপন্ন করে এ খামারগুলো। ইউরোপের মোট কৃষি খামারের পরিমাণ ১৩.৭ মিলিয়ন যার ৬৮% পারিবারিক খামার। আফ্রিকাতে এ হার ৬২%, দক্ষিণ আমেরিকায় ২৮%, উত্তর ও মধ্য আমেরিকায় ৮৩% আর এশিয়াতে ৮৫%।

আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বে খাদ্য বলতে কেবল শস্য-দানাকেই বোঝায়। যখন বলা হয়, বাংলাদেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ, তখন চাউল এবং গমের বিষয়টাকেই কেবল বিবেচনা করা হয়। চাউল শক্তির যোগান দেয়। আমাদের শরীর গঠন এবং মেধা বিকাশের জন্য প্রয়োজন আমিষ জাতীয় খাদ্যের। আমাদের শিশু ও কিশোর শ্রেণী যারা আগামী দিনের কান্ডারী, তাদেরকে স্বাস্থ্যবান এবং কর্মক্ষম করে গড়ে তুলতে প্রয়োজন সুষম খাদ্য, যার অন্যতম উপাদান আমিষ, বিশেষভাবে প্রাণিজ আমিষ, যার উৎস আমাদের প্রাণিসম্পদ খাত। বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ সেক্টরে পরিচালিত প্রায় সকল খামার পারিবারিকভাবে পরিচালিত। নিকট অতিতে বার্ড ফ্লু’র মত মহামারি থাকা সত্ত্বেও মাংস এবং ডিম উৎপাদন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া দুগদ্ধ উৎপাদনেও বর্তমান সময় বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য যদিও জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আয় বৃদ্ধির কারণে চাহিদার পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ, পশুপালন সেক্টরে একটি উল্লেখযোগ্য আয়বর্ধক কর্মকাণ্ড যার সবটাই পরিচালনা করে আমাদের পারিবারিক খামার।

২০০৭-০৮ অর্থ বছরে মোট গাবাদি প্রাণির সংখ্যা ছিল ৪.৮৫ কোটি যা ২০১২-১৩ অর্থ বছরে ৫.৩৬ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। মোট হাঁস মুরগির সংখ্যা একই সময়ে ২৫.২৩ কোটি হতে বৃদ্ধি পেয়ে ৩০.৭৪ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে দুধের উৎপাদন ২২.৮ লক্ষ মে.টন, মাংসের উৎপাদন ১০.৪ লক্ষ মে. টন হতে ৩০.২১ লক্ষ মে. টন এবং ডিমের পরিমাণ ৫৩৬ কোটি হতে বৃদ্ধি পেয়ে ৬৭৪ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। পারিবারিক এ খামারের সাফল্যকে ধরে রাখতে হলে চাই প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞান, দক্ষতা উন্নয়ন ও আর্থিক সক্ষমতা অর্জন। দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর প্রোটিন ও পুষ্টির চাহিদা নিশ্চিত করতে এ খাতে পরিচালিত খামারগুলোকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশে কৃষি পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮৫ লাখ। যদি ১ কোটি পরিবারেও একটি করে গাভী থাকে তবে তার থেকে কমপক্ষে ২০ কোটি লিটার দুধ পাওয়া যেতে পারে। জনপ্রতি প্রতিদিন ২৫০ মিলি হিসেবে সবার প্রয়োজনে দুধের চাহিদা হতে পারে ৪ কোটি লিটার। কিন্তু চাহিদার মাত্র ২২% দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। সে হিসেবে আমরা জনপ্রতি দিনে মাত্র ৯১ মিলি দুধ পাচ্ছি।

ভিশন ২০২১ এ দেশের ৮৫ ভাগ লোকের জন্য পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারের নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষমাত্রা নিরধারিত আছে। ন্যাশনাল ফুড পলিসি প্লান অব অ্যাকশন প্রথম ধাপে মানব শিশুর লো বার্থ ওয়েট হার ৩৬% থেকে কমিয়ে ২০%, আন্ডার ওয়েট হার ৫১% থেকে কমিয়ে ৩৩%, স্টান্টিং হার ৪৯% থেকে কমিয়ে ৩৩% এবং ওয়াস্টিং হার ১২% থেকে কমিয়ে ০৭% এ আনার লক্ষ্যমাত্রা স্থিরকৃত রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের National Strategy of Acclerated  Poultry Reduction (NSAPR-২০০৫) এ বলা হয়েছে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রার অন্তত দুটি লক্ষ্য অর্থাৎ দারিদ্র ও অপুষ্টিকে অর্ধেক নামিয়ে আনা। এসব লক্ষ্য অর্জনের মূল মন্ত্র হলো সঠিক পুষ্টিমানের নিশ্চয়তা। খাদ্য ও পুষ্টির প্রশ্নে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের ভূমিকা একান্তভাবেই শতভাগ। আর পুষ্টিমান উন্নয়নের জন্যে চাই- ডিম, দুধ, মাছ ও মাংস, অর্থাৎ প্রাণিজ আমিষ। একটি সৃজনশীল, মেধাবী, কর্মঠ জাতি গঠন বা আগামী প্রজন্ম বিনির্মাণে এই সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো অতীব আবশ্যক।

শিশুদের মেধা বিকাশে ডিম-দুধের বিকল্প নেই। ১৬ কোটি জনগনের এদেশে দুধের ঘাটতি থাকলেও বর্তমান চাহিদাম অনুযায়ী ডিমের কোন ঘাটতি নেই। প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ডিম উৎপাদন করছে বাংলাদেশ পারিবারিক পোল্ট্রি শিল্প যা প্রতিদিনই ভোক্তাদের দোরগোড়ায় পৌছে যাচ্ছে। এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয় যে বাড়তি চাহিদার বিপরীতে এদেশের খামারগুলো প্রয়োজনের তাগিদে আরো বেশি পরিমাণ ডিম উৎপাদনের ক্রমশ সক্ষমতা অর্জন করছে।