নদীতে ইলিশের ঘনত্ব বেড়েছে

435

নদীতে ইলিশের ঘনত্ব বেড়েছে। ফলে বাজারে ইলিশের সরবরাহ বেড়েছে। আনুপাতিক হারে কমেছে দাম। ফলে সাধারণ মানুষের অনেকটাই ক্রয়ক্ষমতার কাছাকাছি এসেছে রূপালি ইলিশ। ইলিশ রক্ষায় সরকারের নেওয়া উদ্যোগের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

মৎস্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে- ইলিশ রক্ষায় সরকার তিনটি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রথমত, ডিম ছাড়ার জন্য প্রজনন মৌসুমে (আশ্বিন মাসে পূর্ণিমার আগে ও পরে ২২ দিন) ইলিশ ধরা সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। আগে যদিও ১১ দিন ছিল, পরে তা বাড়িয়ে ১৫দিন, এবং পরবর্তীতে তা আরও বাড়িয়ে ২২ দিন করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রতিবছর ১ নভেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের ৩১ মে মাস পর্যন্ত জাটকা ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, দেশের ৬টি এলাকাকে ইলিশ অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

ইলিশের জন্য অভয়াশ্রমগুলো হলো- পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার। চরইলিশার মদনপুর থেকে ভোলার চরপিয়াল পর্যন্ত মেঘনা নদীর ৯০ কিলোমিটার। ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালীর চররুস্তম পর্যন্ত তেতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার। চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চরআলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর ১০০ কিলোমিটার। শরীয়তপুরের নড়িয়া থেকে ভেদরগঞ্জ পর্যন্ত নিম্ন পদ্মার ২০ কিলোমিটার এবং বরিশাল সদর উপজেলার কালাবদর নদীর হবিনগর পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জের বামনীরচর পয়েন্ট পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার, মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীর হাটপয়েন্ট থেকে হিজলা লঞ্চঘাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার, হিজলার মেঘনার মৌলভীরহাট পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জ সংলগ্ন মেঘনার দক্ষিণ-পশ্চিম জাঙ্গালিয়া পয়েন্ট পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার। এ সীমানার মধ্যকার নদ-নদী হচ্ছে- কালাবদর, আড়িয়ালখাঁ, নয়ভাঙ্গুলী, গজারিয়া ও কীর্তনখোলা।

সূত্র জানায়, যখন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে সেসময় জেলেদের মাসে ৪০ কেজি করে খাদ্য সহায়তা দেয় মৎস্য অধিদফতর। মার্চ মাসে নদীতে জাটকার প্রাচুর্য সবচেয়ে বেশি থাকে বলে এ মাসে পালন করা হয় জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ।

ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশের ইকোফিশ প্রকল্পের অধ্যাপক আবদুল ওহাব তার এক গবেষণায় জানিয়েছেন, মা ও জাটকা ইলিশ ধরা বন্ধ করা, অভয়াশ্রম বাড়ানো ও জেলেদের সুরক্ষা দেওয়ায় এই সাফল্য এসেছে। বাংলাদেশে এখন ৬ লাখ টনেরও বেশি ইলিশ উৎপাদন হচ্ছে। আগে যেখানে ৩ লাখ থেকে সোয়া তিন লাখ টন ইলিশ পাওয়া যেতো।

অধ্যাপক ওহাবের গবেষণা প্রবন্ধটিতে বলা হয়, বাংলাদেশ বিভিন্ন নদ-নদীতে ইলিশের যে অভয়াশ্রম তৈরি করেছে, তা ধারাবাহিকভাবে এই মাছের উৎপাদন বাড়িয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে বাংলাদেশের মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশের করা যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, মা ইলিশ যে নদীতে ডিম ছাড়ে এবং বাচ্চা ইলিশ যেখানে বড় হয়, পরিণত অবস্থায় তারা সমুদ্র থেকে সেই নদীতেই ফিরে আসে। বাংলাদেশে যেহেতু অভয়াশ্রমগুলোয় ইলিশের ডিম ছাড়ার হার বেশি এবং বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, তাই সাগর থেকে তারা সেখানেই ফিরে আসছে। ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো অভয়াশ্রম তৈরি করে মা ও জাটকা ইলিশের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেনি। মৎস্য অধিদফতর ও ওয়ার্ল্ডফিশের গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে ৬ লাখ ৭০ হাজার টন ইলিশের সর্বোচ্চ টেকসই উৎপাদন সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানিয়েছেন, সামনের দিনগুলোয় ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়বে। কারণ ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের নেওয়া কার্যক্রমের ফসল হিসেবেই এই সফলতা অর্জন সম্ভব হচ্ছে। মা ও জাটকা ইলিশ ধরা বন্ধ করায় আমাদের এখানে এই সাফল্য এসেছে। ইলিশের বড় হওয়ার জন্য অভয়াশ্রমগুলো বাড়ানো এবং সুরক্ষা দেওয়াও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। আগামিতে দেশের জিডপিতেও ইলিশেল অবদান বাড়বে। বর্তমানে জিডিপিতে ইলিশের অবদান এক শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক মিহির কান্তি ঘোষ জানিয়েছেন, ডিম ছাড়ার সময় ইলিশ ধরা এবং ডিম ফুটে হওয়া জাটকা রক্ষায় সরকারের বিস্তৃত কার্যক্রমের কারণে নদীতে ইলিশ মিলছে। পাশাপাশি নদীতে ইলিশের ঘনত্বও বেড়েছে।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, মেঘনা নদীতে প্রতি ১০০ মিটার জালে ঘণ্টায় ২ দশমিক ৭৭ কেজি জাটকা ধরা পড়েছে, যেখানে ২০০৭ সালে ধরা পড়ত এক কেজিরও কম (০.৭২ কেজি)।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মা ইলিশ রক্ষার অভিযান আরও কঠোরভাবে পালন করা উচিৎ। কারেন্ট জালের উৎপাদন ও ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা উচিৎ এবং মাছ ধরা বন্ধের সময় জেলেদের সহায়তার পরিমাণ বাড়ানো উচিৎ।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ০৫সেপ্টেম্বর ২০২১