বিশ্বজুড়ে উত্কৃষ্ট মানের পশু ও প্রাণিজ খাদ্য হিসেবে বিবেচিত ‘সয়াবিন মিল’ বা সয়াবিনের খইল। এটি গবাদি পশু-পাখির প্রোটিনের একটি বড় উৎস। বাংলাদেশেও পোলট্রি ফিড হিসেবে মৎস্য চাষি ও খামারিদের কাছে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে; যার অর্ধেকের বেশি জোগান নিশ্চিত করা হয় স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে।
কিন্তু সম্প্রতি সয়াবিনের খইল রপ্তানি শুরু করেছে দুই প্রতিষ্ঠান, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দর বৃদ্ধির ফলে সয়াবিনের খইল সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে। এতে অনেক ফিড মিল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থায় দেশীয় কাঁচামালও যদি রপ্তানি করা হয়, তবে পোলট্রিশিল্প টিকতে পারবে না। ফলে মাছ-মাংস সরবরাহেও ঘাটতি তৈরি হবে। তাই এর রপ্তানি বন্ধ করা উচিত।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, গত এক মাসে সয়াবিনের খইলের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে আট থেকে দশ টাকা। গত এক বছরে বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। পাইকারি বাজারে হাই প্রোটিন সয়াবিনের খইল বিক্রি হচ্ছে কেজি ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা, এক মাস আগেও যা বিক্রি হয়েছিল ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা।
এ খাতের সংগঠন ফিড ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (এফআইএবি) সূত্রে জানা গেছে, সয়াবিনের খইল পোলট্রি ও মৎস্য খাদ্যের প্রধান উপাদান। দেশে এর মোট চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন, যার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়। বাকি অংশ পূরণ করা হয় ভারত, আমেরিকা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে আমদানির মাধ্যমে।
এফআইএবির সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান বলেন, ‘সয়াবিনের তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অতি মুনাফার লোভে ধ্বংসের মুখে দেশের ফিডশিল্প। প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে অনেক ফিড কারখানার উৎপাদন বন্ধ বা কমাতে হচ্ছে। সয়াবিন খইলের সরবরাহ সংকট তৈরি হলে পোলট্রি উৎপাদন কমবে। দাম বাড়বে মুরগি, ডিম ও মাছের। সাশ্রয়ী মূল্যে সাধারণ মানুষের পুষ্টির জোগানে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। এ জন্য রপ্তানিতে আপত্তি জানিয়ে আমরা চিঠি দিয়েছি বাণিজ্য, খাদ্য, কৃষি ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি) হাফিজুর রহমান বলেন, ‘নীতিমালায় কোনো নিষেধ না থাকায় সয়াবিনের খইল রপ্তানি হচ্ছে। পরবর্তী নীতিমালায় বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে। নতুন রপ্তানিনীতি করার আগে কিভাবে কী করা যায়, এ নিয়ে কাজ করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘নিজের পর্যাপ্ত থাকলে বা প্রয়োজন মিটিয়ে এরপর পণ্য রপ্তানি হয়। সয়াবিন মিল দেশে উৎপাদন হয় না; সয়াবিন বিজের তেল উৎপাদনকারীরা বিনা শুল্কে আমদানি করে ওই তেলের বাই প্রডাক্ট হিসেবে সয়াবিন মিল উৎপাদন করে, যা বেশি দামে রপ্তানি করা কোনোভাবেই নৈতিক নয়। এর ফলে স্থানীয় বাজারে প্রভাব পড়বে এবং এর দাম বেড়ে যাবে।’
এর ফলে মাছ-মাংস উৎপাদন হুমকিতে পড়বে দাবি করে তিনি বলেন, ‘পণ্যটির বাজারে দাম বাড়লে পোলট্রি ফিডের দাম বাড়বে। এতে মাছ-মাংস উৎপাদন কমে যাবে। ভোক্তাদের আমিষের চাহিদা পূরণে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হবে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত দেশ সয়া মিলে স্বয়ংসম্পন্ন হবে না, ততক্ষণ রপ্তানির সুযোগ নেই।’
বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প কেন্দ্রীয় কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) সূত্রে জানা যায়, পোলট্রি মুরগির ৫০ শতাংশ ব্যবহার হয় বাসাবাড়িতে। বাকি ৫০ শতাংশ ব্যবহার হয় বিয়ে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্টুরেন্ট ও পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে। কিন্তু করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গত দেড় বছরে ৪০ শতাংশ পোলট্রি ফার্ম তাদের উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় সয়াবিন খইলের ঘাটতির কারণে খামারিরা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে দাবি সংগঠনটির। পোলট্রি ফিডের দাম বেশি হওয়ায় লাভ পাচ্ছেন না খামারিরা। এ অবস্থায় দেশের দুটি প্রতিষ্ঠান সয়াবিনের খইল রপ্তানি করায় তাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
এ ব্যাপারে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান বলেন, ‘সয়াবিন মিল কী পরিমাণ রপ্তানি হয়েছে, এ ব্যাপারে কোনো ডাটা না থাকলেও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারেন। তবে মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে কাউকে বাধা দিয়েও রাখা যাবে না।’
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ০৮সেপ্টেম্বর ২০২১