বর্তমানে দুধ ও মাংসের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক দুধ ও মাংসের চাহিদা যথাক্রমে ২৫০ মিলি ও ১২০ গ্রাম । চাহিদার তুলনায় দৈনিক জন প্রতি দুধ ও মাংসের প্রাপ্ততা যথাক্রমে ৬০-৮০ মিলি ও ৪০ গ্রাম। এই ঘাটতি পূরণ সহ মানুষের সুস্থ ও সবলভাবে বেচে থাকার জন্য আমিষসমৃদ্ধ খাদ্য (দুধ ও মাংস) এর উৎপাদনে গরুর খামার তৈরি বিকল্প নেই।
দুধ ও মাংস আমিষের একটি মূল্যবান উৎস। শিশু-কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ ও রোগী সবার জন্য দুধ পুষ্টিকর খাবার । শুধুমাত্র শিশু খাদ্য হিসাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ দুধের চাহিদা রয়েছে। প্রতি বছর কয়েক শত কোটি টাকার কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে আমদানী করতে হচ্ছে দুধ। তাই আমাদের উচিত গরুর খামার তৈরি করতে যে সকল সমস্যা রয়েছে তা দূর করে স্বনীর্ভর হওয়া।
বাংলাদেশে গরুর খামার তৈরি করলে ১২টি সমস্যাঃ
(১) দুধ সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে কাঁচা দুধ বাজারজাতকণের ব্যবস্থা না থাকা।
(২) কাচা দুধ প্যাকেটজাত করে বাজারজাতকণের ব্যবস্থা না থাকা।
(৩) উন্নত জাতের বকনা প্রাপ্তি সম্পর্কে তথ্য না থাকা।
(৪) প্রয়োজনীয় পরিমাণ কাচা ঘাসের সংস্থান না খাকা।
(৫) সঠিক পরিমান ঋণের প্রাপ্যতা না থাকা।
(৬) আঁশ ও দানাদার জাতীয় খাদ্যের উচ্চ মূল্য।
(৭) পশু চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির স্বল্পতা ও চিকিৎসা সেবার উচ্চ মূল্য।
(৮) খামারীদের আদর্শ গোয়াল ঘর তৈরীতে কারিগরী সহায়তা অভাব।
(৯) গাভীর রোগ-বালাই পরীক্ষা করার জন্যে ভেটেরিনারী ল্যাবরেটরীর অপ্রতুলতা।
(১০) টিকা সংরক্ষণ ও গুণগতমানের ঔষধ প্রাপ্তি সহজলভ্য করতে মিনি ভেটেরিনারী ফার্মেসী না থাকা।
(১১) দুধ দোহনকারী/গোয়ালা/দুধ সংগ্রহকারীদেরকে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে দুধ দোহন, পরিবহন, সংরক্ষণ ও দুধের গুণাগুণ রক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ না থাকা।
(১২) সরকার কর্তৃক বিভিন্ন নতুন নতুন উন্নত জাতের ঘাস (নেপিয়ার, পারা, জার্মান) চাষে সহায়তা না থাকা।
গরুর খামারে খামারীদের সমস্যা দূরীকরণে কিছু করণীয়ঃ
(১) প্রযুক্তি ও উৎপাদন পর্যায়ে ও আধুনিক ব্যবস্থাপনায় (গাভীর সঠিক জাত নির্বাচন, আদর্শ গোয়াল ঘর তৈরী, সুষম খাদ্য প্রস্তুতকরণ,খড় প্রক্রিয়াজাতকরণ করা, কাচা ঘাস সংরক্ষণ (সাইলেজ), উন্নত জাতের ঘাস চাষ ইত্যাদি) গাভী প্রতিপালন বিষয়ে খামারীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
(২) গাভীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পোষ্টার লিফলেট খামারীদের প্রদান করা ।
(৩) গাভী পালনের ক্ষেত্রে খামারীরা প্রশিক্ষণলব্ধ প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞান যাতে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে গবাদীপশুর বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার, গাভীকে সময়মত টিকা ও কৃমিনাশক প্রদান, সুষম দানাদার খাদ্য তৈরী, আদর্শ বাসস্থান ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নানাবিদ বিষয়ে নিয়মিতভাবে খামারীদেরকে হালনাগাদ তথ্য ও পরামর্শ প্রদানের জন্যে গাভী পালনকারী খামারীদের দ্বারা সমিত এক একটি সমিতি গঠন করে করে মাসিক ইস্যুভিত্তিক সভার আয়োজন করা যেতে পারে।
(৪) কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন ও দেশের জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে সে হারে গবাদীপশুর সংখ্যা, মাংস এবং দুধ উৎপাদন সে হারে বাড়ছে না। মানুষ বাড়ার সাথে এই ক্রমবর্ধমান মানুষের দুধ ও মাংসের চাহিদা পূরণ করতে প্রয়োজন বেশি মাংস ও দুধ উৎপাদনক্ষম জাতের ষাড় ও গাভী পালন । আর জাত উন্নয়নের পূর্বশর্ত ভালোজাতের ষাঁড়ের বীজ দিয়ে দেশী জাতের গাভীকে প্রজনন করানো । কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশী জাতের গাভীর জাত উন্নয়ন করে দুধ ও মাংস উভয়ের উৎপাদন কাংখিত পর্যায়ে বৃদ্ধি করা সম্ভব।
(৫) বেশি উৎপাদনশীল জাতের ষাঁড়ের সিমেন/বীর্য সংগ্রহ এবং তা দুরবর্তী স্থানে পরিবহন করে নিয়ে গাভীকে প্রজনন করানো একটি ঝুকিপূর্ণ কাজ। যেখানে সিমেন পরিবহনের জন্যে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একটি কুল চেইন মেইনটেইন করতে হয়। যা এআই কর্মীদের সব সময় মেইনটেইন করা সম্ভব হয় না। পাশাপাশি রয়েছে। এআই করানোর এআই স্টেবিস এর অভাব । বর্ণিত সমস্যা দূর করলে খামারীদের কাছে কৃত্রিম প্রজনন সেবা সহজলব্য হবে।
(৬) প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে ভেটেরিনারী সেবা সহজলভ্য করতে লাইভষ্টক সার্ভিস প্রাভাইডার (এলএসপি) তৈরী করা। গাভীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থপনা কার্ড (কৃমিনাশক খাওয়ানো, টিকা প্রদান, খাদ্য প্রদান, চিকিৎসা, ওজন নির্ণয় ইত্যাদি তথ্য লিপিবদ্ধ করার জন্য) ব্যবহার করা ।
(৭) গাভী পালন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে ভিডিও ডকুমেন্টারী প্রচার করা; জাত উন্নয়নের জন্যে কৃত্রিম প্রজননে সহায়তা করা।
(৮) উৎপাদনকালীন সময়ে খাদ্য উপাদান (খড়, চালের কুড়া, গমের ভূষি, খৈল ইত্যাদি দানাদার খাদ্য) মজুদ করার প্রযুক্তি সম্পর্কে সহায়তা প্রদান করা।
(৯) প্রয়াজোনীয় উপকরণ সম্বলিত আদর্শ গোয়াল ঘর তৈরীতে প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান। গোখাদ্য সহজপাচ্য ও উপযুক্ত উপায়ে পরিবেশন প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করা। গাভী পালন ব্যবসার আনুসঙ্গিক বিষয়ে (গাভী প্রাপ্তির স্থান, গাভী ব্যবসায়ী, যন্ত্রপাতি, খাদ্য, ঔষধ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) বিজনেস ডিরেক্টরী তৈরী করা।
(১০) গবাদী পশুর জন্যে তড়কা একটি মারাত্বক ও সংক্রামক রোগ যা ব্যাসিলাস এ্যানথ্রাসিস (Bacilus anthracis) নামক এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া দ্বারা হয়ে তাকে। তড়কা রোগের অন্যান্য প্রচলিত নাম হল ধড়কা, উবাল মুড়কী, পলি বা তীলাজ্বর। সারা বছরেই এ রাগ হয়ে থাকে তবে গ্রীষ্মপ্রধান এ রোগের প্রার্দুভাব বেশি হয়। সকল জীবজন্তু এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। মাংস, দূষিত পানি, ঘাস, খড় প্রভৃতির মাধ্যমে রোগ জীবাণু সংক্রমিত হয়ে থাকে। অতি তীব্র রোগে আকস্মিকভাবে কোন প্রকার লক্ষণ দেখা ছাড়াই প্রাণীর মৃত্যু হয়ে থাকে। যদিও আক্রান্ত পশুকে সময় মত চিকিৎসা করালে গবাদীপশু ভালো তবে তার উৎপাদনশীলতা আগের চেয়ে কমে যায় । এজন্যে রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । প্রবাদে আছে “Prevention is better than cute” এর রোগ হওয়ার পূর্বে খামারীদের এ বিষয়ে সচেতন করে এ রোগ দমণ করতে হবে। খামারীদের সচেতন করতে নিয়মিত কর্মশালার আয়োজন করা দরকার।
কৃষিপ্রধান ও জনবহুল আমাদের এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৃষিকাজের উপর অনেকটা নির্ভরশীল । আর এই কৃষির একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে প্রাণিসম্পদ। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রাণীসম্পদ একটি সম্ভাবনাময় ও লাভজনক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।। সেই সাথে উপযুক্ত প্রযুক্তির উদ্ভাবন প্রাণীসম্পদ খাতকে আজ কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও গ্রামীণ দারিদ্র বিমোচনের একটি অন্যতম প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করেছে। দেশের বেকার জনগোষ্ঠী এবং মহিলারা প্রাণীসম্পদ পালনে সম্পৃক্ত হয়ে আত্মকর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পেয়েছেন।
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১৭সেপ্টেম্বর ২০২১