মুরগির গামবোরো রোগ | 10 লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়। গামবোরো বাংলাদেশের বাণিজ্যিক পোল্ট্রি ফার্মগুলির কাছে একটি সুপরিচিত নাম। মুরগির গামবোরো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এমন কি প্রতিটি খামারে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই রোগের কারণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লোকসান করে।
আর তাই মুরগির গামবোরো রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে খামারির পর্যাপ্ত ধারনা থাকা দরকার। নীচে আমি মুরগির গামবোরো রোগ তথা গামবোরো রোগের লক্ষণ সম্পর্কে ও ভ্যাকসিন সম্বন্ধে সামান্য ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
মুরগির গামবোরো রোগের ইতিহাস
মুরগির গামবোরো রোগের ইতিহাস টা জানা থাকলে রোগের অন্যান্য বিষয় মনে রাখা সহজ হয়। এই রোগটি প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যার রাজ্যের গামবোরো জেলায় বিজ্ঞানী কোসাগ্রোভ দ্বারা আবিষ্কার করেছিলেন ১৯৭২ সালে। এবং রোগটির নামকরণ করা হয়েছে সেই জেলার নামানুসারে।
গম্বোরো রোগটি ১৯৭১ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে প্রথম দেখা গিয়েছিল। বাংলাদেশে ১৯৯২ সালে গামবোরো রোগটি প্রথম দেখা গিয়েছিল। অনেকের মতে, ভারত ও নেপাল থেকে আমদানিকৃত এক দিনের মিরগির বাচ্চা থেকে এই রোগ দেশে প্রবেশ করে।
বিমান পোল্ট্রি কমপ্লেক্সে বাংলাদেশের প্রথম এই রোগের ভাইরাসের সন্ধান মিলেছিল। তবে এই রোগটি এখন সারা বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি বানিজ্যিক খামারে পাওয়া যায়।
মুরগির গামবোরো রোগের কারণ
মুরগির গামবোরো রোগ একটি ভাইরাস জনিত ছোয়াছে রোগ। মুরগির গামবোরো রোগ কে ইনফেকসিয়াস বারসাল ডিজিজ (Infectious Bursal Disease) বা IBD বলে। এটা মুরগীর রোগ প্রতিরোগ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় বা নষ্ট করে দেয়, ফলে মুরগী দুর্বল হয়ে পড়ে ।
এই রোগের মৃত্যুর হার বা মর্টালিটি অনেক বেশি। দেখা যায় মুরগি খুব দুর্বল হয়ে পড়ে ও খাওয়া দাওয়া কম করতে থাকে ফলে মুরগি আরো দুর্বল হয়ে যায়। এবং মুরগি দ্রুত মারা যেতে থাকে।
গামবোরো রোগের লক্ষণ দেখাদেওয়ার পর সময় মত ব্যাবস্থা নিতে না পারলে ব্যাপক হারে মুরগি মারা যেতে থাকে।
মুরগির গামবোরো রোগ কিভাবে ছড়ায়?
এই ভাইরাস অতি ছোয়াছে হওয়ায় এক মুরগি থেকে অন্য মুরগিতে সংক্রমণ পবিপূর্ণ রোধ করা যায় না। তবে আমরা রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকলে ও আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনা মেনে চললে খুব ভালোভাবেই এই রোগের সংক্রমন থেকে বাচতে পারি। মুরগির গামবোরো রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের জানা থাকলে খুব সহজেই এই রোগ খামারি সারিয়ে তুলতে পারে।
এই রোগের ভাইরাস এক মুরগী হতে অন্য মুরগীতে সহজেই ছড়ায়।
এই ভাইরাস মুরগীর বিষ্ঠার মধ্যে থাকে এবং মুরগী ঐ বিষ্ঠা খাওয়ার মাধ্যমে আক্রান্ত হয়।
বাতাসের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়।
সংক্রমিত খাদ্য, পানি , বিভিন্ন যন্ত্রপাতি , কাপড় চোপড়, জুতার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়।
গামবোরো রোগ সাধারনত ৩-৬ সপ্তাহের মুরগীর বাচ্চাতে হয়ে থাকে ।
এই রোগে আক্রান্তের হার ১০০% কিন্তু মৃত্যুর হার ৩০-৪০%
মুরগির গামবোরো রোগ
মুরগির গামবোরো রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা
মুরগির গামবোরো রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা মুরগি খামারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেননা আজকাল প্রায় প্রতিটি ব্রয়লার ও সোনালী মুরগির খামারেই দেখা যায়। মুরগির গামবোরো রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা জানা থাকলে খামারি বিচলিত না হয়ে খুব তারাতারি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। মুরগির গামবোরো রোগের লক্ষণ সমূহ নিম্ন রুপ।
গামবোরো রোগে আক্রান্ত মুরগীর দেহের পালক উসকো খুসকো হয়ে যায়।
চুনা-পায়খানা করে।
আক্রান্ত মুরগীর পায়খানার সাথে পানি বের হয় এবং পায়খানা ছড়িয়ে পড়ে।
মুরগী খাবার ও পানি খাওয়া কমিয়ে দেয়।
মুরগীর ডায়রিয়া দেখা যায়, এর ফলে মলদ্বারের কাছের পালক ভেজা থাকে।
মুরগীর দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
এক মুরগী অন্য মুরগীর পৃষ্ঠদেশ ঠো্করাতে থাকে।
আক্রান্ত মুরগী হাটাহাটি বা নড়াচড়া করতে চায় না।
মুরগী মাথা সামনের দিকে নুয়িয়ে রাখে। মুরগী ঝিমাতে থাকে
মুরগীর দেহের ওজন কমে যায়।
পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট
গামবোরো রোগের ভাইরাস এর প্রথম টার্গেট হলো বার্সা ফেব্রিসিয়াস নামক রোগপ্রতিরোধ অংগ। ভাইরাস আক্রান্তের ১-৩ দিনের মধ্যে বাসা ফেব্রিসিয়াস ফুলে যাবে এবং জিলাটিন জাতীয় পানি পাওয়া যাবে।
আক্রান্ত মুরগির বয়স ৩-৮ দিন হলে বার্সা ফেব্রিসিয়াস ছোট হয়ে যাবে।
আক্রান্ত মুরগির বয়স ৮-১৩ দিন হলে বার্সা ফেব্রিসিয়াস এর লুমেন এ কেজিয়াস কোর পাওয়া যায়।
মুরগীর দুই পায়ের রানের মাংসে ফোটা ফোটা রক্ত বিন্দু পাওয়া যাবে।
মিরগির কিডনী অনেক ফুলে যায় এবং কিডনি তে ইউরেট জমা থাকতে দেখা যায়।
মুরগীর বুকের মাংসে ফোটা ফোটা রক্ত বিন্দু বা হিমোরেজ দেখতে পাওয়া যাবে।
মুরগির গামবোরো রোগের চিকিৎসা
মুরগির গামবোরো রোগের বিরুদ্ধে কাযকরী কোন চিকিৎসা নাই । মুরগির গামবোরো রোগের লক্ষণ দেখাদিলে এই রোগের সাথে সাথে অন্যান্য রোগ যেমন – কক্সিওডিওসিস হতে পারে। তাই যে কোন একটি এন্টিবায়োটিক দেয়া যেতে পারে , সাথে সালফার গ্রুপের একটি ড্রাগ দেয়া যেতে পারে। এন্টিবায়োটিক হিসাবে সিপ্রোফ্লক্সাসিন বা এমোক্সিসিলিন গ্রুপের ঔষধ দেওয়া যেতে পারে।
যেহেতু এই ভাইরাস মুরগির ইমিউনিটি সিস্টেম কে আক্রমন করে ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংস করে তাই ইমিউনিটি স্টিমুলার বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি কারক ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। যেহেতু মুরগী দুর্বল হয়ে পড়ে তাই ভিটামিন সি দেয়া যেতে পারে , এছাড়া পানিতে ভিনেগার ও পানি গ্রহণের পরিমান বৃদ্ধির জন্য গুড় বা চিনি দেয়া যেতে পারে।
মুরগির গামবোরো রোগ বা গামবোরো রোগের লক্ষণ দেখা দিলে নিকটস্থ প্রানী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগাযোগ করতে হবে। এছারাও বিভিন্ন ঔষধ কম্পাণির থেকে রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া আছে যারা আপনার হাতের কাছেই উপজেনা বা জেলা শহরে আছে। আপনি চাইলে এদের থেকেও সেবা গ্রহণ করতে পারেন। কম্পাণীর ডাক্তারের সেবা নিতে কম্পাণীর বিক্রয় প্রতিনিধি বা খাদ্যের ডিলারের সাথে যোগাযোক করতে পারেন।
মুরগির গামবোরো রোগের ঔষধ
মুরগির গামবোরো রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় এমন কিছু ঔষধ সম্পর্কে খামারিদের কে ধারণা দিতে চাই। আর এ কথাও বলতে চাই মুরগির গামবোরো রোগের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ভেটেরিনরি ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন।
ইমিউনিটি স্টিমুলার বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারক ঔষধ ব্যবহার করতে হবে (বেটামিউন, ইমুলাইট, লাইসোভিট, ইমভেট)।
সিপ্রফ্লক্সাসিন ও এমক্সিসিলিন এই দুই গ্রুপের এস্টিবায়োটিক ঔষধ ব্যবহার করতে হবে (সিপ্রো-এ, এসিমক্স-৩০)।
ভিটামিন সি ও স্যালাইন দিতে হবে।
ভিনেগার ব্যবহার করা যেতে পারে।
ঔষধের পানিতে আঁখের গুড় ব্যবহার করলে দ্রুত কাজ হয়।
মুরগির গামবোরো রোগের ভ্যাকসিন
প্রায় প্রতিটি শীর্ষস্থানীয় ভেটেরিনারি ঔষধ কম্পাণি এখন বিদেশ থেকে ভালো মানের ভ্যাকসিন আমদানি করছে। দাম ও হতের নাগালে। যে কম্পাণির টিকা বা ভ্যাকসিন আপনি ব্যবহার করেন না কেন এতে সমস্যা নাই।
ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও ভ্যাকসিনেশস কার্যটি যথাযথ ভাবে করতে হবে। ভ্যাকনসন প্রয়োগের আগে ও পরে ভিটামিন সি ও ই খাওয়ালে ভ্যাকসিন ভালো কাজ করে। ভ্যাকসিন প্রয়োগের আগে ও পরে এন্টিবায়টিক ব্যবহার করা যাবে না।
সুস্থ্য মুরগিতে প্রয়োগ করতে হবে। পানিতে ভ্যাকসিন খাওয়ানোর সময় পরিস্কার ও বিশুদ্ধ পানি অল্প করে নিয়ে খাওয়াতে হবে। যাতে কম সময়ে ভ্যাকসিনের পানি পান করে শেষ করতে পারে।
রোগ প্রতিরোধের উপায়
আপনার খামার কে গামবোরো রোগ হতে বাচাতে সঠিকভাবে জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৭-১০ দিনে প্রথম এই রোগের টিকা চোখে বা পানিতে প্রয়োগ করতে হবে।
১৫-১৮ দিন বয়সে দ্বিতীয় বার এই রোগের টিকা বা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে।
জনসাধারণ ও বাইরের পশু-পাখি প্রবেশ সীমাবদ্ধ করতে হবে।
খামারের আশেপাশে জীবাণুর প্রাদুর্ভাব থাকলে সংক্রমণের আগেই এই ভাইরাসের প্রিভেন্টিভ ডোজ দেওয়া যেতে পারে।
নিয়মিত রেজিস্টাড ভেটেরিনারি ডাক্তারের এর পরামর্শ গ্রহন করতে হবে।
বিস্যস্ত কম্পাণীর এ গ্রেডের বাচ্চা ক্রয় করতে হবে।
গুণগত মানে পরিক্ষিত মুরগির খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১২ জানুয়ারি ২০২২