বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-এর ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে সাতটির সঙ্গে পোলট্রিশিল্পের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বিধায় আলাদাভাবে এই শিল্পের গুরুত্ব অনায়াসেই চলে আসে। কারণ বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির উপখাত হিসেবে পোলট্রি খাতের অবদান ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষের স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থান প্রত্যক্ষভাবে এই খাতে রয়েছে। যদি পরোক্ষ অংশটি যোগ করা হয়, তবে এই অঙ্কটি দাঁড়ায় প্রায় ৮০ লাখ।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ বলছে, মানুষের প্রাণিজ আমিষ চাহিদার ৪৫ শতাংশ এখন পোলট্রি খাতনির্ভর এবং এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা, যেখানে আত্মকর্মসংস্থান তথা উৎপাদন আয় বাড়ানোর অপূর্ব সুযোগ রয়েছে।
পোলট্রিশিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত সংগঠনের নেতারা মনে করেন, দেশে প্রতি বছর গড়ে ১৫ লাখ জনশক্তি শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। আবার শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে এক শতাংশ হারে কমছে আবাদি জমি— যা এক বিস্ময়কর চিত্র। এ পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তা তথা পুষ্টিনিরাপত্তায় এক জ্বলন্ত ভূমিকা রাখতে পারে এই খাতটি।
খাদ্য কৃষি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, মানব দেহের শক্তির ৬০ শতাংশ আসবে শস্যজাতীয় পণ্য থেকে, ১৫ শতাংশ আসবে আমিষজাতীয় খাদ্য থেকে এবং এই আমিষের ২০ শতাংশ হবে প্রাণিজ আমিষ অর্থাৎ মাছ, মাংস ও ডিম থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন একজন মানুষ ৭ গ্রাম ডিম এবং ১৪ গ্রাম মুরগির মাংস খেয়ে থাকে, যা থেকে আমিষ আসে যথাক্রমে এক ও তিন গ্রাম; অথচ এই সংখ্যাটি হওয়ার কথা কমপক্ষে ১৫ গ্রাম। একটি প্রবাদ আছে ‘সুস্থ খাবার সুস্থ জাতি’ এবং এর জন্য প্রয়োজন পোলট্রি উৎপাদনে জীবাণুমুক্ত ব্যবস্থাপনা।
একসময় এই শিল্পটি ছিল আমদানিনির্ভর; কিন্তু বর্তমান বাজারে ক্রমাগত চাহিদার কারণে এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত পোলট্রি খাদ্যের প্রায় ৯৫ শতাংশই আধুনিক ফিড মিলগুলোয় উৎপন্ন হচ্ছে এবং এই খাদ্যে ব্যবহূত ভুট্টার প্রায় ৪০ শতাংশ দেশীয় খামারে উৎপাদিত হচ্ছে। এই পোলট্রিশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের ৪০ শতাংশই নারী, যা নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে।
দেশের আধুনিক হ্যাচারিগুলোতে যান্ত্রিক উপায়ে প্রতি সপ্তাহে এক দশমিক ১০ কোটি ডিম ফোটানো হয় এবং এই শিল্পের বর্জ্য থেকে তৈরি হয় বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ ও সার।
বাংলাদেশে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে মুরগির মাংস প্রক্রিয়াজাত করা হয়, যা ঢাকা শহরের বিভিন্ন পাঁচতারকা হোটলসহ শপিংমলগুলোতে সরবরাহ করা হয়। এ ব্যাপারে দাতা সংস্থা কিংবা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আগামীতে এ খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা এক কোটি জনশক্তির হবে বলে আশা করা যায়।
কারণ এই খাতের ব্যবসা আর পাঁচটি ব্যবসার মতো নয় এবং গ্রামাঞ্চলে অগণিত খামারি সনাতনি কায়দায় খামার পরিচালনা করে থাকেন, যেখান থেকে ডিম কিংবা মাংস সরবরাহ একটি স্পর্শকাতর বিষয়; কিন্তু এই ব্যবসায় উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ অন্যান্য ব্যবসার আদলে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে— যার মধ্যে রয়েছে রোগবালাই, আপদকালীন সময়ের জন্য প্রণোদনা, কর মওকুফ সুবিধা, কাঁচামাল ও পণ্য আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি, নীতি সহায়তার অনুপস্থিতি, অ্যাডভান্স আয়কর, পোলট্রি খাতকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের মর্যাদা না দেয়া, ওষুধের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার, ডিডিজিএসের ওপর থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বলবত, ঋণের ক্ষেত্রে বর্ধিত হারে সুদের হার ইত্যাদি।
বর্তমানে পোলট্রি কৃষির উপখাত হলেও ঋণ নিতে হয় শতকরা ১৬ টাকা হারে; অথচ কৃষি খাতে ঋণের সুদ মাত্র ৫ শতাংশ। একটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিটি পোলট্রি ফার্মের ৬৫ শতাংশ খরচ হয় ফিডে, যার মূল উপাদান ভুট্টা। এর উৎপাদন খরচ কমাতে পারলে অনায়াসেই ডিম-মাংসের দাম কমে আসবে। কারণ ভুট্টার প্রায় ৪০ শতাংশ দেশীয় খামারে উৎপাদিত হয়। দেশে অন্যান্য কৃষিপণ্যের জন্য হিমাগারের ব্যবস্থা রয়েছে, বিশেষত আলু, দুধ, মাছ ইত্যাদি; কিন্তু ডিম কিংবা মাংসের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয় না। সরকার পোলট্রিকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, ফলে প্রতিটি খামারের নিবন্ধন জরুরি— যা প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করবে।
অপুষ্টিতে ভুগছে পোলট্রি খাত : করোনায় দেশের যেসব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর অন্যতম হলো ‘পোলট্রি খাত’। বাংলাদেশ ‘পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল’ (বিপিআইসিসি)-এর হিসাবমতে, জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ফিড ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় ৫২৯ কোটি টাকা এবং সামগ্রিকভাবে পোলট্রিশিল্পে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
আর গত ১২ বছরের মধ্যে পোলট্রির দর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছিল এই দুর্যোগের কারণেই। ২০২০ সালের জুন মাসের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৩৫-৪০ শতাংশ ফিডের উৎপাদন এবং প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ ওষুধ ও ফার্মাসিউটিক্যালস প্রোডাক্টের বিক্রি কমে গেছে।
বস্তুত পোলট্রি খাতের কয়েক লাখ প্রান্তিক খামারির অবস্থা এখন চরম সমস্যাক্রান্ত। তারা নিপতিত হয়েছেন উভয় সংকটে। একদিকে পোলট্রি খাদ্যের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে কমেছে মুরগি ও ডিমের দাম। গত বছর পোলট্রি ফিডের দাম টনপ্রতি ছিল ৩১ হাজার টাকা, তখন ডিমের দাম ওঠে সাত-আট টাকায়, আর এ বছর পোলট্রি খাদ্যের টন ৪১ হাজার টাকা, অথচ ডিমের দাম কমে নেমে এসেছে চার-পাঁচ টাকায়! লকডাউনে কমেছে মুরগির দাম। এ অবস্থায় দেশের কয়েক লাখ প্রান্তিক খামারি দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।
লকডাউনে পোলট্রি খামারিদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়েছে। উৎপাদন প্রক্রিয়া ও সরবরাহ— দুটিই পড়েছে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। তবে বাস্তবতা হলো, পোলট্রি ফিডের মূল্যবৃদ্ধি একটি বড় সমস্যা। পোলট্রি ফিডের অন্যতম উপকরণ ভুট্টা পোলট্রি ফিড হিসেবে দাম বাড়াটা অযৌক্তিক বটে। করোনায় খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমনিতেই উৎপাদন মূল্য পাচ্ছেন না, তার ওপর পোলট্রি ফিডের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
পোলট্রি দেশের অন্যতম শিল্প খাত। তাই এ খাতকে শুধু বাঁচিয়ে রাখা নয়, এর শ্রীবৃদ্ধিও ঘটানো উচিত। এ অবস্থায় মৎস্য ও প্রাণিখাদ্য প্রস্তুতকারক ফিড ইন্ডাস্ট্রির স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফিড রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি ২০২৫ সাল নাগাদ পোলট্রি মাংস, ডিম ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের রপ্তানি মার্কেটে প্রবেশের সক্ষমতা অর্জনের জন্য বর্তমান বছরের বাজেটের জন্য তিনটি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে পোলট্রি-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে।
প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে : সরকারের দেয়া বিদ্যমান সুবিধাগুলো অগ্রিম কর, অগ্রিম আয়কর, কর ও শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি আরো অন্তত ১০ বছর অর্থাৎ ২০৩০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখা। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, বিশ্বের বড় বড় দেশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অস্থিরতার কারণে রপ্তানিকারক দেশগুলো প্রয়োজনীয় কাঁচামাল রপ্তানির পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে। বিগত কয়েক মাস যাবৎ মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যে ব্যবহূত কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া কাঁচামাল পরিবহনে কনটেইনার ও জাহাজ ভাড়াও প্রায় ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আগামী ১০ বছরের জন্য কর অব্যাহতি সুবিধা প্রয়োজন।
এছাড়া উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে ২ থেকে ৫ শতাংশ কর কর্তনের বিধানটি রহিত করার প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া উদ্যোক্তারা পশুখাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট ট্যাক্স ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশের প্রস্তাব করেছে।
কারণ হিসেবে বলা হয়, আগে কর্পোরেট ট্যাক্সের হার ছিল শূন্য শতাংশ। ২০১১ সালে তা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ; ২০১৪-১৫ সালে তা কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে তা আবারও বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। গত বছর করোনা সংকটে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা মূল্যের খামারিদের উৎপাদিত মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম ভ্রাম্যমাণ ব্যবস্থায় বিক্রি করা হয়েছিল। এবারও যদি সে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়, তাহলে এ শিল্পের ক্ষতি অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
অপার সম্ভাবনার পোলট্রিশিল্পে নজর দিন : করোনার অভিঘাত শেষ হলে দেশে প্রাণিসম্পদের মেলা শুরু করতে হবে, যা হবে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। গ্রামাঞ্চলে অগণিত খামারি সনাতনি কায়দায় খামার পরিচালনা করে থাকে, যেখান থেকে ডিম কিংবা মাংস উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ অন্যান্য ব্যবসার আদলে করা যায় না।
কারণ যখন উৎপাদন হয়, তখনই বিক্রি করতে হয়, ফলে অস্থিতিশীল বাজারে উৎপাদকরা পুঁজি হারাচ্ছেন। তাছাড়া চাহিদার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সরবরাহ না থাকা, রোগবালাই, আপদকালীন প্রণোদনা না থাকা, কাঁচামাল ও পণ্য আমদানিতে শুল্ক, আয়কর, পোলট্রি খাতকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের মর্যাদা না দেয়া, ওষুধের ওপর উচ্চ আমদানি শুল্কহার, ঋণের ক্ষেত্রে বর্ধিত হারে সুদহার ইত্যাদিও রয়েছে।
পোলট্রি কৃষির উপখাত হলেও ঋণ নিতে হয় ডাবল ডিজিটে অথচ কৃষি খাতে ঋণের সুদ মাত্র ৫ শতাংশ। বিদেশি কোম্পানির আগ্রাসনও দেশীয় খামারিদের সর্বনাশ করছে। অন্যদিকে কৃষিতে বিদ্যুৎ বিলে প্রণোদনা ও ছাড় থাকলেও পোলট্রি খামারিদের শিল্প খাতের বিল পরিশোধ করতে হয়। ফ্রোজেন মাংস আমদানি করে দেশীয় খামারিদের ক্ষতি করা হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের পোলট্রিশিল্প চলে যাচ্ছে বিদেশি কোম্পানিদের হাতে। এ ব্যাপারে প্রাণী স্বাস্থ্যসেবাকে জরুরি ঘোষণা করা, প্রতি উপজেলায় হাসপাতাল নির্মাণসহ পোলট্রি ভ্যাকসিন-সেবা নিশ্চিতকরণ ও প্রাণিসম্পদ সেবাকে জরুরি সেবার আওতায় এনে এর লোকবল কাঠামো আধুনিকায়ন সময়ের দাবি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
লেখক: ড. মিহির কুমার রায়
অধ্যাপক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ২৭ জানুয়ারি ২০২২