ব্রুডিংয়ে ৯০ ভাগ খামারি যেসব ভুল করে

243

সারাবিশ্বে পোল্ট্রি পালন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নত ব্যবস্থাপনায় পালন করা হচ্ছে পোল্ট্রি। বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে উন্নত খামার ব্যবস্থাপনা। মুরগির যত্নে তারা আধুনিক পন্থা অবলম্বন করলেও বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে আছে।

আমাদের দেশে মুরগির বাচ্চার ব্রুডিং ব্যবস্থাপনায় সামান্য ভুল হওয়ায় লাখ লাখ মুরগি মারা যায়। পুষ্টি চাহিদা মেটাতে এবং পেশা হিসেবে বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে মুরগির খামার গড়ে উঠেছে। তবে, মুরগি খামারে ব্রুডিং ব্যবস্থাপনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাংলাদেশের খামারিরা জানেন না ফলে লোকসান গুণতে হয়। আজকে চলুন জেনে নেই মুরগির বাচ্চার ব্রুডিং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে:-

ব্রুডিং কি
জার্মান শব্দ ব্রুড থেকে ব্রুডিং শব্দটি এসেছে। যার অর্থ দাঁড়ায় তাপ দেওয়া। মুরগির বাচ্চা ছোট অবস্থায় শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই সময়ে তার ডানা না থাকায় তাপ ধরে রাখতে পারেনা। এক হিসেবে মুরগির বাচ্চাকে তাপ দিয়ে লালন পালন করাকে ব্রুডিং বলে।

মুরগির বাচ্চার ব্রুডিং ব্যবস্থাপনাঃ
ব্রুডিং বলতে ১ দিন বয়স থেকে ৪ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত মুরগির বাচ্চাকে সমস্ত প্রতিকূল অবস্থা যেমন প্রতিকূল আবহাওয়া, বন্যপ্রাণী এবং অন্যান্য সমস্যা থেকে রক্ষা করাকে বোঝায়।

মুরগির বাচ্চার প্রথম খাদ্যঃ
ডিম হতে সদ্য ফুটন্ত বাচ্চার উদর গহ্বরে কুসুমের কিছু অংশ থেকে যায় যা থেকে প্রথম ২-৩ দিন কোনো প্রকার খাদ্য বা পানি গ্রহণ ছাড়াই বাচ্চাগুলো বেঁচে থাকতে পারে। তবে বাচ্চাকে খামারে আনার পর দেরিতে খাদ্য ও পানি প্রদান করলে দৈহিক বৃদ্ধির হার কমে যায় এবং মৃত্যুর হার বেড়ে যেতে পারে, সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব বিশুদ্ধ পানি পান করতে দিতে হবে।
পানি প্রদানের কমপক্ষে ৩-৬ ঘন্টা পর বাচ্চাগুলিকে খাদ্য দিতে হবে।

প্রাথামিকভাবে পানিতে গ্লুকোজ, ভিটামিন সি এবং মাল্টিভিটামিন ১ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। পানি প্রদানের পূর্বে খাদ্য প্রদান করা উচিত নয়। এতে করে বাচ্চার দৈহিক বৃদ্ধি এবং খাদ্য রূপান্তর দক্ষতা কমে যায় ও মৃত্যুহার অধিক হয়। প্রথম ২-৩ দিন খাদ্যের পাশাপাশি ইলেক্ট্রলাইট মিশ্রিত পানি দেয়া উচিত যা বাচ্চাগুলিকে পানিশূন্যতা এবং সকল প্রকার ধকল থেকে রক্ষা করে। কিন্তু আমাদের দেশের খামারিরা আগে খাদ্য দেন পরে পানি দেন। এটি অনেক বড় ভুল।

ব্রুডিং এর প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহঃ

ব্রুডার ঘরঃ ব্রুডিং এর জন্য আলাদা ঘর হলে ভালো হয়। ব্রুডিং সাধারণত বড় মোরগ-মুরগীর ঘর থেকে কমপক্ষে ১০০ ফুট দূরে পৃথক স্থানে আলাদাভাবে করাই উত্তম। খেয়াল রাখতে হবে যেন বাইরের মুক্ত বাতাস ব্রুডার ঘরে ঢুকতে পারে এবং ভেতরের দূষিত বাতাস সহজে বাইরে যেতে পারে। লেয়ার বা ব্রয়লার পালনের ঘরও ব্রুডার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে নিম্নের কাজগুলো প্রথমে করতে হবে-

বাচ্চা তোলার কমপক্ষে ১ সপ্তাহ আগে ঘরের মেঝে পরিষ্কার করে জীবাণুনাশক দ্বারা ভালোভাবে ধুয়ে শুকাতে হবে।
সম্ভব হলে সম্পূর্ণ ঘর চট বা পলিথিন দিয়ে ধুয়ে মুছে ফিউমিগেশন করতে হবে। পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও ফরমালিন দ্বারা ফরমালডিহাইড গ্যাস সৃষ্টির মাধ্যমে ফিউমিগেশন করা যায়। প্রতি ১০০ ঘনফুট জায়গার জন্য ১২০ মিলি. ফরমালিন এর সাথে ৬০ গ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ব্যবহার করা যায়। অনেকে খামারি ভালোভাবে খামার ঘর জীবানুমুক্ত না করেই ব্রুডার হিসেবে ব্যবহার করেন। যা পরে রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

হোভারঃ
তাপ যাতে ওপরের দিকে চলে না যায় সেজন্য হোভার প্রয়োজন। হোভার টিন, কাঠ বা বাঁকা বাঁশ দ্বারা তৈরি করা যায়। হোভারকে সাধারণত ঝুলিয়ে রাখা হয়। তবে নিচে পা লাগিয়ে দাঁড় করিয়েও রাখা যায়। পাঁচ ফুট ব্যাসের হোভারের নিচে ৫০০ টি বাচ্চা রাখা যায়।

ব্রুডারঃ
ব্রুডার হলো মুরগির বাচ্চার ঘরে তাপের উৎস। ব্রুডার হিসেবে বৈদ্যুতিক হিটার, কেরোসিন বাতি, হ্যাজাক, ইত্যাদি ব্যবহার করে কৃত্রিম উপায়ে তাপ দেয়া যায়। সাধারণত গ্রীষ্মকালে ১০০ ওয়াটের ২টি বাল্ব এবং ৬০ ওয়াটের ১টি বাল্ব আর শীতকালে ২০০ ওয়াটের ২টি এবং ১০০ ওয়াটের ২টি বাল্ব প্রতি ৫০০ বাচ্চার জন্য ব্রুডারে ব্যবহার করা যথেষ্ট। বাচ্চা ব্রুডারে ছাড়ার ১০-১২ ঘন্টা পূর্বে ব্রুডার চালু করে প্রয়োজনীয় তাপ দিতে হবে। তাপ দেওয়ার সময় আমাদের দেশের খামারিরা কোন মিটার ব্যবহার করেন না। আবার বাচ্চার দিকে তেমন খেয়াল করেন না। বাচ্চাতে তাপ ঠিকমতো না দিলে সুস্থ থাকবে না এটাই সবচেয়ে বড় ভুল করেন বাংলাদেশের খামারিরা।

চিকগার্ডঃ
ব্রুডার থেকে ১.৫-৩ ফুট দুরত্বে ১.৫ ফুট উচুঁ চাটাই বা হার্ডবোর্ডের বা তারের জালের বেষ্টনী তৈরি করা হয়। ফলে বাচ্চা ব্রুডার থেকে দূরে যেতে পারে না। প্রতি ৫০০ বাচ্চার জন্য চিকগার্ডের ব্যাস হবে ১২ ফুট ।

খাবার পাত্র ও খাবার ব্যবস্থাপনাঃ
প্রথম ১-২ দিন কাগজের ওপর এবং পরবর্তীতে ১-২ সপ্তাহ ফ্লাট ট্রে ব্যবহার করা যায়। অতঃপর ৩য় সপ্তাহ থেকে হপার বা টিউব ফিডারে খাদ্য সরবরাহ করা যায়। প্রথম দুই সপ্তাহ ২ ঘন্টা পরপর খাদ্য সরবরাহ করা ভালো। প্রথম ৩ ঘন্টা ইলেক্ট্রলাইট মিশ্রিত পানি দিতে হবে।

প্রথমে ভুট্টা ভাঙ্গা বা সাগুদানা খাবারের পাত্রে মিশিয়ে দিলে ভালো হয়। কারণ এগুলো সহজে হজম হয়। খাবার কখনোই ব্রুডারের নিচে ছিটানো উচিত নয় কেননা এতে বাচ্চা ছত্রাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। বাচ্চার ওজন এবং আকারে সমতা আনার জন্য খাবার শেষ হওয়ার আগেই খাবার দেয়া উচিত। চার সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত দৈনিক ৩-৪ গ্রাম খাদ্য দিতে হবে। এরপর দৈনিক ২-৩ বার দিলেই চলবে।

পানির পাত্র ও পানি ব্যবস্থাপনাঃ
বাচ্চার জন্য ছোট প্লাস্টিকের পানির পাত্র পাওয়া যায়। ছোট টিনের কৌটার নিচে থালা বসিয়েও পানির পাত্র বানানো যায়। পানির পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। প্রথম অবস্থায় ৫০০ টি বাচ্চার জন্য ১ লিটারের ৬-৮ টি ড্রিংকার দিতে হবে। এতে করে এক সঙ্গে সকল বাচ্চা পানি পান করতে পারে। প্রতি ১০০ লিটার পানিতে ৩-৫ গ্রাম ক্লোরিন মিশানো যেতে পারে।

অবশ্য টিকা বা ওষুধ পানিতে মিশিয়ে খাওয়ানোর সময় ক্লোরিন মেশানো উচিত নয়। প্রথম অবস্থায় পানি রাখতে হবে (২৫-৩০) ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায়। প্রতিটি মুরগির পানি পান করানোর জন্য ২.৫ সেমি. জায়গা করে দিতে হবে।

ঘরের আলো ও আলো ব্যবস্থাপনাঃ
বাচ্চার ঘরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে যাতে বাচ্চা খাদ্য ও পানির পাত্র সহজে দেখতে পারে। দিনের বেলা হলে আলাদা আলো প্রদানের প্রয়োজন নেই। তবে রাতে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে কৃত্রিম আলো প্রদান করতে হবে। ব্রুডারে বাচ্চা তোলার ৩ দিন পর হতে রাতে ১-২ ঘন্টা অন্ধকার রাখতে হবে। যাতে বাচ্চাগুলি অন্ধকারের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং বিদ্যুৎ না থাকলে অন্ধকারে ভয় না পায়।

তাপমাত্রা ও এর ব্যবস্থাপনাঃ
ডিম হতে বাচ্চা ফুটার পর ৪ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাচ্চার দেহে তাপ নিয়ন্ত্রণকারী অঙ্গগুলির পরিপূর্ণতা লাভ করে না। তাই এই সময় বাচ্চাকে কৃত্রিম উপায়ে তাপ দিতে হয়। প্রথম সপ্তাহে সাধারণত ৯৫ক্ক ফারেনহাইট তাপ দিয়ে ব্রুডিং আরম্ভ করতে হয়। এই তাপমাত্রা পর্যায়ক্রমে কমিয়ে নিম্নলিখিত মাত্রায় আনতে হয়-

বাচ্চার বয়স (দিন) প্রয়োগকৃত তাপমাত্রা ফাঃ/সেল
১-৭ দিন ৯৫ ফারেনহাইট বা ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস
৮-১৪ দিন ৯০ ফারেনহাইট ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস
১৫-২১ দিন ৮৫ ফারেনহাইট ২৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস
২২-২৮ দিন ৮০ ফারেনহাইট ২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস
২৯-৩৫ দিন ৭৫ ফারেনহাইট ২৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস
৩৬-৪২ দিন ৭০ ফারেনহাইট ২১ ডিগ্রী সেলসিয়াস

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে টিকা দেয়ার পর তাপমাত্রা ১০ সে. বাড়িয়ে রাখতে হবে। এতে করে বাচ্চা টিকার প্রতি ভালো সাড়া দিয়ে থাকে। এছাড়াও স্থান সংকুলান এবং বাচ্চা যেন পর্যাপ্ত আলো পায় সে দিকে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ২৯ জানুয়ারি ২০২২