খামারে অধিক ডিম উৎপাদন করতে হলে অবশ্যই কয়েকটি কৌশল ও পরিচর্যা সঠিকভাবে করতে হবে। ডিম দেয়ার সময় লেয়ার মুরগির পরিচর্যা ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা সঠিক রাখলেই সফলতা মিলবে।
এ বিষয়ে ডা: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাঁসপাতাল, ভোলাহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বিস্তারিত লিখেছেন।
বাংলাদেশের ডিমের চাহিদা এখন দেশের উৎপাদিত ডিম দিয়েই পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। বাণিজ্যিক বৃহৎ লেয়ার খামারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে ছোট ছোট কিছু লেয়ার খামার দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ আমিষের জোগান দেয়ার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। ডিম দেয়ার পূর্বে এবং ডিম দেয়াকালীন অনেক ধরনের পরিচর্যা প্রয়োজন যা জানলে পোল্ট্রি বিজনেসকে লাভজনক রাখা ও সর্বোচ্চ ডিম পাওয়া সম্ভব।
ডিমের সর্বোচ্চ উৎপাদন পেতে হলে মুরগির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় ওজন রাখতে হবে। যদি ওজন ধরে না রাখা যায় বা ওজন বৃদ্ধি পায় ও চর্বি জমা হয়। তাহলে তা সর্বাধিক উৎপাদন লেভেলে আসার পর মুরগির ডিমের পরিমাণ, খোসার গুণগতমান এবং মুরগির উর্বরতা মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে।
এই সমস্যায় ৪০ সপ্তাহ বয়সের পর ডিমের আকার বড় হয়ে যায়। পিক প্রোডাকশনে আসার পরে পিক ফিড খাওয়াতে হয় এবং মুরগির অতিরিক্ত ওজন ঠেকাতে ও মুরগির ডিমে ম্যাস ঠিক রাখতে এই সময়ে খাবারের পরিমাণ কিছুটা কমাতে হয়। এইসব তথ্য ফিড সরবরাহকারী বা পুষ্টি কনসালট্যান্টের থেকে জেনে নিতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হল যদি পুষ্টির মাধ্যমে কাক্সিক্ষত ফলাফল পেতে হয় তাহলে, নমুনা নিয়ে রুটিনমাফিক ফিডের টেস্ট এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। পাশাপাশি নিম্নলিখিত বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ লক্ষ্য রেখে দৈনিক খাবার গ্রহণ এবং পারফরম্যান্স জানতে হবে। দৈনিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ হিসাব রাখতে হবে। ফিডে উপযুক্ত এবং কাক্সিক্ষত মানের পুষ্টি উপাদান আছে কিনা দেখতে হবে। ফিডিং ব্যবস্থাপনার উপযুক্ত পদ্ধতি বা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
ফিডে পরিপাক হওয়া শক্তি পরিমাপ করে ভারসাম্য ডায়েট তৈরি করা প্রয়োজন। কোন উপাদানের ঘাটতি বা অতিরিক্ত হলে ফ্লকের ফলাফলে এবং বাচ্চার উপর নীতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রতিদিনের বরাদ্দকৃত ফিডের মধ্যে এনার্জি এবং এমাইনো এসিডের সরবরাহের উপর ফ্লকের পারফম্যান্স নির্ভর করে।
এসবের পরিবর্তন করতে হলে অন্যান্য সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পুষ্টি সরবরাহ করা প্রয়োজন। সেখানে পুষ্টির হিসাব প্যারেন্ট স্টকের জন্য বরাদ্দকৃত এনার্জির দেয়া হয়েছে ১১.৭ মেগাজুল বা ২৮০০ কিলো ক্যালরি। স্ট্যাটার, গ্রোয়ার লেয়ার ফিডে প্রতি কেজিতে ২৮০০ কিলোক্যালরি রাখতে হবে।
কী পরিমাণ কনসেনন্ট্রেটে কী পরিমাণ শক্তিমাত্রা আছে তার সাথে প্রতিদিনের চাহিদা অনুসারে ফিডের বরাদ্দ এবং সরবরাহ করতে হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন সময়ে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমে বা বেড়ে যায়। যেমন পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়লে পোল্ট্রির খাদ্য গ্রহণ কমে যায়। সেই ক্ষেত্রে পুষ্টির মান বিবেচনা করে ফিড খেতে দিতে হবে।
একটি মোরগ বা মুরগির দৈনিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ তার বংশগত বৈশিষ্ট্য এবং পরিবেশের উপর নির্ভর করে। খাদ্য গ্রহণের কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ এবং প্রতিদিনের খাদ্যের পুষ্টি ঘনত্ব ঠিক করা এবং সে আনুযায়ী ফিড ব্যবস্থাপনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যের শক্তিমাত্রাকে সাধারণত ফিডের মধ্যে মেটাবোলাইজ হওয়া শক্তির পরিমাণকে নির্দিষ্ট করে ফিডের মধ্যে প্রোটিনের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকতে হবে যেন শারীরিক পুষ্টির জন্য সকল এমাইনো এসিড উৎপন্ন হতে পারে। ফিডের প্রোটিনের মধ্যে সব ধরনের চাহিদামতো প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিড থাকতে হবে। যেন প্রতিটি উপাদানের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত হয়।
ফিডের মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণ প্রোটিন ব্রিডারের অতিরিক্ত মাংসপেশী তৈরি করে যা অনুর্বরতার অন্যতম কারণ। অন্যদিকে প্রোটিনের ঘাটতি হলে ফ্লকের ডিম উৎপাদন কমে যায় এবং পালকের সমস্যা হয়।
ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ঠিক রাখতে একটা ডিমপাড়া লেয়ারের জন্য প্রতিদিন ৪-৫ গ্রাম ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন। উল্লেখযোগ্য ফলাফল পেতে ৫% ডিম উৎপাদনের পর থেকেই ব্রিডারের রেশনে বা ফিড এই মাত্রায় ক্যালসিয়ামের সরবরাহ রাখতে হবে। যথাযথ ডিমের গঠন রাখতে প্রতিটি মুরগিকে দৈনিক ১ গ্রাম হারে ক্যালসিয়ামের সরবরাহের জন্য বড় সাইজের লাইমস্টোন বা ওয়সেস্টার সেল বা ঝিনুক চূর্ণ ব্যবহার করা যেতে পারে।
ফিডের সাথে মিশানো লাইমস্টোনের চেয়ে এভাবে হালকা চূর্ণ করা লাইমস্টোন বা ঝিনুক ব্যবহার বেশি যুক্তিযুক্ত বলে অনেকে মনে করেন। এতে পিলেটের সাহায্যে খাওয়ানো হলে যে অপচয় হয় তা কমানো যায়।
লেয়ারকে সকালে ফিডের মাধ্যমে ছোট চূর্ণ লাইমস্টোন খাওয়ানো হলে তা দ্রুত শোষণ হয়ে বিকেলে বা সন্ধ্যায় বৃক্কের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। অন্যদিকে যদি বিকেলের ফিডে অপেক্ষাকৃত বড় আকারের লাইমস্টোন চূর্ণ খাওয়ানো হলে তা সারারাত পেটে শোষণ হয়ে ডিমের সেল প্রস্তুতের সময় যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়।
ফলে উপযুক্ত গুণাগুণ বিশিষ্ট ডিম পাড়তে পারে। আরেকটি অন্যতম উপায় হলো শেডে লিটারের মধ্যে এই অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম উৎসগুলো সরবরাহ করা হয়। তাছাড়া লিটারে বেশি পরিমাণ ক্যালসিয়াম গ্রহণ করালে সেলের কোয়ালিটিতে নীতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যদি লিটারে ক্যালসিয়াম সরবরাহ করা হয় তাহলে অতিরিক্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম ফিডে সরবরাহ করা যাবে না, যে পর্যন্ত লিটারে ক্যালসিয়াম অবশিষ্ট থাকে। ম্যাস ফিড ব্যবহৃত হলে বড় আকারের চূর্ণ খাবারের সাথে সহজে মানিয়ে যায় না।
পর্যাপ্ত পরিমাণ ফসফরাসের সরবরাহ মুরগির হাড়ের গঠন এবং ডিমের খোলস গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত পরিমাণে ফসফরাস ডিমের সেল গঠনে এবং হ্যাচাবিলিটিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যথাযথ মাত্রায় ফিডে ফসফরাস সরবরাহ ডিমের কোয়ালিটি সঠিক মাত্রায় রাখতে সহায়তা করে।
সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ক্লোরাইড প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মাত্রায় সরবরাহ করলে ফ্লকের পানি গ্রহণ বৃদ্ধি পায়। লিটারের মান কমে এবং ডিমের সেল গঠনে নীতিবাচক ভূমিকা রাখে। এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য উপরে বর্ণিত মূখ্য খনিজ লবণের পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখতে হবে।
ফিডে অতিরিক্ত পরিমাণে ফাইটেজ এনজাইম ব্যবহার করে ফসফরাস মুক্ত করা হয়। সর্বোচ্চ ডিমের উৎপাদনে আসার পর ঠিক কোন সময়ে ফিডের পরিমাণ কমাতে হবে তা কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। উৎপাদনের সময় এবং কি পরিমাণ খাবার কমাতে হবে তা নিচে দেয়া হলো।
প্রতিদিনের ডিমের ওজন এবং ডিমের ওজনের গড় বয়সের সাথে ডিমের ওজন ও ওজনের গড়ের আদর্শ মান থাকে। ফিড পরিষ্কারের সময় পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রতিদিনের ওজন এবং ওজনের পরিবর্তন তা অবশ্যই কাক্সিক্ষত মানের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে। প্রতিদিনের পরিবর্তিত ফিড পরিষ্কারের সময়। পরিছন্ন সময় বলতে ফিড দেয়া থেকে শুরু করে তা শেষ হওয়া পর্যন্ত।
ম্যাস ফিডের ক্ষেত্রে সময়টা ৩-৪ ঘণ্টা এবং টুকরা টুকরা ফিডের ক্ষেত্রে ২-৩ ঘণ্টা ও পিলেটের ক্ষেত্রে ১-২ ঘণ্টা সময় লাগে। এই সময়ের চেয়ে কম বা বেশি সময় লাগলে এখানে ফিডের সরবরাহ খুব বেশি কিংবা খুব কম তা নিশ্চিত করে। তা ছাড়া ফার্ম ম্যানেজারের উচিত সময়তো বার্ড হ্যান্ডেল এবং পরীক্ষা করা স্বাস্থ্য ভালো আছে কিনা তা নিশ্চিত করা।
পিক লেভেলে আসে ৩১ সপ্তাহ বয়সে। অনেক সময় কোন কোন ফ্লকের উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাপক পরিমাণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পরিবর্তিত হয় এবং এমন অবস্থায় ফিড কমানো প্রোগ্রামকে প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করে নিতে হয়। পিক লেভেলের পরে ডিমের ওজন এবং পোল্ট্রির দৈহিক ওজন পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রধান কাজ। ফিড কমানো প্রোগ্রাম এমনভাবে নির্দিষ্ট করতে হবে যেন প্রতি সপ্তাহে ১৫-২০ গ্রাম ওজন বৃদ্ধি পায়। এতে ডিমের উৎপাদন, ডিমের ওজন এবং দৈহিক ওজন সঠিক মানে থাকে।
এই সময়ে অস্বাভাবিক দৈহিক ওজন বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে উৎপাদন কমে যেতে পারে। ডিমের আকার আকৃতিতে সমস্যা হতে পারে। পরিশেষে উপরোক্ত বিষয় সঠিকভাবে পালন করলে লেয়ারের ডিম উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ ডিমের সংখ্যা বাড়বে। খামারের লাভজনক অবস্থা ধরে রাখা সহজ হবে।
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তিতে প্রাণিসম্পদের কার্যক্রম আরো বেগবান হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক সেক্টর উন্নয়ন হবে। ডিম দেয়ার সময় লেয়ার মুরগির পরিচর্যা ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা শিরোনামে লেখাটি লিখেছেন ডা: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা।
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৮মে ২০২২