বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প ও প্রান্তিক খামারী

288

বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্প নব্বই দশকে শুরু হয়ে আজ অনেক দু’র এগিয়ে এসেছে। প্রানীজ আমিষ তথা ডিম ও মাংস উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তথ্য মতে এ সেক্টরে প্রায় ৬৫ লক্ষ যুবক ও নারী এ পেশার সাথে জড়িত এবং অনেকে আত্মকর্মসংস্হান সহ অন্যদেরও চাকুরীর সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিপিআইসিসি (BPICC) এর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, এ সেক্টরে প্রায় ৩৫,০০০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। তাছাড়া, প্রানীজ উৎস থেকে যে সকল আমিষের উৎপাদন হচ্ছে তন্মধ্যে পোল্ট্রি শিল্পের উৎপাদিত পণ্য তথা ডিম ও ব্রয়লার মাংস এখনও মানুষের নাগালের মধ্যে আছে।

বর্তমানে এ সেক্টরে ১০০ টি ব্রিডার ফার্ম ও হ্যাচারি, ৮ গ্রান্ড প্যারেন্ট ফার্ম, ৭,০০০ বাণিজ্যিক খামার ব্রয়লার, ২০০ টির উপর ফিড মিল এবং প্রায় ৫০০ টি এ্যানিমেল স্বাস্হ্য বিষয়ক কোম্পানী সহ গবেষণা ও শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ এ দেশের পোল্ট্রি শিল্প উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায় যে, আমাদের দেশে সাধারনত: তিন ধরণের খামারী পোল্ট্রি সম্পর্কিত কাজের সাথে নিয়োজিত। তাদের মধ্যে আছে; ক্ষুদ্র খামারী যাদের আকার সর্বোচ্চ ৩,০০০ পর্যন্ত, মাধ্যম আকারের যারা ৩,০০০ থেকে ২০,০০০ হাজার পর্যন্ত এবং বড় আকারের খামারী যারা ২০,০০০ থেকে উপরে পোল্ট্রি লালন-পালন করে থাকে। সাধারণত: দেখা যায় যে, যারা ক্ষুদ্র আকারের খামারী তারা গ্রামে ও শহরতলীতে কিছুটা উন্নত প্রচলিত পদ্ধতিতে পোল্ট্রি লালন-পালন করে থাকে এবং যারা বড়-বড় খামারী তারা সাধারণত: পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত খামারে ব্রয়লার ও লেয়ার লালান-পালন করে থাকে।

পোল্ট্রি সেক্টরের তথ্য দেখা যায় যে, বাংলাদেশে উপরের সারির ১০ টি ব্রিডার ও হ্যাচারি ফার্ম চাহিদায় প্রায় ৭০ ভাগ ব্রয়লার বাচ্চার যোগান দিয়ে থাকে এবং মাত্র ১৪ টি ব্রিডার ও হ্যাচারি ফার্মে লেয়ার বাচ্চা উৎপাদন করে থাকে। অপর এক তথ্য মতে জানা যায় যে, মাত্র শতকরা ১০ ভাগ লেয়ার এবং শতকরা ৭ ভাগ ব্রয়লার ইস্ট্রিগেটেড পদ্ধতিতে লালন-পালন করা হয়ে থাকে এবং অন্যদিকে প্রায় ৭০-৮০ ভাগ প্রচলিত পদ্ধতিতে লালন-পালন করা হয়ে থাকে। ইদানিং এ শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ গুলোর মধ্যে খাদ্যের উপাদানের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এবং অপরদিকে এ সেক্টরে উৎপাদিত পর্ণ্য যেমন, ডিম ও ব্রয়লার এর ন্যায্য মূল্য না পাওয়া। এ চ্যালেঞ্জ দুটি মোকাবেলা করতে খামারীরা দিন-দিন হিমশিম খাচ্ছে।

প্রথমেই আসি পোল্ট্রি শিল্পের খাদ্য উৎপাদনের বিষয়ে। বাংলাদেশের ফিড মিল এসোসিয়েশন এর তথ্য থেকে দেখা যায় যে, ২০১৯ সাল থেকে যেখানে ১ (এক) কেজি ভুট্টার বাজার মূল্য ছিল ১৯.৭০ টাকা সেখানে ২০২১ সালে ১ (এক) কেজি ভুট্টার মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৯.৭০ টাকা অর্থাৎ বিগত ৩ বছরের মধ্যেই ভুট্টার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৫০.৭৬ ভাগ। অনুরুপভাবে, ২০১৯ সালে ১ কেজি সয়াবিন মিলের দাম ছিল ৩৬.৫৭ টাকা, সেখানে ২০২১ সালে ১ কেজি সয়াবিন মিলের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৫২.৭৫ টাকা এবং দাম বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় শতকরা ৪৭.২৫ ভাগ। এ দু’টি খাদ্য উপাদান পোল্ট্রি খামারে প্রায় ৬৫-৭০ ভাগ পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়া, অন্যান্য উপাদান যেমন, চালের গুড়া, ফুল ফ্যাট সয়াবিন, রেপসিড ফিড সহ, অন্যান্য উপাদানের মূল্য পূর্বের বছরের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে প্রতি কেজি খাদ্য উপাদান খরচ বেড়েছে প্রায় ২৫-৩০ ভাগ।

এখানে লক্ষ্যনীয় যে, খাদ্য উপাদানের কারণে যে হারে ফিড উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, সে হারে উৎপাদিত খাদ্য মূল্য বৃদ্ধি পায় নাই। বার্য

বিগত তিন মাসের খাদ্যের বিক্রয় মূল্যের ডাটা পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, জুন মাসে এক কেজি লেয়ার খাদ্যের মূল্য ছিল ৪১.০০ টাকা থেকে ৪৬.০০ টাকা এবং অনুরুপভাবে এক কেজি ব্রয়লার খাদ্যের দাম প্রতি কেজি ৫০.০০ টাকা থেকে ৫১.০০ টাকা। সেপ্টেস্বর/২১ (মাসের) প্রতি কেজি খাদ্যের মূল্যের তুলনামুলক বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, এই তিন মাসে ভুট্টা ও সয়াবিন মিলের দামের বিপরীতে ব্রয়লার ও লেয়ার খাদ্যের দাম যথাক্রমে ৩-৪ ভাগ ও শতকরা ৪-৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, শতকরা যে হারে ভুট্টা ও সয়াবিনের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, সে হারে উৎপাদিত খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পায় নাই। খাদ্য উপাদানের যোগান ও মূল্য বৃদ্ধির কারণে ফিড মালিকরা কোন কোন সময় লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন।

এবার বর্তমান পরিস্হিতিতে ডিম ও ব্রয়লার উৎপাদন খরচ ও বিক্রয় মূল্য নিয়ে আলোচনা করা যাক। বিগত তিন বছরের ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ২০১৯ সালে এক কেজি ব্রয়লার উৎপাদন খরচ ছিল প্রায় ১১০ টাকা অপর দিকে এক কেজি ব্রয়লার বিক্রয় মূল্য ছিল মাত্র ৯০.০০ টাকা। বর্তমানে ২০২১ সালে এক কেজি ব্রয়লার উৎপাদন খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২০.০০ টাকা এবং এক কেজি ব্রয়লার গড়ে ১০০-১১০ টাকা বিক্রি হয়। এই তিন বছরের উৎপাদন খরচ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, খামারী পর্যায়ে ব্রয়লার উৎপাদন খরচ প্রায় ৯.০% বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু সে তুলনায় বিক্রয় মূল্য তেমন বৃদ্ধি পায়নি এবং খামারীরা এ ক্ষেত্রেও কোন কোন ব্যাচে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

অপরদিকে, ২০১৯ সালে ১ টি ডিমের উৎপাদন খরচ ছিল ৫.৯০ টাকা এবং ২০২১ সালে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬.৪০ টাকা। বিগত তিন বছরের ডিম উৎপাদন খরচ ও বিক্রয় মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ডিম উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় শতকরা ৮ ভাগ এবং ডিমের বিক্রয় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় শতকরা ৯ ভাগ মাত্র।

সুতরাং উপরোক্ত তথ্য ও উপাত্তের আলোকে দেখা যাচ্ছে যে, ব্রয়লার উৎপাদনের তুলনায় ডিম উৎপাদনের খামারী কিছুটা লাভবান হচ্ছেন, যদিও সময়ে সময়ে ডিমের এই মূল্য স্হিতিশীল থাকছে না। আরও উল্লেখ্য যে, যে হারে পোল্ট্রি খাদ্য উপাদানের মূল্য বৃদ্ধিতে ফিড উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে সে তুলনায় ব্রয়লার ও ডিমের বাজার মূল্য তেমন বাড়ে নাই। এ জন্য খামারীরা লাভবান হতে পারছে না। এ জন্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের হাজার-হাজার প্রান্তিক ও মাঝারী আকারের খামারীরা। আর যারা বড় আকারের খামারী তারা কোন একটা উপ-খাতে ক্ষতি হলেও অন্য খাতে কিছুটা লাভ করে কোন রকমে টিকে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এ অবস্হা বেশিদিন চলতে থাকলে এ সেক্টরের জন্য একটা বড় বিপর্যয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে এ খাতে জড়িত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত বাংলাদেশ এবং একটি মেধা সম্পন্ন জাতি বিনির্মাণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন বাস্তবায়ন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পদার্পণের নিমিত্ত পোল্ট্রি সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা মনে করি।

এ জন্য প্রয়োজন এ সেক্টরের উন্নয়নের জন্য সরকারের গৃহিত নীতির সঠিক বাস্তবায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতা। এর সাথে দরকার উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণ করে সেক্টরের সবার অধিকার সমুন্নত থাকে। সস্তা প্রানীজ একমাত্র পোল্ট্রি সেক্টরেই সরবরাহ করতে সক্ষম এবং এ শিল্পের উন্নয়ন সাধিত হলে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার নিশ্চিত করা আরো সহজ হবে। এ সেক্টরে আরো গতিশীল ও টেকসই করার জন্য উদ্ভুত সমস্যার আলোকে নীতি নির্ধারণ প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন যাতে এর সাথে জড়িত সকল খামারীদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।

লেখক: মহাপরিচালক (পিআরএল) বিএলআরআই, সাভার, ঢাকা।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৩মে ২০২২