খামারিদের যেসব ভুলে লাভের বদলে লোকসান হয়

274

লেয়ার খামার ব্যবস্থাপনা ত্রুটির বিষয় নিয়েই আলোকপাত করা হবে। হরহামেশা যে সকল ইচ্ছা এবং অনিচ্ছাকৃত ভুল খামার ব্যবসাকে লাভের বদলে লোকসানের দিকে নিয়ে যায় সেগুলো হলো:-

একদিন বয়সী লেয়ার বাচ্চার জন্য সঠিক সরবরাহকারী নির্বাচন
লেয়ার পালন হল একটি লম্বা যাত্রার মতো; আজকে যে বাচ্চাটি খামারে এলো তা আগামী ৭৭ সপ্তাহ খামারির তত্ত্বাবধানে লালিতপালিত হয়ে পরিনামে খামারিকে আর্থিকভাবে লাভবান করবে। ব্রয়লার যেমন দ্রুত সময়ে খামার থেকে বিদায় নেয় সেখানে লালনপালনে সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি হলেও স্বল্পসময়ে বিক্রি হয়ে যাওয়ার কারণে দামের উঠানামার কারণ ছাড়া অন্য বিষয়ে তেমন লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। কিন্তু লেয়ার মুরগির বেলায় ঠিক তার উল্টো। এখানে ১-১৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাচ্চার বেড়ে ওঠা, সপ্তাহ অনুসারে সঠিক দৈহিক ওজন অর্জন করা, ভাইরাসজনিত রোগ থেকে খামারকে মুক্ত রাখা, আলো ব্যবস্থাপনা, সঠিকভাবে ঠোঁটকাটা, মাইকোপ্লাজমা নিয়ন্ত্রণ, একটি এলাকা উপযোগী কার্যকরী ভ্যাকসিন শিডিউল অনুসরণ করা লাভ-লোকসানের প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। সবকিছুকে ছাপিয়ে লাভের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে আসে ভালো উন্নতমানের একদিন বয়সী লেয়ার বাচ্চার কথা। দেশে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি বড় হ্যাচারি লেয়ার বাচ্চা উৎপাদন করে। সে জন্য ব্রয়লার বাচ্চার মতো খামারিদের তেমন একটা অপশন থাকে না বাচ্চা ক্রয় করার ক্ষেত্রে। সাথে আছে মাঝে মাঝে একদিন বয়সী বাচ্চার সংকট এবং লাগামহীন উচ্চ মূল্য। অনেকটা বাধ্য হয়েই খামারিরা ডিম উৎপাদনের সিডিউল ঠিক রাখার জন্য হাতের কাছে স্বল্প সময়ে যে হ্যাচারির বাচ্চা পায় তা কিনে নেয়।

যে জাতের মুরগির ডিমে আছে ক্যান্সারের ওষুধ
বাস্তবতার নিরীখে যে হ্যাচারির বাচ্চা কিনুন না কেন নিজস্ব চ্যানেলের মাধ্যমে ওই হ্যাচারি সম্পর্কে এবং তাদের সরবরাহ করা বাচ্চা চেনা পরিচিত খামারে কেমন প্রোডাশন দিচ্ছে, মৃত্যুহার কেমন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কেমন বিস্তারিত জেনে নিন। যে হ্যাচারির বাচ্চা ক্রয় করবেন বলে মনস্থির করেছেন সে হ্যাচারির বাচ্চা ম্যারেক্স বা এভিয়ান লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে কিনা তার তথ্য সংগ্রহ করুন। কারণ এ দুইটি রোগে লেয়ার মুরগি আক্রন্ত হলে খামারির তেমন কিছু করার থাকে না এবং মুরগি ধীরে ধীরে অনেক দিন সময় নিয়ে ক্রমাগত মরার কারণে খামারি পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে যায়। জেনে নিন যে বাচ্চা আপনি কিনতে যাচ্ছেন তা প্যারেন্টের প্রথম দিকের বাচ্চা কিনা। এমন হলে বুঝে শুনে বাচ্চা কিনুন কারণ প্রথম হ্যাচগুলোর বাচ্চা ছোট ডিম থেকে ফুটার কারণে স্বাভাবিক কারণে ছোট হয়। এই সকল বাচ্চা খুব একটা ভালো ফলাফল দিয়েছে বলে তথ্য নাই। পাশাপাশি শীতকাল হলে ব্রুডিংকালেই এই সকল বাচ্চার উচ্চহারে মৃত্যু হয় এবং বেঁচে থাকা বাচ্চা গ্রোয়িং পিরিয়ডে টার্গেট ওজন লাভ না করার কারণে কখনোই ভালো ডিম দেয় না। বাচ্চার নাভি কাঁচা কিনা চেক করে নিন,বাচ্চা ডিহাইড্রেটেট অথবা অন্য কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কিনা ভালো ভাবে দেখে নিন। বাচ্চাকে হ্যাচারি থেকে ম্যারেক্স ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে কিনা জেনে নিন, দেওয়া হলে কোন কোম্পানির ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে নিজ উদ্যোগে তথ্য নিন এবং ১৮-১৯ দিন বয়সে ম্যারেক্সের বুস্টার ডোজ দিতে হবে কিনা নিশ্চিত হয়ে নিন।

লেয়ার বাচ্চার ব্রুডিংকালে আগামীর ভাগ্য নির্ধারণ হয়
লেয়ার বাচ্চার ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখাই হচ্ছে একজন লেয়ার খামারির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। ব্রয়লার বাচ্চার তুলনায় লেয়ার বাচ্চার খাদ্য গ্রহণের হার অনেক কম, ফলে সামান্য কোন ব্যবস্থাপনাগত ভুল যদি বাচ্চা খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকে অথবা কম খায় তাহলে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করে। ব্রুডিংকালে কম তাপমাত্রা, ঘরে অধিক খারাপ গ্যাসের আধিক্য, অপর্যাপ্ত বায়ু চলাচল, ভেজা লিটার, প্রয়োজনের তুলনায় কম খাদ্যপাত্র ও পানির পাত্র, কম জায়গায় বেশি বাচ্চা ব্রুডিং করা, ব্রুডিং ঘরে কম আলো, স্টার্টার খাদ্যে বেশি পাউডার অথবা বড় দানা, টক্সিনযুক্ত খাদ্য ও পানি, অজ্ঞতাবশত দরকারে অদরকারে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ও সালফাড্রাগের যথেচ্ছা ব্যবহার ব্রুডিংকালে বাচ্চার খাদ্য গ্রহণে ব্যাঘাত ঘটায়। পরিনামে বাচ্চা বয়স অনুপাতে দৈহিক ওজন লাভ করে না, যার ফলে চূড়ান্তভাবে পুলেটের ম্যাচুরিটি আসতে বিলম্ব হয় এবং এ ধরনের আন্ডার ওয়েট ফ্লক থেকে ভালো উৎপাদন আশা করা যায় না।

১-১৪ দিন বয়সের যত্ন খুলে দিবে সৌভাগ্যের স্বপ্ন দুয়ার

স্থানীয় পোল্ট্রি বিশেজ্ঞ দ্বারা প্রদত্ত ভ্যাকসিন সিডিউলটি অনুসরণ করুন। কোনো প্রকার গাফালতি না করে, দিন ও বয়স ধরে দক্ষ কর্মীর মাধ্যমে সঠিক পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন দিতে থাকুন, অদক্ষ লোকে ভ্যাকসিন দিলে কিছু কিছু বাচ্চায় ভ্যাকসিন প্রয়োগ বাদ যেতে পারে। ফলে ঐ সকল বাচ্চা পরর্বতীকালে ভ্যাকসিন দেওয়া সত্তেও ফ্লকের অন্য মুরগীতে রোগ ছড়াবে। ভ্যাক্সিন সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করুন। ফ্রিজে সবসময় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত রাখুন অন্যথায় ভ্যাক্সিনের গুনাগুন নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং খামারকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। ব্যবহার করা ভ্যাকসিনের খালি বোতল মাটিতে পুঁতে ফেলতে কোনোভাবেই ভুল করবেন না কারণ এই সকল খালি বোতলই একসময় রোগ ছড়ানোর উৎস হয়ে দাঁড়ায়। ৫-৬ দিন বয়সের মধ্যেই কক্সিভ্যাকসিন দিয়ে দিবেন, বেশি দেরি করলে ভ্যাক্সিনে কাজ নাও করতে পারে। কক্সিভ্যাকসিন দেওয়ার পরও ১০-১২ দিন বয়সে বাচ্চায় কক্সির লক্ষণ দেখা দিতে পারে, ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নাই, এটা আসলে ভ্যাকসিন কার্যকরী হয়েছে বলে প্রমাণ করে। যদি এই সময়ে রোগের মাত্রা একটু বেশি দেখা যায় তাহলে পানিতে দ্রবনীয় কক্সিডিওস্ট্যাট যেমন এম্প্রোলিয়াম সাথে ভিটামিন কে ব্যবহার করতে হবে, কোনো ভাবেই কক্সিসাইডাল জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করা যাবে না, করলে কক্সিভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে এবং এ সময়ে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ব্যবহার থেকে বিরত থাকবেন।

৭-৮ দিন বয়সের মধ্যেই প্রথম বারের ডিবেকিং (ঠোঁট কাটা) শেষ করতে হবে, দেরি হলে ঠোঁট শক্ত হয়ে যায় এবং ডিবেকিং কালে বাচ্চার ঠোঁট ফেটে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের সম্ভাবনা থাকে। প্রথম বারের ঠোঁট কাটায় মূলত বাচ্চার ঠোঁটের অগ্রভাগে ডিবেকিং মেশিনের গরম ব্লেডের সেঁকা দিয়ে একটু ভোঁতা করে দিতে হয়। ব্লেড়ের সাথে সেঁকা দেওয়ার সময় খুব সর্তক থাকতে হবে যেন জিহবায় গরম ব্লেডের সেঁকা না লাগে, লাগলে বাচ্চার মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে। ঠোঁট কাটা কালীন পানিতে ভিটামিন কে দিতে হবে তাহলে ঠোঁট কাটার সময় রক্ত ক্ষরণের সম্ভবনা অনেক কমে যায়। প্রথম ১৪ দিনে বাচ্চার উপর অনেক ধকল যায় সেজন্য পানিতে দরকারি ভিটামিন যেমন মাল্টিভিটামিন, বি কমপ্লেক্স, সি ও এডি৩ই, ই, ক্যালসিয়াম ও ইলেক্ট্রোলাইট প্রযোগ করতে হবে। অভিজ্ঞতা বলে, এই ১৪ দিনে যে খামারি যত বেশি তার লেয়ার মুরগির বাচ্চার প্রতি যত্নবান হবেন তার বাচ্চায় তত কম মৃত্যুহার থাকবে এবং আগামী দিনে এই সকল বাচ্চা তার জন্য অনেক বেশি লাভ বয়ে আনবে। ভালোভাবে শুরু করা মানে অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে যাওয়া, লেয়ার ফ্লকের জীবনচক্রের শুরুতে বাচ্চাকে তার প্রযোজনীয় সকল সুবিধা প্রদান করলে সেই ফ্লকের মুরগিতে ভালো ইউনিফরমিটি থাকে, সময়মত প্রোডাকশনে আসে, পিক প্রোডাকশন অনেক দিন ধরে থাকে, প্রতি মুরগিতে বেশি হেন হাউজ প্রোডাকশন পাওয়া যায় ঔষধ কম লাগে ও মৃত্যুহার কম থাকে। সহজ কথায় বললে এই সময়টা ইনেটনসিভ কেয়ার টাইম, গাফিলতি হলে পরিনামে ব্যাপক লোকসান অপেক্ষা করবে আপনার জন্য।

ব্রুডিংকালীন যত্ন
লেয়ার বাচ্চার ব্রুডিংকালীন নিজের সন্তানের জন্মের পরবর্তী সময়ের মতো যত্ন নিতে হবে। ভাবতে হবে এই মুরগিই বড় হয়ে কাড়ি কাড়ি টাকার যোগান দিবে। খামারে বাচ্চা আসার ২৪ ঘণ্টা আগে থেকে ঘরকে ব্রুডারের মধ্যামে তাপ দিয়ে উষ্ণ করে নিতে হবে। ব্রুডারের নিচে ৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং লিটারের উপরে ৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা নিশ্চিত করতে হবে। প্রথম সপ্তাহে যেন বাচ্চার আরামদায়ক থাকার জন্য যে তাপমাত্রার দরকার হয় তার থেকে কোনো ভাবেই কম না হয়। এই সময়ে কম আলো ও তাপে বাচ্চা তেমন হাঁটা চলা করে না, তাপ নেওয়ার জন্য ব্রুডারের নিচে গাদাগাদি করে সব সময়ে জড়ো হয়ে থাকে। এই গাদাগাদির কারণে বাচ্চা খাদ্য ও পানি খায় না ফলে, নিজের শরীর থেকে পর্যাপ্ত তাপ উৎপাদন হয় না এবং প্রতিকূল পরিবেশে বাচ্চা টিকে থাকতে পারে না। ফলে অধিক মৃত্যুহার দেখা যায় এবং কাঙ্ক্ষিত ওজন লাভে ব্যর্থ হয়।

বাচ্চা সঠিক মাত্রায় তাপ পাচ্ছে কিনা বুঝার সহজ উপায়
১। ব্রুডারের নিচে গাদাগাদি করলে বুঝতে হবে প্রযোজনের তুলনায় তাপ কম হচ্ছে; তাপের উৎস বাড়াতে হবে, ব্রুডার নিচে নামিয়ে দিতে হবে।
২। যদি বাচ্চা চিক গার্ডের সাথে লেগে বসে আছে এবং ব্রুডারের নিচে কোন বাচ্চা নাই; বুঝতে হবে তাপ বেশি হচ্ছে, তাপের উৎস কমিয়ে দিতে হবে, ব্রুডার উপরে তুলে দিতে হবে।
৩। যদি বাচ্চা চিক গার্ডের সব জায়গায় সমভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে; বুঝতে হবে তাপ ঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে। এই ধরনের পরিবেশে বাচ্চা ঠিকভাবে খাবার খাবে এবং দ্রুত দৈহিক ওজন লাভ করবে।

ব্রুডিংকালীন দিনে চারবার পানি দেওয়া উচিত। এর ফলে পানি কম নোংরা হয়, খাদ্য দিতে হয় বারে বারে তাতে খাদ্য অপচয় হওয়ার সুযোগ কম থাকে। চিক গার্ডের ভিতর পানি ও খাদ্য পাত্র এমনভাবে সেট করুন যাতে বাচ্চার দৌড়াদৌড়ি ও চলাচলে কোনো ব্যাঘাত না হয়। বাচ্চার সংখ্যার আনুপাতিক হারে পানির পাত্র ও খাদ্য পাত্র দিতে হবে যেন কোনো বাচ্চারই পানি বা খাদ্য খাওয়ার জন্য যুদ্ধ করতে না হয়। অপর্যাপ্ত পানি ও খাদ্য পাত্রের কারণে বাচ্চার ইউনিফরমিটি ভালো হয় না এবং পিক প্রোডাকশান পাওয়া যায় না। চিক পেপার কোনো ভাবেই একদিনের বেশি রাখা উচিৎ নয়,যদি রাখা হয় তাহলে ক্রমাগত পানি পড়ে পেপার ভিজে যায় ,লিটার আর্দ্র হয় এবং তাতে ছত্রাক জন্মে যা ব্রুডার নিউমোনিয়ার অন্যতম কারণ। তাছাড়া পেপার দেওয়ার মূল লক্ষ্য বাচ্চাকে লিটার এবং খাদ্য চেনানো, সঠিক ব্রুডিং তাপমাত্রা বজায় রাখলে এবং উজ্জ্বল আলো থাকলে একদিনেই বাচ্চা খাদ্য চিনে যায় এবং লিটার খাওয়া থেকে বিরত থাকে। বাচ্চার নাভী কাঁচা থাকলে অথবা চুনা পায়খানা করলে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া উত্তম।

পুলেটের ডেভেলপিং এবং গ্রোয়িং পিরিয়ডে যত্ন
লেয়ার পুলেটের গরমকালে ৪ সপ্তাহ এবং শীতকালে ৬ সপ্তাহ ব্রুডিং করা প্রযোজন হয়। ব্রুডিং সমাপ্ত হলে ফ্লকের সব বাচ্চাকে ১০০ ভাগ ওজন দেওয়ার মাধ্যমে ওজন অনুসারে তিনটি গ্রেডে আলাদা করে নিতে হয়। ব্রিডার কোম্পানির গাইড অনুসারে এই গ্রেড করতে হয়, গ্রেডিং এর মূল ভিত্তি হলো সপ্তাহ অনুসারে টার্গেট ওজন, কম ওজন ও বেশি ওজন। প্রত্যেক গ্রেডকে আলাদা আলাদা রুমে বা ঘরে খাঁচায় তোলার আগ পর্যন্ত লালন পালন করতে হবে। গাইডে প্রদত্ত ওজন অনুযায়ী যে সকল বাচ্চা কম ওজনের তাদের স্টার্টার ফিড চালিয়ে যেতে হয় যত দিন পর্যন্ত বয়স অনুপাতে দৈহিক ওজন অর্জন না করে। মোটামুটি দুই সপ্তাহের মধ্যেই ওজনে চলে আসে। আর যেগুলো টার্গেট ওজনে আছে বা তার বেশি আছে তাদের গ্রোয়ার ফিড দিতে হয়। শুধুমাত্র খেয়াল রাখতে হয় যেন ওজন কম বা বেশি না হয়ে যায়। এই বয়সের মধ্যে ২য় বার ঠোঁট কাটতে হয়। ২য় বারের ঠোঁট কাটার সময় ঠোঁটের উপরের পার্টকে নাকের ছিদ্র থেকে আগা পর্যন্ত অংশকে মনেমনে তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ কেটে দিতে হয় এবং নিচের অংশকে সামান্য সেঁকা দিয়ে ভোঁতা করে দিতে হয় ।ঠোঁট কাটার পর উপরের ভাগ বড় এবং নিচের ভাগ ছোট দেখা যাবে। বাস্তবে এ রকম থাকাই হলো সঠিক ঠোঁট কাটা। সঠিক ঠোঁট কাটা না হলে মুরগি কখনো পাউডার আবার কখনো দানা খেতে পারবে না। আবার উপর নিচ সমান হলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঠোঁটও বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং ঠোকারাঠুকরির সুযোগ পাবে। ঠোঁট কাটা কালীন পানিতে ভিটামিন কে দিতে হবে তাহলে ঠোঁট কাটার সময় রক্তক্ষরণের সম্ভবনা অনেক কমে যায়। যথাসম্ভব ১২-১৩ সপ্তাহ বয়সের মধ্যেই পুলেটকে ফ্লোর থেকে খাঁচায় স্থানান্তর করতে হবে।

পুলেটকে নির্দিষ্ট বয়সে ম্যাচিউরিটিতে আসতে সাহায্য করুন
পুলেটের দৈহিক বৃদ্ধির বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করতে হলে তার ফিজিওলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট জানা জরুরি। পুলেটের স্কেলিটাল (অস্থিতন্ত্র) দ্রুত বৃদ্ধি পায় মূলত ৮-১২ সপ্তাহ বয়সের মধ্যেই। এই সময়ের রেশনের মধ্যে হাড়গোড় বাড়ার জন্য প্রযোজনীয় ফসফরাস সহ অন্যান্য অরগানিক ট্রেস মিনারেল যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাংগানিজ,আয়রন, জিংক ছাড়াও ভিটামিন ডি পর্যাপ্ত পরিমানে থাকতে হবে। এই ৫ সপ্তাহের মধ্যেই নির্ধারিত হয়ে যায় কোনো পুলেটটি আকারে কত বড় হবে এবং সব সময় ছোট না বড় আকারের ডিম দিবে। যে মুরগির গঠন যত বড় সে পুলেট আনুপাতিক হারে তত বড় সাইজের ডিম দেয়। বর্তমানে অধিকাংশ খামারি রেডি ফিড খাওয়ানোর কারণে আসলে বুঝতে পারেন না যে খাদ্যে এই সকল দরকারি মিনারেল বা ভিটামিন বাস্তবে কতটুকু আছে, তাই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য এ সকল মিনারেল ও ভিটামিন এই সময়ে খাবার পানির মাধ্যমে মুরগিকে সরবরাহ করা উচিৎ। পুলেটের সেকেন্ডারি সেক্স অরগ্যান যেমন ওভারি এবং ডিমের নালি, জরায়ু ইত্যাদি দ্রুত বৃদ্ধি পায়, ১৬-১৮ সপ্তাহের মধ্যে। এই সময়ে তাই পুলেটকে বেশি ধকল করা যাবে না, যেমন ভ্যাকসিন দেওয়া ও গ্রেডিং করা ছাড়া তেমন ধরাধরি করা উচিৎ নয়, এতে মুরগির ম্যাচিউরিটি আসতে বিলম্ব ঘটতে পারে। সাবালকত্ব আসার জন্য জরুরি বিষয় এই সময়ে সঠিক দৈহিক ওজন লাভ করা । যদি পর্যাপ্ত ওজন না আসে লাইটিং সিডিউল চালু করার পর পরই বাণিজিক লেয়ার মুরগি ডিম পাড়া শুরু করে কিন্তু জরায়ু পরিমান মতো প্রশস্ত না হলে সরু পথে ডিম আসতে গেলে পুরো জরাযু বেরিয়ে আসে, যাকে প্রোলাপস বলে, একবার প্রোলাপস হলে সেই পুলেটকে বাঁচানো যায় না। ১৬-১৮ সপ্তাহের পুলেটের খাদ্য ও পানিতে ভিটামিন দিতে হয়, ভিটামিন ই-কে সেক্স ভিটামিন বলে, ভিটামিন ই সেকেন্ডারি সেক্স অরগ্যান বৃদ্ধিতে সাহায়্য করে এবং ওভারিতে ডিম্বাণুর বড় হওয়াতে সাহায্য করে , একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা পরে এই ডিম্বাণুই আস্ত একটি ডিমে পরিণত হয়।

অন সেট লেয়িং বা প্রিলেয়িং পিরিওয়ডের কেয়ার
পুলেটের জীবনের ১৮-২০ সপ্তাহ বয়সকে ডিম পাড়ার প্রস্তুতি পর্ব বা প্রিলেয়িং পিরিয়ড বলে। এই বয়সের মধ্যেই যদি ফ্লকের কোনো পুলেট আন্ডার ওয়েট থাকে তাদের আলাদা ভাবে বাছাই করে উচ্চ এনার্জি ও অধিক প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য দিয়ে এবং পানিতে উপযুক্ত ভিটামিন দিয়ে কাঙ্ক্ষিত ওজনে নিয়ে আসতে হবে। এভাবে করলে পুরো ফ্লকে ভালো ইউনিফরমিটি আসবে এবং দ্রুত সময়ে মুরগি পিক প্রোডাকশনে আসবে এবং পিক প্রোডাকশন অনেক দিন থাকবে যা মুরগি প্রতি গড়ে বেশি সংখ্যক ডিম পেতে সাহায়্য করে। এই সময়ে মুরগির জন্য বেশি পরিমানে ভিটামিন ই, এ, ফলিক এসিড, রাইবোফ্লাভিন দরকার হয়, খাওয়ার পানির মাধ্যমে আমরা এগুলোর যোগান দিতে পারি। লাইটিং সিডিউল বিষয়ে অধিক যত্নবান হতে হবে। পুলেট ব্যবস্থাপনার সব বিষয় ঠিক থাকলেও এ বয়সে সঠিক তীব্রতায় ও নির্দিষ্ট সময় ব্যাপী আলো না দিলে ডিম তৈরি হবে না। সুতরাং মনে রাখতে হবে আলোক প্রদান বিষয়ই হলো লেয়িং পিরিয়ডের ডিম পাড়ার প্রধান নিয়ামক।

পিক প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট এবং চ্যালেঞ্জ ফিড
লেয়ায়ার মুরগির সর্বোচ্চ হারে ডিম দেওয়াকালীন বিশেষ সর্তক থাকা জরুরি। সাধারণত পিক প্রোডাকশান পিরিয়ড হলো ২৮-৩৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত। মুরগির দেহ থেকে এ সময়ে ডিমের মাধ্যমে অনেক দরকারি উপাদান উচ্চ হারে বেরিয়ে যায়, ফলে মুরগি দুর্বল হয়ে পড়ে। খোসার গঠনের জন্য প্রচুর ক্যালসিয়াম লস হয়, এ কারণে পিক প্রোডাকশন দীর্ঘায়িত হলে মুরগির পায়ে দুর্বলতা দেখা দেয়। কোনো কোনো সময় খোঁড়া হয়ে যায়। সাথে যদি আবহাওয়ায় উচ্চ তাপমাত্রা থাকে তাহলে ডিমের খোসা পাতলা হয়ে যায় এবং প্রচুর পরিমানে ডিম ভেঙ্গে যায়। এ সকল সমস্যা থেকে দূরে থাকার জন্য মুরগির খাদ্যে এই সময় উচ্চ হারে বিভিন্ন ভিটামিন, মিনারেল দরকারি অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যোগ করতে হয়। স্বাভাবিক লেয়ার খাদ্যের চেয়ে প্রোটিন ও বিপাকীয় শক্তির পরিমানও বাড়াতে হয়। প্রযোজন হলে মুরগিকে বেশি খাওয়ানোর জন্য মিড নাইট ফিডিং (রাতের বেলা খাওয়ানো) করাতে হয়। বিভিন্ন কৌশলে পিক প্রোডাকশনের সময় মুরগির পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি পূরণের জন্য অতিরিক্ত খাওয়ানোর বিভিন্ন পন্থাকেই চ্যালেঞ্জ ফিডিং বলে। চ্যালেঞ্জ ফিডিং এর উদ্যোগ না নিলে কিছু দিনের মধ্যেই ডিম প্রোডাকশন ব্যাপক হারে কমে যাবে এবং কোনো ক্রমেই আর ডিম প্রোডাকশন বাড়ানো যায় না।

লেয়িং সময়ের বিশেষ সর্তকতা
১। সিডিউল মোতাবেক কৃমিনাশক এবং লিভার টনিক ব্যবহার করতে হবে।
২। মাইকোপ্লজমা নিয়ন্ত্রণে মাইকোপ্লাজমাল ড্রাগ সিডিউল মোতাবেক পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে কমপক্ষে ৫০ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত।

৩। ডিম পাড়া বয়সের শেষ দিকে পানিতে নিয়মিত ক্যালসিয়াম জাতীয় প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে হবে।

৪। গরমের সময় বিশেষ যত্ন নিতে হবে , এই সময় পানিতে ভিটামিন ই এবং ইলেক্ট্রোলাইট ব্যবহার করতে হবে।
৫। তলপেটে বেশি পরিমানে চর্বি জমলে পানিতে কোলিন ক্লোরাইড ব্যবহার করলে চর্বি অনেকটা কমে আসে এবং ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
৬। বিভিন্ন কারণে ইনজুরিতে আক্রান্ত মুরগি এবং ডিম পাড়া থেকে বিরত আছে এমন মুরগি বাছাই করে আলাদা করতে হবে এবং কিছু দিন পর্যবেক্ষণে রাখার পর যদি বুঝা যায় আর ডিম দিবে না তা হলে অবিলম্বে কালিং (জবাই বা মাংসের জন্য বিক্রি) করে দিতে হবে, এই কাজ সব সময় চলমান রাখতে হবে।
৭। যে সকল লাইট থেকে আলো কম হয় সেই লাইটগুলো অবিলম্বে বদলে নতুন লাইট প্রতিস্থাপন করতে হবে এবং প্রতিদিন আলো জ্বালানোর সময় সব লাইট জ্বলছে কিনা এবং পর্যাপ্ত আলো দিচ্ছে কিনা নিয়মিত চেক করতে হবে ।
৮। লেয়িং পিরিয়ডে সম্ভব হলে এলাইজা টেস্ট করে বিভিন্ন ভাইরাসজনিত রোগের বুস্টার ভ্যাকসিন দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। সবশেষে সর্বোচ্চ বায়োসিকিউরিটির ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে, খামার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, বিশুদ্ধ জীবাণুমুক্ত খাওয়ার পানি, শিয়াল, কুকুর, পাখি, ইঁদুর মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক পরিচিতি: অঞ্জন মজুমদার, ফিডমিল, পোল্ট্রি নিউট্রিশান, প্যারেন্টস্টক, লেয়ার, ভ্যালুচেইন অ্যান্ড ফার্ম ইকুইপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট এক্সপার্ট।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১৯অক্টোবর ২০২২