দেশি মুরগি পালনের সুবিধা

661

দেশি মুরগি, স্বাদ ও মানে যা নিঃসন্দেহে অনন্য। বর্তমান বাজারে মুরগির কো্নো অভাব না থাকলেও দেশি মুরগির চাহিদা চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলাতেই রয়েছে অসংখ্য মুরগির খামার। কিন্তু সেসব খামারের সিংহভাগেই পালন করা হয় ব্রয়লার অথবা সোনালী জাতের মুরগি। কিন্তু বাঙালীর পছন্দের তালিকায় এ দুটোকে অনেক পেছনে ফেলে দেশি মুরগিই রয়েছে শীর্ষে। তাই বাজারে ব্রয়লার মুরগির অভাব না থাকলেও, চাহিদার তুলনায় দেশি মুরগির যোগানটা নিতান্তই কম। ফলে দামটাও অনেক বেশি। আর ঠিক সে কারণেই তৈরি হয়েছে মস্ত বড় সুযোগ। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সঠিক পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন করে আপনিও দারুণ লাভবান হতে পারেন।

দেশি মুরগি পালনের সুবিধাসমূহ
ইতোমধ্যেই বলেছি ব্রয়লার ও সোনালী মুরগির কথা। কিন্তু সেগুলোর চেয়ে দেশি মুরগি পালন নিঃসন্দেহে অনেক বেশি সুবিধাজনক। ঠিক কী কী কারণে দেশি মুরগি পালন করা উচিত তাই ব্যাখা করছি এখনঃ-

চাহিদা
যেকোনো পণ্য উৎপাদন করে লাভবান হওয়ার পূর্বশর্ত হলো সেই পণ্যের চাহিদা থাকা। এদিক দিয়ে দেশি মুরগিকে সেরা বলা চলে। কারণ দেশি মুরগির চাহিদা আকাশচুম্বী। কৃষিজাতীয় ব্যবসাগুলো‘র মধ্যে বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত হতে উচ্চবিত্ত সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের পছন্দের তালিকাতেই দেশি মুরগির নামটা আগে আসে। ঘরে ঘরে এখন ব্রয়লার মুরগি খাওয়ার চল শুরু হলেও যেকোনো অনুষ্ঠানে অথবা ঘরে অতিথি আসলে দেশি মুরগির যেনো কোনো বিকল্প নেই। আবার অনেক মানুষ তো ব্রয়লার মুখেই তুলতে পারেন না। তাদের একমাত্র ভরসা দেশি মুরগি। কিন্তু দেশি মুরগির যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে তার তুলনায় যোগান একেবারেই কম। বর্তমানে বাজারে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা সোনালী মুরগিকে দেশি মুরগি বলে বিক্রি করে থাকে। সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়ে তা কেনেও। কিন্তু ভালো দেশি মুরগির সন্ধান পেলে অনেক ক্রেতাই বেশি দাম দিতে পরোয়া করবে না। তাই এটি পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের বাজারে দেশি মুরগির চাহিদার কোনো কমতি নেই।

স্বল্প পুঁজি
দেশি মুরগি পালনের অন্যতম সুবিধা হলো এর জন্য স্বল্প পুঁজি হলেও চলে। যেকোনো ব্যবসা শুরু করতে অধিকাংশ মানুষ যেই সমস্যাটি মোকাবেলা করে থাকে তা হলো তাদের হাতে তাকে হয়তো স্বল্প পুঁজি। বাকি সব কিছু থাকা সত্ত্বেও শুধু পুঁজির অভাবে কত মানুষ যে বসে আছে তার ইয়ত্তা নেই। এক্ষেত্রে দেশি মুরগি পালন হতে পারে একদম আদর্শ একটি উপায়। কারণ দেশি মুরগি খুব স্বল্প অথবা মধ্যম পুঁজিতেও পালন করা সম্ভব। ব্রয়লার মুরগির ক্ষেত্রে এ সুবিধা নেই কারণ ব্রয়লার মুরগি পালনের জন্য নির্দিষ্ট কাঠামো লাগে। এছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রে টাকা খরচ না করলে ব্রয়লার মুরগিকে বাঁচানো যায় না। কিন্তু দেশি মুরগি প্রকৃতিতে ছেড়ে পালন করা যায় বিধায় এতে বলতে গেলে তেমন কোনো পুঁজির দরকারই নেই। আবার অর্ধবদ্ধ পদ্ধতিতে পালন করলেও খুব বেশি পুঁজির প্রয়োজন পড়ে না। অর্থাৎ যারা কম টাকায় ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবছেন অথবা ঘরের কাজের পাশাপাশি অন্য কিছু করে বাড়তি আয় করে নিতে চান তাদের জন্য দেশি মুরগি পালন আসলেই একটি আদর্শ পন্থা।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
দেশি মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য হাইব্রিড মুরগির চেয়ে বহু গুণে বেশি। ব্রয়লার মুরগি পালনে রোগ বালাই এক ভীষণ আতঙ্কের নাম। কত খামারি যে এর কারণে সর্বস্ব হারিয়েছেন তার হিসাব নেই। কারণ ব্রয়লার মুরগি তেমন রোগ প্রতিরোধী নয়। এছাড়াও ব্রয়লার মুরগির রোগ ছড়ায় খুব দ্রুত। একটি মুরগি অসুস্থ হলেই পুরো খামার অসুস্থ হয়ে যাওয়া খুবই নিয়মিত ঘটনা। সেদিক দিয়ে দেশি মুরগি অনেক নির্ভরযোগ্য। এরা মাঠে ঘাটে চরে খায় বলে এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বহুগুণে বেশি। যদিও তার মানে এই নয় যে দেশি মুরগির একেবারেই রোগ হয় না। কিন্তু দেশি মুরগি পালনে তুলনামূলকভাবে অনেক নিশ্চিন্তে থাকা যায়।

দেশি মুরগির জাত
মুরগির জাত নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। মনে রাখতে হবে, যেহেতু এই মুরগিগুলো পুরোপুরি খোলা বা অর্ধ-বদ্ধ অবস্থায় পালন করা হবে তাই অবশ্যই এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হওয়া চাই। এছাড়াও এদের মাংস বা ডিম উৎপাদন ক্ষমতার দিকেও নজর রাখতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের দেশি মুরগির সংখ্যা ২০ কোটিরও ওপরে।

এদেশে বহুল প্রচলিত তিনটি মুরগির জাত হচ্ছেঃ

১) কমনদেশি

২) গলাছিলা

৩) হিলি

কমনদেশিঃ
এদের তেমন কোন নির্দিষ্ট রং নেই। তবে লালচে বাদামি ও লালচে কালো রঙের মুরগিই বেশি দেখা যায়। এদের পা লোমহীন ও পায়ের নলা সাদাটে অথবা হলুদ হয়ে থাকে। কখনো কখনো কালোও হয়ে থাকে। এরা একক ঝুঁটি বিশিষ্ট এবং ডিমের রং সাদা অথবা গাড় বাদামি হয়ে থাকে।

গলাছিলাঃ
এই জাতের মুরগির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এদের গলায় কোনো লোম নেই। এ কারণেই ‘গলাছিলা’ নামটির উৎপত্তি। এরা সাধারণত লালচে পালক বিশিষ্ট হয়ে থাকে। তবে কখনো কখনো কালো পালকও দেখা যায়। এদের পা থাকে লোমহীন এবং পায়ের নলা বেশিরভাগ সময়ই হলুদ হয়। তবে মাঝে মাঝে সাদা কালো নলা দেখা যায়। এদের ডিমের রং হালকা বাদামি।

হিলিঃ
এই জাতের মুরগিগুলো আকারে অন্যান্য দেশি মুরগির চেয়ে কিছুটা বড় হয়। এই জাতের বেশিরভাগ মুরগির পালক সাদার মাঝে কালোর ছিটা যুক্ত হয়। এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এদের হলদে চামড়া ও পালকহীন পা। ডিমের রং হালকা বাদামি।

উল্লেখ্য যে, উপরে বর্ণিত প্রত্যেকটি জাতই বেশ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন হয়। এছাড়াও এ দেশে ভালো জাতের মুরগি হিসেবে রোড আইল্যান্ড রেড ও ব্ল্যাক অস্ট্রালপ মুরগির সুনাম রয়েছে।

লাভের হিসাব ও শেষকথা
লেখাটির একদম শুরুতেই এদেশের বাজারে দেশি মুরগির চাহিদার কথা বলেছি। ব্রয়লার মুরগির কেজি যেখানে ১২০-১৩০ সর্বোচ্চ ১৬০ এর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে, সেখানে দেশি মুরগির কেজি কম করে হলেও ৪৫০ টাকা। কখনো সে আবার আরো বেড়ে ছুঁয়ে ফেলে ৫৫০ টাকাও। অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগির তুলনায় এর উৎপাদন ব্যয় যে খুব বেশি এমনটিও না। অর্থাৎ স্বল্প খরচে অনেক বেশি পরিমাণ লাভ করা সম্ভব এই দেশি মুরগি থেকে। এর ডিমও বিক্রি হয় বেশ ভাল দামে। তাই স্বল্প খরচে ও সীমিত পরিশ্রমে লাভের মুখ দেখতে চাইলে, আজই শুরু করতে পারেন দেশি মুরগি পালনের পরিকল্পনা।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ০২ নভেম্বর, ২০২২